বীর-উত্তম খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া আমার সহোদর। আমার বড়ভাই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টরের অধীন জালালপুর সাব-সেক্টরের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। লে. কর্নেল সি. আর. দত্ত (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি প্রাপ্ত) ছিলেন সেক্টর কমান্ডার। দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শাহাদতবরণ করেন আমার ভাই কমান্ডার নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া। সিলেট জেলার কানাইঘাট উপজেলায় তিনি শায়িত আছেন চিরনিদ্রায়। বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর 'বীর-উত্তম' খেতাবে ভূষিত করে। এ ব্যাপারে জেনারেল দত্ত বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ নেতৃত্ব প্রদর্শন আর সমরনৈপুণ্যের পটভূমিতে ৪নং সেক্টর থেকে নিজামের পক্ষে 'বীরশ্রেষ্ঠ' খেতাব প্রস্তাব করা হয়। ৪নং সেক্টরের ৪০০ থেকে ৫০০ মুক্তিযোদ্ধাকে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে দখলদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং শত্রম্নবাহিনীকে আতঙ্কিত করে তোলেন। কমান্ডার নিজামের বয়স তখন সবে বাইশ। এ বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর তার ৫০তম শাহাদত দিবস।
ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের স্নাতক বীর-উত্তম খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। উলেস্নখ্য, তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইবিএ (ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন)-এর তৃতীয় ব্যাচের ছাত্র। হাজী মোহাম্মদ মহসিন হলের আবাসিক ছাত্র থাকাকালে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে সংঘটিত অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াল কালোরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে বর্বর তান্ডবলীলা চালায় তিনি তা প্রত্যক্ষ করেন মহসিন হলের আবাসিক ছাত্র থাকাকালে। ঘোষিত কারফিউ কিছুটা শিথিল হলে নিজামউদ্দিন ফিরে এলেন পিতৃভূমি কুমিলস্নাতে। বাড়ি ফেরার পথ ছিল বিপদসংকুল। বাড়িতে থাকতে পারলেন মাত্র কয়েকদিন। সিদ্ধান্ত নিলেন, পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করবেন। একাত্তরে এপ্রিলের প্রথম দিকেই জনাকয়েক বন্ধু মিলে ঘর ছাড়লেন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার উদ্দেশে। বাবা-মাকে জানালেন না কিছুই। সেখানে মিলিটারি ট্রেনিং সম্পন্ন হলে তাদের পাঠানো হলো সিলেটে, মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টরে। কিছুদিনের ভেতরেই জালালপুর সাব-সেক্টরের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে পদোন্নতি হলো নিজাম ভাইয়ের। আর কমান্ডার হিসেবে সেখানে দায়িত্ব পেলেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন এক তরুণ নেতা মাহবুবুর রব সাদী।
জালালপুর সাব-সেক্টরে এলাকাবাসী তাকে ক্যাপ্টেন নিজাম হিসেবে চিনত। সেখানে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তার নাম থেকে আসা সিলেটের নিজাম নগর এলাকা তার জনপ্রিয়তার মাত্রা ধারণ করে আছে। প্রবল ধকল সহ্য করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তার মৃতদেহটি ৫-৬ কিলোমিটার দূরে বয়ে আনেন তারই সহকর্মী-এলাকাবাসী। তাকে কবরস্থ করা হয় জালালপুর মোকাম টিলাতে। যুদ্ধ শেষ হলে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার তার কবরস্থানটি ইট-সিমেন্ট-বালুতে পাকা করে দেয় এবং সেখানে স্থাপন করে দেয় পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংবলিত ফলক। আমি এই শহীদ নিজামের ছোটভাই এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমিও যুদ্ধ করেছি ২নং সেক্টরে। আমি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি আসামের তেজপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে। প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করে আমি ও আমার দলের বাকি সদস্য নিয়ে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে ত্রিপুরার সাবরুমে অবস্থিত বাইকোরানামক স্থানে অপেক্ষা করি। উদ্দেশ্য কুমিলস্না বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে যুদ্ধে অংশগ্রহণ। নিজাম ভাই জানতেন আমিও মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছি এবং শিগগিরই বাংলাদেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। আগস্ট মাসেই তিনি ভারতের শিলচর থেকে আগরতলা আসেন একটা মিটিংয়ে যোগ দিতে। আর্মি জিপে করে সেনা পোশাকেই আসেন। আগরতলা থেকে আমাকে খবর পাঠালেন ওখানে অবস্থিত একটা রিফিউজি ক্যাম্পে গিয়ে আমি যেন তার সঙ্গে দেখা করি। ক্যাম্প শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে। ওই ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলেন অ্যাডভোকেট আমির হোসেন, আমাদের বুড়িচং এবং ব্রাহ্মণপাড়া নির্বাচনী আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য।
খবরটি আমার কাছে দেরিতে আসে। আগরতলা পৌঁছে; ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য যখন ক্যাম্পে যাই, আমাকে জানানো হলো কমান্ডার নিজাম এতক্ষণে সড়কপথে সেক্টরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছেন। দেখা না হওয়ায় ভেতরে ভেতরে বেশ কষ্ট পেলাম। সপ্তাহখানেক বাদে খবর আসে আমার ভাই কমান্ডার নিজাম পাকিস্তান আর্মির সঙ্গে সম্মুখ সমরে নিহত হয়েছেন। আমরা সে সময় আমাদের যুদ্ধক্ষেত্র কুমিলস্নায়। দিনটি ছিল সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখ। ভোরবেলা। ওই দেখা না হওয়াটা আজীবন আমাকে ব্যথা দেবে।
\হ১৯৭২ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাস। স্বাধীন বাংলাদেশ। ভাইয়ের কবরস্থান দেখা এবং সেই সঙ্গে তার সেখানকার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। এই দুই উদ্দেশ্য নিয়ে সিলেটে যাই। কুমিলস্নার সঙ্গে সিলেটের সড়ক যোগাযোগ মোটেই ভালো অবস্থায় ছিল না। অধিকাংশ ব্রিজ কালভার্টই যুদ্ধে বিধ্বস্ত। বেশ কষ্ট করেই সিলেটে পৌঁছে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য, নেতা-নেত্রী আর ভাইয়ের সহযোদ্ধাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। সবাই সানন্দে অভিবাদন জানায়। যুদ্ধে ভাইয়ের ভূমিকা নেতৃত্ব, তার ব্যবহার, ব্যক্তিত্ব এসব নিয়ে অনেক প্রশংসা করলেন সবাই। আমাকে বলা হলো, সিলেট সারকিট হাউসে অবস্থানরত ভারতীয় সেনা অফিসার কমান্ডার নিজামকে ভালোভাবে চিনতেন। তিনি ছিলেন রাজপুত ডিভিশনের ক্যাপ্টেন কুমার। তার সঙ্গে দেখা করতে সার্কিট হাউসে যাই এবং আমার পরিচয় জেনে আমাকে তিনি জড়িয়ে ধরলেন। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। ক্যাপ্টেন কুমার নিজাম ভাইয়ের প্রশংসা করলেন। আমার মনের অভিপ্রায় জানালে তিনি নিজেই গাড়ি চালিয়ে সিলেট শহর থেকে জকিগঞ্জ হয়ে ৩৩ কিলোমিটার দূরে একটি নদীর তীর পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। সঙ্গে ছিলেন তার সহধর্মিণীও। ভদ্রমহিলাও ক্যাপ্টেন নিজাম সম্পর্কে বেশ জানতেন। আমাকে যেহেতু কিছু সময় ওখানে থাকতে হবে এবং স্থানীয় নেতা ও জনগণের সঙ্গে আলাপ করতে হবে তাই তারা দুজন সিলেট ফিরে গেলেন। তারপর নৌকায় নদী পার হয়ে নিকটবর্তী বাজারে পৌঁছলাম। স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিল মেম্বারসহ সেখানকার নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। বাজার থেকে ২/৩ কিলোমিটার দূরে কবরস্থান। সবাই আমাকে ওখানে নিয়ে গেলেন। কবর জিয়ারত করলাম। ক্যাপ্টেন কুমারের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা অশেষ। তার সেই মুগ্ধ করা আতিথেয়তা ভোলার নয়। কত বছর পেরিয়ে গেল! যদি জানতাম, তিনি এখন কোথায় আছেন!
নিজাম ভাইয়ের চেয়ে আমি দুই বছরের ছোট। ভাই যে বছর বিকম-অনার্সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন তখন আমি ক্লাস নাইনের ছাত্র। তিনি ঢাকায়, আমরা কুমিলস্নায়। ছুটিতে বাড়ি এলে তবেই দেখা-সাক্ষাৎ। এর বাইরে খুব একটা নয়। গান-বাজনা খুব ভালোবাসতেন তিনি। নিজাম ভাই ঢাকায় হাওয়াইয়ান গিটার বাজানো শিখতেন বিখ্যাত গিটারিস্ট বোরহান আহমেদের কাছে। কুমিলস্না এলে গিটারটি নিয়ে আসতেন। প্রতিদিনই ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে কখনো আধুনিক গান, কখনো রবীন্দ্রসংগীত বাজাতেন। শুনেছি ঢাকায় বিভিন্ন ওপেন এয়ারকনসার্টে বাজিয়েছেন। যুদ্ধের উদ্দেশ্যে যেদিন ঢাকা ছাড়লেন, তালা ঝোলালেন মহসিন হলের সিঙ্গেল সিটের কক্ষটিতে সেদিন সেই গিটারটিও ওখানে ছেড়ে এসেছিলেন। চলমান কারফিউ এ বিচ্ছেদ গড়ে দিল, গিটারে আর গিটারিস্টে। ১৯৭২ সালের মার্চে আমি মহসিন হলে যাই। ভাইয়ের জিনিসপত্র, বিশেষ করে তার পছন্দের গিটারটি নিয়ে যেতে। পারিবারিক এক স্মৃতির ঝর্ণা হতে পারত সেসব! হলো না! কক্ষের তালা ভেঙে ফেলা হয়েছিল। কিছুই পাইনি অবশেষে। মনে পড়ে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এই কক্ষেই ভাইয়ের সঙ্গে এক সপ্তাহ কাটিয়েছি। কত কথা হয়েছে দুই ভাইয়ে। ভুলি কী করে একসঙ্গে কাটানো সেসব মুহূর্তগুলো! শব্দগুলো! তিনি বই পড়তে ভালোবাসতেন। বন্ধুদের নিয়ে একটা দল গড়লেন। 'কালচক্র' নামে ম্যাগাজিন প্রকাশিত হলো নিজাম ভাইয়ের সম্পাদনায়।
একটি পরিবার। বাবা-মাসহ ছয় ভাই আর তিন বোন। সবার প্রতিই তিনি ছিলেন পূর্ণ সজাগ। বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন সাব-ডিভিশনে ঘুরেছেন। ভাই যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বাবা খরচ জোগাতেন। মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে ভাই চাকরির জন্য ঘুরলেন। বাবার কাছ থেকে আর খরচ নিতে চাইলেন না। বলতেন, 'মাস্টার্স পর্যন্ত তো বাবাই সবকিছু করলেন। এখন নিজেরই কিছু একটা করা দরকার।' এবং খুব দেরি হলো না। 'কন্ট্রোলার অব একাউন্টস' হিসেবে তৎকালীন হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে যোগ দিলেন। তখন ওদের ফাইন্যান্স বিভাগ দেখতেন বিশিষ্ট টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব শফিক রেহমান, এফসিএ। নিজাম ভাই হোটেলে চাকরির পাশাপাশি চালিয়ে গেলেন লেখাপড়াও। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আইবিএর সান্ধ্যকালীন এমবিএতে। আর বেতনের কিছুটা বাবাকে পাঠাতে থাকলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। মুক্তিযোদ্ধারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে। একটু একটু করে স্বাভাবিক হয়ে আসছে সবকিছু। এমনই সময়ে নিজাম ভাইয়ের বেশ কজন সহযোদ্ধা কুমিলস্নায় আমাদের বাড়িতে আসতেন, বাবা-মায়ের সঙ্গে আলাপ করতে। দুঃখ প্রকাশ করতেন। বাবা মাঝেমধ্যে তাদের সামনেই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তেন, কেঁদে ফেলতেন। একা ঘরেও তিনি চোখ মুছতেন। বাবাকে এমন দেখলে আমার ভেতরেও আবেগ জেগেছে, চোখের জল ঝরেছে। চেষ্টা করেছি, নিজেকে স্থির রাখতে। বাবা-মাকে বোঝাতে চেয়েছি, এ নির্মম বাস্তবতা সামলে নেওয়ার শক্তি সামর্থ্য আমার আছে। আমার তখন বিশ বছর বয়স, সবে দ্বিতীয় বর্ষ অর্থনীতি (সম্মান) নিয়ে পড়ছি। পরিচিতজন, স্বজনরা প্রত্যেকেই আমার ভাইকে ভালোবাসতেন। তার অনুপস্থিতি আমাদের জীবনে আজও স্মৃতির শব্দ হয়ে বাজে, বাজতে থাকবে...। তার জন্য সবার কাছে দোয়া চাই। প্রার্থনা করি, মহান আলস্নাহ সুবহানুতায়ালা তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করুন। আমিন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহ জালালউদ্দিন ভূঁইয়া : বীর-উত্তম শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়ার ছোটভাই, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থায় চাকরি করেছেন
লধষধষ.নযঁরুধহ@সধরষ.পড়স