প্রতি বছর লাখ লাখ মুসলমান সৌদি আরবে হজ পালন করতে যান। তবে এ বছরটা বাড়তি শোকাবহ হয়ে উঠেছে বহু মুসলিস্নর মৃতু্যর প্রেক্ষাপটে। এবারের হজযাত্রায় বিভিন্ন দেশের অন্তত ৯২২ জন হাজির মৃতু্য হয়েছে, যার বেশিরভাগের পেছনে তীব্র গরমের দিকটি উলেস্নখ করেছে বার্তা সংস্থা 'এএফপি'।
আর্থিক ও শারীরিকভাবে সক্ষম মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার এই যাত্রা শেষ হয়েছে গত বুধবার। যদিও এ বছর হজ মৌসুমে স্বাস্থ্য পরিকল্পনার সাফল্যের দিক তুলে ধরেছে সৌদি আরব। সৌদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ফাহাদ আল-জালস্নায়েল এক বিবৃতিতে উলেস্নখ করেছেন, 'বড় সংখ্যক হজযাত্রী এবং উচ্চ তাপমাত্রার কারণে চ্যালেঞ্জ হলেও হজ মৌসুমে কোনো ধরনের জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত ঝুঁকিমুক্ত'। সৌদি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই বছর প্রায় ১৮ লাখ ৩০ হাজারের মতো হাজি এই হজের আনুষ্ঠানিকতায় অংশগ্রহণ করেছেন, যার মধ্যে ১৬ লাখই এসেছিলেন বিদেশ থেকে। কিন্তু এবারের হজে এত বেশি মৃতু্যর কারণ কী?
চরম তাপে উত্তপ্ত পরিস্থিতি
এবার সৌদি আরবে তাপমাত্রা ছায়ার মধ্যেই ৫১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত গেছে। এই পরিস্থিতিকেই একটা বড় কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। সৌদি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় উচ্চতাপ ও পানিশূন্যতা এড়াতে সতর্কতা জারি করলেও অনেক হাজি তীব্র গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা এবং 'হিটস্ট্রোক'-এর শিকার হয়েছেন।
দুই ডজনের বেশি দেশ থেকে হজ পালন আসা মানুষের মধ্যে সর্বাধিক মৃতু্য হয়েছে মিসরীয়দের। একজন আরব কূটনীতিক জানিয়েছেন, মিসরের যে ৬৫৮ জন ব্যক্তির মৃতু্যর কথা বলা হচ্ছে, তার প্রায় সবই চরম তাপের কারণে হয়েছে। এই হাজিদের অনেকেরই যথাযথ হজ পারমিট ছিল না, যার ফলে তাদের ক্ষেত্রে হাজিদের জন্য নির্ধারিত সহযোগিতা বা সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি ছিল।
নাইজেরিয়ান হাজি আইশা ইদ্রিস বলছেন, 'শুধু আলস্নাহর রহমতে আমি বেঁচে গেছি, কারণ সেখানে অত্যধিক গরম ছিল। তারা কাবার সব দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল, আমাদের ছাদ ব্যবহার করতে হয়েছিল, সেখানে প্রচন্ড তাপে যেন জ্বলছিল।' তিনি আরও বলেন, 'আমাকে ছাতা ব্যবহার করতে হয়েছিল এবং ক্রমাগত জমজম পানি (পবিত্র পানি) দিয়ে নিজেকে ভিজিয়ে রাখতে হয়েছিল। একপর্যায়ে মনে হচ্ছিল, আমি অজ্ঞান হয়ে যাবো, তখন আমাকে ছাতা দিয়ে একজনের সাহায্য করতে হয়েছিল। আমি ভাবিনি যে তাপ এত তীব্র হবে।'
নাইম নামে আরেকজন হাজি হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন। তার ছেলে বলেন, 'আমার মায়ের সঙ্গে হঠাৎ করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানতে পেরেছি, তিনি হজের সময় মারা গেছেন।' মায়ের ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে মক্কাতেই দাফন করা হবে বলে জানান তিনি।
এমন তাপের সঙ্গে অভ্যস্ত না থাকা, কঠিন ধরনের শারীরিক কাজকর্ম, বিস্তীর্ণ খোলা জায়গা এবং হাজিদের অনেকে বয়স্ক বা অসুস্থ থাকায় হাজিদের জন্য ঝুঁকি থাকেই। হজের সময় গরমের কারণে মৃতু্যর ঘটনা নতুন নয় এবং ১৪০০ সাল থেকে মৃতু্যর তথ্য নথিভুক্ত করা হচ্ছে। গত বছরও গরমের কারণে কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত হওয়ার ২০০০ ঘটনার তথ্য দিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
'ক্লাইমেট অ্যানালিটিক্স'র কার্ল-ফ্রেডরিচ শ্লেউসনার 'রয়টার্স' নিউজ এজেন্সিকে বিশ্বের তাপমাত্রা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তার গবেষণা অনুযায়ী, শিল্প বিপস্নবের আগের সময়ের তুলনায় বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি বাড়লে হজের সময় হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি পাঁচ গুণ বেড়ে যেতে পারে। বর্তমান পূর্বাভাস অনুযায়ী, পৃথিবীর উষ্ণতা ২০৩০-এর দশকের মধ্যে ১.৫ ডিগ্রি বেড়ে যাবে, যা ভবিষ্যতে হজযাত্রীদের আরও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।
অতিরিক্ত ভিড় এবং পরিচ্ছন্নতাজনিত সমস্যা
বিভিন্ন মানুষের বয়ান থেকে যেমনটা জানা যাচ্ছে, সৌদি কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার কারণে চরম পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে, যার ফলে হজযাত্রীদের জন্য নির্ধারিত অনেক এলাকায় বিভিন্ন সংকট দেখা গেছে। অনেকে বলছেন, থাকার জায়গা বা সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থাপনার দিক দিয়ে ভালো ছিল না, ফলে তাঁবুগুলোতে অতিরিক্ত ভিড় এবং পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত সুবিধার ঘাটতি ছিল।
ইসলামাবাদ থেকে যাওয়া ৩৮ বছর বয়সি আমিনা (ছদ্মনাম) বলেন, 'মক্কার তাপে আমাদের তাঁবুগুলোতে কোনো এয়ার কন্ডিশনার ছিল না। যে কুলারগুলো বসানো হয়েছিল, তাতে বেশিরভাগ সময় পানি ছিল না।' কয়েকজন হাজি অভিযোগ করেছেন, কিছু তাঁবুতে শীতলীকরণ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ছিল না। আমিনা আরও বলেন, 'এই তাঁবুগুলো এতটা শ্বাসরুদ্ধকর ছিল যে, আমরা ঘেমে ভিজে যাচ্ছিলাম এবং এটি ভয়ানক অভিজ্ঞতা ছিল।'
জাকার্তার একজন হাজি ফৌজিয়া বলেন, 'তাঁবুগুলোতে ভিড় এবং অতিরিক্ত তাপের কারণে অনেকেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। আমরা রাত অবধি খাবারের জন্য অপেক্ষা করেছি, তাই তাঁবুর লোকেরা ক্ষুধার্ত ছিল।'
পরিবহণ সমস্যা
প্রচন্ড গরমের মধ্যেই হাজিরা প্রায়ই দীর্ঘ পথ হাঁটতে বাধ্য হয়েছেন। এজন্য অনেকে বিভিন্ন জায়গায় রাস্তা আটকে দেওয়া এবং খারাপ পরিবহণ ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পাকিস্তানি হাজি বলেন, 'আমাদের সাত কিলোমিটার দীর্ঘ পথে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, যেখানে কোনো পানি এবং ছায়া ছিল না। পুলিশ ব্যারিকেড বসিয়ে আমাদের অপ্রয়োজনীয়ভাবে দীর্ঘ দূরত্ব হাঁটতে বাধ্য করেছে।' তার মতে, সৌদি সরকারি যানবাহন পাওয়া গেলেও গরমের কারণে অসুস্থ ও অজ্ঞান হয়ে পড়া হজযাত্রীদের জন্য ব্যবহার করা হয়নি। তিনি বলেন, 'ক্যাম্পে মানুষকে মুরগি বা খামারের পশুর মতো রাখা হয়েছিল, দুই বিছানার মাঝে দিয়ে যাওয়ার মতো জায়গা ছিল না এবং কয়েকটি টয়লেট শত শত মানুষের জন্য যথেষ্ট ছিল না।'
একটি বেসরকারি দলের হজ সংগঠক মুহাম্মদ আচা অব্যবস্থাপনার বিষয়ে একমত। তিনি বলেন, 'এটি আমার ১৮তম হজ এবং আমার অভিজ্ঞতায়, সৌদি নিয়ন্ত্রকরা সাহায্যকারী নয়। তারা নিয়ন্ত্রণ করে কিন্তু তারা সাহায্য করে না।' আচার মতে, গ্রীষ্মকালে একজন সাধারণ হাজিকে দিনে কমপক্ষে ১৫ কিলোমিটার হাঁটতে হতে পারে। এতে তাদের হিটস্ট্রোক, ক্লান্তি এবং পানির সংকটে ভোগার ঝুঁকি রয়েছে। তিনি বলেন, 'আগেকার বছরগুলোতে তাঁবুতে প্রবেশের জন্য ইউ-টার্নগুলো খোলা ছিল, কিন্তু এখন সেই সব রুট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে একজন সাধারণ হাজি, যদি 'এক নম্বর জোনের 'এ' ক্যাটাগরি তাঁবুতে থাকলেও তাকে তাঁবু পর্যন্ত পৌঁছাতেই গরমের মধ্যে অন্তত আড়াই কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছে।' আচা বলেন, 'যদি এই রুটে কোনো জরুরি পরিস্থিতিও ঘটে, তাহলে ৩০ মিনিটের মধ্যে কেউ আপনার কাছে পৌঁছাবে না। জীবন বাঁচানোর কোনো ব্যবস্থা নেই, এমনকি পথে পানির পয়েন্টও নেই।'
বিলম্বিত চিকিৎসা সহায়তা
অনেক হাজিই পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা পাননি বলে জানা গেছে। অনেকে বলছেন, যারা তীব্র গরমে ক্লান্তি বা অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগেছেন তাদের জন্য অ্যাম্বুলেন্স বা প্রাথমিক চিকিৎসা সহজে পাওয়ার উপায় ছিল না। আমিনা বর্ণনা করছিলেন, একজন সহযাত্রীর ক্লাস্ট্রোফোবিয়ার বা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে অক্সিজেন প্রয়োজন ছিল, তখন তাদের মরিয়া অনুরোধ সত্ত্বেও অ্যাম্বুলেন্স আসতে ২৫ মিনিটের বেশি সময় লেগেছিল। তিনি বলেন, 'অবশেষে, একটি অ্যাম্বুলেন্স এসেছিল এবং ডাক্তার তাকে দুই সেকেন্ডও দেখেননি এবং 'তার কিছু হয়নি' বলে চলে গেলেন।'
অবশ্য হজযাত্রীদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে বরাদ্দকৃত সম্পদের কথা তুলে ধরেছেন সৌদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সরকারি এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তারা ৬৫০০ শয্যার সক্ষমতা সম্পন্ন ১৮৯টি হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, মোবাইল ক্লিনিক চিকিৎসা সেবায় যুক্ত করেছে এবং ৪০ হাজারের বেশি চিকিৎসা, প্রযুক্তি, প্রশাসনিক বিষয়ক কর্মী এবং স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সেখানে ৩৭০টির বেশি অ্যাম্বুলেন্স, সাতটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, শক্তিশালী লজিস্টিক নেটওয়ার্ক সম্পন্ন ১২টি ল্যাবরেটরি, ৬০টি সরবরাহ ট্রাক এবং তিনটি ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা সামগ্রী সংবলিত গুদাম স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত করা হয়েছে এবং পবিত্র স্থাপনার বিভিন্ন জায়গায় সুকৌশলে স্থাপন করা হয়েছে।
নথিবিহীন হাজিরা
হজ করতে একজন হাজিকে একটি বিশেষ হজ ভিসার জন্য আবেদন করতে হয়। কিন্তু কিছু ব্যক্তি সঠিক কাগজপত্র ছাড়াই হজে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এই 'অনুমোদনহীন হজ' সমস্যা অতিরিক্ত মৃতু্যর জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়। যারা সঠিক কাগজপত্র ছাড়া হজ করেন তারা কর্তৃপক্ষকে এড়িয়ে চলেন, এমনকি প্রায়ই সাহায্যের প্রয়োজন হলেও। কিছু তাঁবুর ভিড়ের জন্য কর্তৃপক্ষ তাদের দায়ী করেছেন। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় হজ এবং ওমরাহ কমিশনের চেয়ারম্যান মুস্তোলিহ সিরাজ বলছেন, 'আমাদের সন্দেহ, যাদের হজের ভিসা নেই তারা হজ এলাকায় অনুপ্রবেশ করেছেন।'
একজন আরব কূটনীতিক জানান, এই মৌসুমে অন্তত ৬৫৮ জন মিসরীয় মারা গেছেন, যার মধ্যে ৬৩০ জনের হজ পারমিট ছিল না। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ