আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে আবারও নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ 'ব্যাটলগ্রাউন্ড রাজ্যে'র ভোট তার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় ফেরার পথকে নির্ধারণ করে দিয়েছে। প্রথম মেয়াদে অর্থাৎ ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আমেরিকার ৪৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ট্রাম্প। তার নীতির সঙ্গে মোটামুটি ভারতসহ সারা বিশ্ব পরিচিত। একাধিক ফ্রন্টে তার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকারের রয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদির সম্পর্ক ভালো। ট্রাম্প বহুবার নরেন্দ্র মোদিকে তার ভালো বন্ধু বলে বর্ণনা করেছেন। এবারের নির্বাচনে ট্রাম্পকে একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী মোদির নাম উলেস্নখ করতেও শোনা গেছে। তবে ভারতের নীতিকে আক্রমণ করতেও ছাড়েননি তিনি। ফলে এখন প্রশ্ন উঠছে, ট্রাম্প দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসায় ভারতের ওপর কী প্রভাব পড়তে পারে এবং তিনি কি ভারতের বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের নীতিতে পরিবর্তন আনবেন?
আর্থিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক
ট্রাম্পের অর্থনৈতিক নীতিতে 'আমেরিকা ফার্স্ট' দৃষ্টিভঙ্গিই প্রাধান্য পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে আমেরিকান শিল্প সংরক্ষণের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি চীন ও ভারতসহ একাধিক দেশ থেকে আমদানির ওপর চড়া শুল্ক আরোপ করেছিলেন।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ধারাবাহিকভাবে 'আমেরিকা ফার্স্ট'-এর স্স্নোগান দিয়ে আসছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ভারতকে আমেরিকান হার্লে ডেভিডসন মোটর সাইকেলের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার বা কমানোর কথা বলা হয়েছিল। যেসব দেশ মার্কিন পণ্য বা পরিষেবা আমদানির ক্ষেত্রে উচ্চ শুল্ক আরোপ করে, তাদের বিরুদ্ধে তিনি কড়া অবস্থান নিতে পারেন। ভারতও কিন্তু এই তালিকায় আসতে পারে।
আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি পর্যবেক্ষণকারী সাংবাদিক শশাঙ্ক মট্টু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ (সাবেক টুইটারে) লিখেছেন, 'ট্রাম্পের চোখে ভারত বাণিজ্য সংক্রান্ত নিয়ম খুব বেশি লঙ্ঘন করে। তিনি চান না যে, ভারত মার্কিন পণ্যের ওপর খুব বেশি পরিমাণ শুল্ক আরোপ করুক। ট্রাম্প চান তার দেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করা হোক।' মট্টু ব্যাখ্যা করেছেন, যদি ট্রাম্পের শুল্কবিধি সত্যিই বাস্তবায়িত হয় তাহলে তার প্রভাব ভারতে কেমন পড়তে পারে। তিনি লিখেছেন, 'কিছু অর্থনীতিবিদের অনুমান অনুযায়ী, যদি ট্রাম্পের শুল্ক বিধি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে ২০২৮ সালের মধ্যে ভারতের জিডিপি ০.১% পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। ভারত ও আমেরিকার মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ২০ হাজার কোটি ডলার। ট্রাম্প যদি শুল্কের হার আরও বাড়ান, তাহলে ভারতকে অনেকটাই ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।'
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতি ভারতের আমদানিকে ব্যয়বহুল করে তুলতে পারে। এর ফলে মূল্যস্ফীতির হার বাড়বে এবং সুদের হার খুব বেশি কমানো সম্ভব হবে নয়। এতে বিশেষত মধ্যবিত্ত গ্রাহকদের সমস্যা বাড়তে পারে। কারণ তাদের ইএমআই বেড়ে যাবে।
প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সম্পর্ক
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চীনের কট্টর বিরোধী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার প্রথম মেয়াদে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের বেশ অবনতি দেখা গিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে ভারত ও আমেরিকার মধ্যে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক আরও জোরদার হবে বলেই আশা করা যায়।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম মেয়াদে, কোয়াডকে শক্তিশালী করার বিষয়ে খুব সক্রিয় ছিলেন ট্রাম্প। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপানের জোট হলো কোয়াড।
ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ভারতের সঙ্গে অস্ত্র রপ্তানি, যৌথ সামরিক মহড়া ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে আরও মজবুত সমন্বয় হতে পারে। এর ফলে চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের অবস্থান শক্তিশালী হবে।
মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক 'র?্যান্ড করপোরেশন'-এর ইন্দো-প্যাসিফিক বিশ্লেষক ডেরেক গ্রসম্যান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ লিখেছেন, 'ট্রাম্পের জয় ভারত ও আমেরিকার বর্তমান কৌশল অব্যাহত রাখবে। মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেওয়া ছাড়াই ভারত-আমেরিকার কৌশলগত অংশীদারত্বের ধারাবাহিকতা দেখা যাবে বলে অনুমান করা যায়। মোটের ওপর ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ায় ভারত লাভবান হবে।'
সাংবাদিক শশাঙ্ক মট্টু লিখেছেন, 'ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বে থাকাকালে ভারতের সঙ্গে বড় ধরনের প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন এবং চীনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন।'
ট্রাম্পের ভিসা নীতি
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতি অভিবাসীদের জন্য বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। মার্কিন নির্বাচনে অভিবাসন একটা বড় ইসু্য এবং ট্রাম্প এ বিষয়ে বেশ সোচ্চারও। অবৈধ অভিবাসীদের বহিষ্কারের প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন তিনি। ট্রাম্প অভিযোগ তুলেছেন, অবৈধ অভিবাসীরা মার্কিন নাগরিকদের চাকরিতে 'ভাগ বসাচ্ছে'।
বিপুল সংখ্যক ভারতীয় মার্কিন প্রযুক্তি সেক্টরে কাজ করেন এবং তারা 'এইচ-১বি' ভিসা নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি দেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে 'এইচ-১বি' ভিসা সংক্রান্ত নিয়মের ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন। এর প্রভাব দেখা গিয়েছিল ভারতীয় পেশাদার ও প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর ওপর।
তার দ্বিতীয় মেয়াদেও এই একই নীতি অব্যাহত থাকলে আমেরিকায় ভারতীয়দের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতি অবশ্য ভারতীয় প্রযুক্তি সংস্থাগুলোকে আমেরিকা ছাড়াও অন্যান্য দেশে বিনিয়োগের বিষয়ে উৎসাহ দিতে পারে।
মানবাধিকার
ভারতের মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনো কিছু বলেননি। এটা মোদি সরকারের পক্ষে 'অনুকূল পরিস্থিতি' বলে মনে করা হয়।
কাশ্মীরের পুলওয়ামা হামলার সময়ও ট্রাম্প ভারতের 'আত্মরক্ষার অধিকার'-এর বিষয়কে সমর্থন করেছিলেন। অন্যদিকে, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রসঙ্গে ভারতের বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার হতে দেখা গিয়েছিল বাইডেন প্রশাসনকে।
কমলা হ্যারিস ২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বলেছিলেন, 'আমাদের নিজের নিজের দেশের গণতান্ত্রিক নীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষা করতে হবে। এটা গুরুত্বপূর্ণ।' ডেমোক্রেটিক পার্টি ক্ষমতায় থাকাকালে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার ইসু্যতে আরও জোর দেওয়া হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের তুলনায় ডেমোক্রেটদের কাছে এই ইসু্যগুলো বেশ বড়।
পাকিস্তান ও চীন নিয়ে ট্রাম্পের অবস্থান
কমলা হ্যারিস এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প দু'জনেই চীনকে রুখতে চান, এ বিষয়টা স্পষ্ট এবং এটাও ঠিক, সেক্ষেত্রে এশিয়ায় তাদের সবচেয়ে উপযুক্ত অংশীদার হলো ভারত। ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে চীনকে রুখতে ভারত ও আমেরিকার কৌশলগত সহযোগিতা আরও জোরদার হবে বলে অনুমান করা যায়। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আমেরিকার মিত্রদের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে দেখা গেছে। যার প্রভাব পরোক্ষভাবে ভারতের ওপর পড়তে পারে বলেও বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
এ প্রসঙ্গে ট্রাম্পের শাসনকালে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের টানাপড়েনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন শশাঙ্ক মট্টু। তিনি লিখেছেন, 'ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের বিরুদ্ধে গিয়ে তাইওয়ানকে রক্ষা করবেন কি-না তাও পরিষ্কার নয়। তার এ অবস্থান এশিয়ায় আমেরিকার জোটকে দুর্বল করে তুলবে। এর ফলে চীনের অবস্থান পোক্ত হবে, যা ভারতের স্বার্থের পক্ষে ভালো নয়।'
ডোনাল্ড ট্রাম্প কাশ্মীর ইসু্যতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন, যা ভারত পছন্দ করেনি। তিনি তালেবানের সঙ্গে সমঝোতা করেন এবং আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নেন। আমেরিকার এই পদক্ষেপ ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের স্বার্থের পরিপন্থি।
'দ্য উইলসন সেন্টার' থিংক ট্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান লিখেছেন, 'মার্কিন কর্মকর্তারা বিভ্রান্ত। আমেরিকার ইন্দো-প্যাসিফিক নীতিতে পাকিস্তানের অবস্থান কোথায়? পাকিস্তান চীনের বন্ধু। আফগানিস্তানকে এখন তাদের কৌশলের অংশ মনে করে না আমেরিকা। কারণ সেখানে (আফগানিস্তান) তালেবান রয়েছে।'
ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক নিয়ে আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চাইলে মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, রাশিয়া ও ভারতের সম্পর্কের ব্যাপারে ট্রাম্প আরও খোলামেলা হতে পারেন। তবে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ও শুল্ক ইসু্যতে তিনি কঠোর অবস্থান নিতে পারেন।
'স্ট্র্যাটেজিক অ্যাফেয়ার্স' বিশেষজ্ঞ ব্রহ্মা চেলানি এক্স-এ লিখেছেন, 'বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে ভারতের নতুন টানাপড়েন সেই পুরনো তত্ত্বকে পুনরুজ্জীবিত করেছে, যা বলছে রিপাবলিকান শাসনে ভারত-মার্কিন সম্পর্ক আরও ভালো ছিল।'
কাশ্মীর নিয়ে ট্রাম্পের অবস্থান
পাকিস্তান সম্পর্কে ট্রাম্পের মনোভাব কী হবে, তার সঙ্গে কিন্তু ভারতের স্বার্থও জড়িয়ে রয়েছে। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে আমেরিকা সফরে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তাকে হোয়াইট হাউসে স্বাগত জানান তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেই সময় কাশ্মীর প্রসঙ্গে মধ্যস্থতার কথা বলেন ট্রাম্প। কয়েক দশক পরে একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে কাশ্মীর নিয়ে মধ্যস্থতার কথা বলতে শোনা গিয়েছিল। শুধু তাই নয়, ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও চান, তিনি (ট্রাম্প) কাশ্মীর নিয়ে মধ্যস্থতা করুন। তবে ভারত তার এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে। ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয় প্রধানমন্ত্রী মোদি ট্রাম্পকে এমন কোনো কথা বলেননি।
পাকিস্তান ট্রাম্পের বক্তব্যকে স্বাগত জানালেও ভারতের জন্য এই পরিস্থিতি যে অস্বস্তিকর ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ভারতের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য হলো, কাশ্মীর নিয়ে তারা কোনো মধ্যস্থতা মেনে নেবে না। তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ