শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২
গাজায় ইসরাইলি হত্যাকান্ড

গণকবরে প্রিয়জনদের খোঁজ

ম উদ্ধার ও পুনরুদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনাকারী একটি দল 'প্যালেস্টেনিয়ান সিভিল ডিফেন্স'র এক কর্মকর্তার বক্তব্যের সঙ্গে এই কথার মিল পাওয়া যায়। ওই কর্মকর্তাও বলেছিলেন, মৃতদেহগুলোর হাত বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেছে, কিছু মৃতদেহকে মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখা গেছে এবং কয়েকজনকে বন্দিদের পোশাক পরিহিত অবস্থায়ও পাওয়া গেছে...
যাযাদি ডেস্ক
  ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
গণকবরে প্রিয়জনদের খোঁজ
গাজায় গণকবর থেকে উত্তোলন করা ফিলিস্তিনিদের মৃতদেহ

একজন মা তার নিখোঁজ সন্তানকে সর্বত্র খুঁজে বেড়াবেনই এবং যতদিন পর্যন্ত তার শরীরে শক্তি আছে, ততদিন পর্যন্ত তিনি তার খোঁজ থামাবেন না। এক্ষেত্রে তার সন্তান জীবিত না কি মৃত, সেটি কোনো বিষয় নয় তার কাছে। গত কয়েকদিন ধরে কারিমা এলরাস গাজার আল-নাসের হাসপাতালের গণকবরের কোলাহল, ধূলাবালি ও অসহনীয় দুর্গন্ধের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তিনি ২১ বছর বয়সি সন্তান আহমেদের মা, যিনি গত ২৫ জানুয়ারি দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস শহরে নিহত হন। কিন্তু এরপর থেকে আহমেদের লাশ নিখোঁজ রয়েছে। গত মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) কারিমা অবশেষে তার ছেলেকে খুঁজে পান।

তিনি বলেন, 'আমি এখানে বারবার এসেছি। আমার ছেলের, আমার পুত্র আহমেদের, আমার আদরের ছোট্ট ছেলে, আমার ভালোবাসা'র লাশ খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত। ওর বয়স যখন ১২ বছর, তখন ও তার বাবাকে হারিয়েছে এবং তারপর থেকে আমিই ওকে বড় করেছি।'

অন্য পরিবারগুলো গণকবরের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছিল। হতাশাজনক হলেও বিশ্বের সব যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলেরই খুব পরিচিত দৃশ্য এটি। মৃতদের খুঁজে পাওয়ার জন্য বুলডোজারগুলো মাটি খুঁড়ছে। মাটির নিচ থেকে একটি শক্ত হাত প্রসারিত হয়ে আছে। কবর থেকে উত্তোলিত মরদেহ সমাধিস্থ করার জন্য আলাদা স্থান চিহ্নিত করছেন খননকারীরা। প্রিয়জন হারানো পরিবারগুলো আশা করে আছে, কবর থেকে উত্তোলন করা মৃতদেহগুলোর মধ্যে তাদের খুঁজে পাবে। কিন্তু এমন দৃশ্যের ব্যাখ্যা সবসময় একই রকম না। প্রতিটি গণকবর- সেটি হোক বলকান অঞ্চলের দেশগুলো, মধ্য আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, অথবা অন্য কোথাও- সেখানকার স্থানীয় অবস্থার ফল।

গাজায় এমন একটি যুদ্ধ চলছে, যেখানে ৩৪ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে, যারা একটি জনাকীর্ণ স্থানে বসবাস করতেন। এখন এই মৃতদেহগুলোকে দাফন করা বেশ জটিল ও বিপজ্জনক কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু করবস্থানে কোনো জায়গাই আর খালি নেই। আবার চলমান লড়াইয়ের কারণে অন্য কবরস্থানগুলোয় পৌঁছানোটাও অসম্ভব। এসব কারণে মৃতদেহগুলোকে হাসপাতাল চত্বরেই কবর দেওয়া হচ্ছে, যেখানে ইসরাইলি বাহিনী হামাসের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে বলে বলছে।

এর আগে কিছু যুদ্ধ- সেসব ক্ষেত্রে এটি খুব দ্রম্নততার সঙ্গে যুক্তিসঙ্গতভাবে বলা সম্ভব ছিল যে, ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে আসলে কী হয়েছে। এটা বলা সম্ভব ছিল, কারণ ময়নাতদন্তকারীরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতেন এবং সাংবাদিকরাও দ্রম্নত ওই এলাকায় প্রবেশ করতে পারতেন। কিন্তু গাজার বর্তমান পরিস্থিতি, যেখানে ইসরাইল ও মিসর আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের কাছে কিছু স্বীকার করতে অস্বীকার করছে এবং ময়নাতদন্তকারীদের যে কোনো দলের জন্য এই সংঘাত অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি করছে, সেখানে দাঁড়িয়ে নাসের হাসপাতাল এবং আল-শিফা হাসপাতালের কবর থেকে মৃতদের কখন ও কীভাবে উত্তোলন করা হয়েছিল, তা নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। বলা মুশকিল, কবে তারা নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে অন্তত কিছু মানুষ ইসরাইলি বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছিলেন- যেমনটা দাবি করছেন হামাস ও স্থানীয় উদ্ধারকারীরা।

অথবা গণকবরে পাওয়া শত শত মৃতদেহ কি মেডিকেল কমপেস্নক্সের ভেতরে ও চারদিকে হওয়া বিমান হামলা ও লড়াইয়ের শিকার? না কি তারা যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট কোনো রোগ ও অপুষ্টিতে ভুগে মারা গেছেন? না কি ইসরাইলি বাহিনী এই মৃতদেহগুলোকে একটি কবর থেকে আরেকটি নতুন কবরে স্থানান্তর করেছে?

নাসের হাসপাতালের গণকবর নিয়ে যা জানা যাচ্ছে

গত ২২, ২৩ ও ২৮ জানুয়ারি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা কিছু ভিডিও যাচাই করে দেখেছে 'বিবিসি ভেরিফাই'। সেগুলোতে দেখা যাচ্ছে, ফিলিস্তিনিরা গাজার আল-নাসের হাসপাতাল প্রাঙ্গণের দুটি স্থানে মৃতদেহ দাফন করছে। পোস্ট করা সেই ভিডিওগুলোর মধ্যে মিল রয়েছে। তাতে সারিবদ্ধ পাম গাছ ও অদূরে অবস্থিত ভবন দেখা গেছে।

চিকিৎসা কর্মী এবং বাস্তুচু্যত বেসামরিক ব্যক্তিরা ওই এলাকাজুড়ে তীব্র লড়াইয়ের কথা জানায় এবং এরপর হাসপাতালটিকে ইসরাইলি বাহিনী ঘেরাও করে ফেলে। সেখানে অস্থায়ী দাফন করা হয়।

গত ১৫ ফেব্রম্নয়ারি ইসরাইলি অভিযান শুরু করার আগে কতগুলো মরদেহ দাফন করা হয়েছিল, তা নিশ্চিত করার কোনো তথ্য জানা নেই। গাজার হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গত ২৭ জানুয়ারি বলেছে, হাসপাতাল প্রাঙ্গণে ১৫০ জনকে দাফন করা হয়েছে, কিন্তু এই সংখ্যাটি যাচাই করা প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার। তবে এটি নিশ্চিত করে বলা যায়, খান ইউনিস থেকে ইসরাইলি বাহিনী প্রত্যাহারের পর সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত ভিডিওগুলোতে একই সমাধিস্থল দেখানো হয়েছে। ভিডিওগুলোতে গাছে ও ভবনের একই রকম সারি স্পষ্টভাবে দেখা গেছে।

গাজার বেসামরিক প্রতিরক্ষা বাহিনী বলেছে, '৩৩০টির বেশি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু ওই মানুষগুলো কখন ও কীভাবে মারা গেলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর আমরা দিতে পারছি না। ইসরাইলি বাহিনীর অভিযানের আগে ওখানে কতগুলো মৃতদেহকে দাফন করা হয়েছে, নাসের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সেই হিসাব রাখতে পারে। কিন্তু আমরা তা জানি না।'

ইসরাইলি সামরিক বাহিনী নিশ্চিত করেছে, হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের মধ্যে কেউ ছিল কি না, তা দেখার জন্য তারা হাসপাতাল প্রাঙ্গণের কবরগুলো খুঁড়ে মৃতদেহগুলোকে বের করে পরীক্ষা করেছে এবং পরীক্ষা শেষে 'তাদের জায়গায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে'। কিন্তু 'স্কাই নিউজ' ভিডিও ও স্যাটেলাইট ইমেজ যাচাই করেছে। সেখানে দেখা যায়, অভিযান পরিচালনার সময় ইসরাইলি বুলডোজারগুলো হাসপাতাল প্রাঙ্গণের ওপর দিয়ে চলে গেছে। ফলে ওই স্থানের দৃশ্যমান ক্ষতি হয়েছে।

ফিলিস্তিনি অঞ্চলের জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের পরিচালক অজিথ সাংহে বলেন, কবরগুলোর একটি স্বাধীন ময়নাতদন্ত করতে হবে। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের আরেক কর্মকর্তা জানান, হাত বাঁধা অবস্থায় কিছু মরদেহ পাওয়া গেছে।

উদ্ধার ও পুনরুদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনাকারী একটি দল 'প্যালেস্টেনিয়ান সিভিল ডিফেন্স'র এক কর্মকর্তার বক্তব্যের সঙ্গে এই কথার মিল পাওয়া যায়। ওই কর্মকর্তাও বলেছিলেন, মৃতদেহগুলোর হাত বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেছে, কিছু মৃতদেহকে মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখা গেছে এবং কয়েকজনকে বন্দিদের পোশাক পরিহিত অবস্থায়ও পাওয়া গেছে।

রিম জেইদান, যিনি দুই সপ্তাহ ধরে তার ছেলে নাবিলের লাশের খোঁজ করছেন। সবশেষে বুধবার বিকালে তিনি তার ছেলের লাশ খুঁজে পেয়েছেন। রিম বলেন, তিনি মৃতদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখেছেন। সেই সঙ্গে, মৃতদেহগুলোর হাত বাঁধা ছিল। তিনি বলেন, 'তাদের মৃতু্যদন্ড কার্যকর করা হয়েছিল। কাউকে কাউকে আবার হাত ও পা একসঙ্গে বেঁধে মৃতু্যদন্ড দেওয়া হয়েছিল। আর কতকাল এটি চলবে?'

সাংহেকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি হাত বাঁধা লাশের কোনো প্রমাণ দেখেছিলেন কি না। উত্তরে তিনি বলেন, 'আমাদের কাছে তথ্য আছে, কিন্তু এখনো কোনো প্রমাণ নেই। এই তথ্যটি বিভিন্ন উৎস থেকে নিশ্চিত হওয়া দরকার এবং সে কারণেই আমাদের একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্ত করা প্রয়োজন। কিন্তু আমরা তা অনুমোদন করতে পারি না। এই পরিস্থিতিতে আমরা গাজায় অসংখ্য গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হতে দেখেছি, যার মধ্যে অনেকগুলোই সম্ভাব্য যুদ্ধ অপরাধ। এবং যেখানে আমরা সম্ভাব্য নৃশংস অপরাধের শঙ্কা উত্থাপন করেছি, তা অস্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের তীব্রতা আরও ব্যাপক হয়েছে।' তিনি আর বলেন, ইসরাইর অনুমতি ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রম্নতি পেলে গাজায় মোতায়েন করার মতো দল প্রস্তুত আছে তার।

এদিকে, হাসপাতালে মৃতদেহ দাফন করার বিষয়টিকে মিথ্যা ও মানহানিকর আখ্যায়িত করে প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ। এক বিবৃতিতে ইসরাইল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ) জানায়, 'আইডিএফ ফিলিস্তিনিদের মৃতদেহ দাফন (মাটিচাপা) করেছে, এই দাবি ভিত্তিহীন ও অমূলক।' আইডিএফ আরও বলেছে, গত ৭ অক্টোবর যাদের জিম্মি করে হামাস গাজায় নিয়ে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে কেউ ছিল কি না, তা দেখতে মৃতদেহগুলোকে তোলা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, যেসব স্থানে জিম্মিদের উপস্থিতির সম্ভাবনা ছিল, শুধু সেসব স্থানে খুব সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করা হয়েছিল। মৃত ব্যক্তিদের মর্যাদা বজায় রেখে পরীক্ষাটি সম্মানের সঙ্গে পরিচালিত হয়েছিল। শনাক্তকরণের চেষ্টা ও মৃতদের যথাযথ সম্মানের সঙ্গে দাফন করার চেষ্টা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে।'

সোমায়া আল-শোরবাগি নাসের হাসপাতাল থেকে তার স্বামী ওসামার মৃতদেহ উদ্ধার করেন এবং তাকে পরিবারের বাকি সদস্যদের পাশে সমাহিত করার জন্য একটি কবরস্থানে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। তার মেয়ে হিন্ডের সঙ্গে তিনি সদ্য খোঁড়া কবরের কাছে হাঁটু গেড়ে বসেন। সোমায়া বলেন, 'আমার মেয়ে আমাকে তার বাবার কবর দেখাতে বলেছিল এবং, আমি তাকে বলব যে, যতদ্রম্নত সম্ভব দাফন দেওয়ার পর আমরা তার কবর দেখতে যাব। আলস্নাহকে ধন্যবাদ। এটি খুব কঠিন পরিস্থিতি, কিন্তু তাকে দাফন করার পর আমরা কিছুটা স্বস্তি পাব।'

ছোট্ট হিন্ড, যার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। শিশুর সারল্যের দৃষ্টিতে বাবাকে স্মরণ করছিল, 'সে আমায় ভালোবাসত এবং আমার জন্য প্রায়ই অনেক কিছু কিনত। সে আমাকে নিয়ে প্রায়ই বাইরে ঘুরতে যেত।' তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে