বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি

আসুন আমরা সবাই দেশের সুনাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করি এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশের মানুষকে হয়রানি ও ভোগান্তির জাঁতাকল থেকে মুক্ত করি এবং দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন এই নীতিবাক্যকে ধারণ করে শোষণ ও বৈষম্যহীন একটি সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গঠনে সবাই মনোযোগী ও সচেষ্ট হই।
ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ
  ০৭ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০
আপডেট  : ০৭ অক্টোবর ২০২১, ০৯:৩২
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি

রাষ্ট্র সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি। আইনের শাসনের অর্থ হচ্ছে সব নাগরিকের প্রতি আইনের সমান দৃষ্টি অর্থাৎ আইন সব নাগরিকের জন্য সমানভাবে প্রয়োগ হবে। নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। দেশে সব স্তরে আইনের শাসন যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে সমাজ থেকে যাবতীয় অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নির্যাতন, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ও দুর্নীতি দূর করা সম্ভব। নাগরিক হিসেবে প্রাপ্য অধিকার কেবল আইনের শাসনের মাধ্যমে বলবৎ করা যায়। আইনের শাসন না থাকলে সবল-দুর্বল, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান প্রকট হতে থাকে। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার বেড়ে যায়। মানুষের মধ্যে মায়া, মমতা, সহমর্মিতা, ন্যায়বিচার, নীতি-আদর্শ লোপ পায়। আদর্শ সমাজ ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আইনের শাসনের গুরুত্ব অপরিসীম। আইনের শাসন নিশ্চিত হলে শাসক ও শাসিতের মাঝে সুসম্পর্ক বজায় থাকে। দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করে, ফলে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও জনগণের সেবা প্রদানের কাজটি সহজতর হয়। সর্বোপরি কল্যাণকর একটি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য শাসক ও শাসিতের উভয়েরই সমান ভূমিকা বা দায়িত্ব রয়েছে। সুনির্দিষ্ট আইন ও বিধি-বিধান অনুযায়ী শাসক রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন আর শাসিত জনগণ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সুশৃঙ্খলভাবে মেনে চলবেন। যুক্তিসংগত ও যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন, আইন প্রয়োগ, বিদ্যমান আইন সম্পর্কে নাগরিকদের সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে আইনের শাসন নিশ্চিতকরণ সরকার বা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। পাশাপাশি নাগরিকরা যদি বিদ্যমান আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে নিজের বিবেক বুদ্ধি ও বিচার বোধ দিয়ে কাজ করেন তবেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। যেমন রাস্তায় কোনো চুরি বা ছিনতাই হতে দেখলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি তার কাছে কোনো তথ্য জানতে চায় তবে তা জানিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাও নাগরিক কর্তব্য। সাক্ষী না দিয়ে যদি কেউ এড়িয়ে চলে তাহলে আইনের এত বেশি অবমাননা হবে যে, কোন আইনেই নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না। আইনের যথাযথ প্রয়োগ যেমন জরুরি তেমনি আইন মান্য করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক আইনেই কিছু নির্দেশনা এবং তা অমান্য বা ভঙ্গ করলে শাস্তির ব্যবস্থা থাকে। তারপরও দেখা যায়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আইন ভঙ্গ হয়। তবে অধিকাংশ জনগণই আইন মেনে চলে এবং আইনকে শ্রদ্ধা করে। আইন মান্য করার অনেকগুলো কারণ আছে। তার মধ্যে একটি হলো আইনের উপযোগিতা। আইন অধিকার রক্ষা করে, দুর্বলকে সবলের অত্যাচার থেকে রক্ষা করে এবং সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখে। সুশাসনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে আইনের শাসন। এটি রাষ্ট্রের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও বৈধ উপকরণ। আইনের শাসন যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় এখনো সমাজের সব স্তর থেকে অন্যায়, অবিচার, অনিয়ম, দুর্নীতি ও পেশিশক্তি সমূলে উৎপাটন করা যায়নি। বরং কোনো কোনো জায়গায় স্থায়ীভাবে তা পরিগ্রহ লাভ করেছে। যেখানে দুর্নীতি ও অনিয়ম-ই যেন নিয়ম। অভিযোগ করেও প্রতিকার পাওয়া যায় না। আইন মেনে চলতে কেউ আন্তরিক নয়। বিশেষ করে অসাধু সরকারি কর্মকর্তা, বিত্তবান ও প্রভাবশালীরা সমাজে আইন মেনে চলে না। নীতি-নৈতিকতার কোনো ধার ধারে না। কে কাকে ঠকিয়ে বা বঞ্চিত করে লাভবান হবে, জোর- জুলুম ও নির্যাতন করে অন্যের হক আত্মসাৎ করবে এবং দেশের আইন-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অবৈধ ব্যবসাবাণিজ্য করে জনগণের ধনসম্পদ লুটপাত করার যেন সে প্রতিযোগিতা চলছে। সম্প্রতি ইভ্যালি ও ই-অরেঞ্জকান্ড তারই ধারাবাহিকতার ফসল। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের আলোচিত ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। এই ব্যাধির ক্ষত সারানোর জন্য প্রয়োজন কার্যকরী চিকিৎসা ব্যবস্থা। সেটি হচ্ছে সব স্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। সুন্দর ও সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আইনের শাসনের কোনো বিকল্প নেই। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ ছাড়া এমন অবস্থার পরিত্রাণ মিলবে না। সব আইনই গণমুখী বা জনবান্ধব হওয়া বাঞ্ছনীয়; যেখানে নাগরিকের মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত থাকবে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে না। যে কোনো আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে তার সার্বজনীন আবেদনের দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা জরুরি। যে আইন গণমুখী নয়, সে আইন 'কালো আইন' হিসেবে বিবেচিত। আর তা প্রণীত হয় শাসকগোষ্ঠী বা শ্রেণি-বিশেষের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য; যেমনটি হয়েছে ব্রিটিশ আমলে ফৌজদারি দন্ডবিধির ১৪৪ ধারা ও 'প্রিভেনটিভ ডিটেনশন অ্যাক্ট, পাকিস্তান আমলেও সিকিউরিটি অব পাকিস্তান অ্যাক্ট, স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের 'বিশেষ ক্ষমতা আইন', সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসন, ১৯৭৫-এ গণমাধ্যমের ওপর অযাচিত নিয়ন্ত্রণ ঞযব হবংিঢ়ধঢ়বৎ (ধহহড়ঁহপসবহঃ ড়ভ ফবপষধৎধঃরড়হ), ২০০০ সালের জননিরাপত্তা আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ইত্যাদি। এসব আইনের সঙ্গে জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট উপাদান খুবই কম, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ আইনগুলো ব্যবহারের সমূহ সম্ভাবনা থাকার কারণে এসব আইন কালাকানুন হিসেবেই বেশি পরিচিতি লাভ করেছে। তাই রাষ্ট্রে যেমন আইনের শাসন কার্যকর থাকা জরুরি, ঠিক তেমনি প্রণীত আইনগুলোও জনবান্ধব হওয়া দরকার। আইন যদি নাগরিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট না হয়, তাহলে আইনের শাসন, অপশাসন ও দুঃশাসনের হাতিয়ার হতে বাধ্য। কালাকানুনগুলো প্রণীত ও ব্যবহৃত হয় মূলত সাধারণ মানুষের অধিকারকে হরণ করার উদ্দেশ্যে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত কালাকানুনগুলো একই সূত্রে গাঁথা। প্রচলিত সংবিধান ও আইনের মাধ্যমে যখন শাসকগোষ্ঠী স্বার্থ উদ্ধারে ব্যর্থ হয়, তখনই নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য নাগরিকের অধিকার রক্ষার নামে কালাকানুন প্রণয়ন করে থাকে। কল্যাণকর রাষ্ট্রের সুশাসনের মানদন্ডই হচ্ছে আইনের শাসন। আইনের শাসন রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিবিশেষ, যেখানে সরকারের সব কর্মযজ্ঞই সংবিধিবদ্ধ নিয়মের অধীনে পরিচালিত হয়। ব্যবহারিক ভাষায় আইনের শাসনের অর্থ, সরকার সব সময় আইন অনুযায়ী কাজ করবে, যার ফলে রাষ্ট্রের যে কোনো নাগরিকের কোনো অধিকার লঙ্ঘিত হলে সে তার প্রতিকারের সুযোগ পাবে। আইনের শাসনের প্রেক্ষাপট জাতিরাষ্ট্র ভেদে অভিন্ন নয়। উদাহরণস্বরূপ ইংল্যান্ডে যেসব সাধারণ নীতির মাধ্যমে আইনের শাসন নিশ্চিত হয়েছে তার অধিকাংশই সেখানকার নাগরিকদের আদালতে উত্থাপিত বিভিন্ন মামলার রায়ের ফল। তাছাড়াও ম্যাগনা কার্টা-১২১৫, দ্য পিটিশন অব রাইটস-১৬২৮ এবং বিল অব রাইটস-১৬৮৯ ইত্যাদি আইন ও বিধি দ্বারা ইংরেজ জাতির স্বাভাবিক অধিকারসমূহ ঘোষিত ও রক্ষিত হয়েছে। ইংরেজদের ঐতিহ্য, রীতিনীতি, ব্যবহারবিধি এবং তাদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের দীর্ঘ ক্রমবিকাশের ধারায় ব্যক্তিগত অধিকার সম্পর্কে ইংরেজদের মধ্যে সচেতনতা প্রোথিত হয়েছে- যা সুশাসন বা আইনের শাসনের মানদন্ড হিসেবেই বিবেচিত। উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে ফৌজদারি দন্ডবিধির ১৪৪ ধারা ও প্রিভেনটিভ ডিটেনশন অ্যাক্টের কারণে আইনের শাসন মোটেই অবারিত হয়নি। আইনের শাসন হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিবিশেষ, যেখানে সরকারের সব কার্যক্রম আইনের অধীনে পরিচালিত হয় এবং যেখানে আইনের স্থান সবকিছুর ঊর্ধ্বে। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার সর্বদা আইন অনুযায়ী কাজ করবে, যার ফলে রাষ্ট্রের যে কোনো নাগরিকের কোনো অধিকার লঙ্ঘিত হলে সে তার প্রতিকার পাবে। মোট কথা, আইনের শাসন তখনই বিদ্যমান থাকে, যখন সরকারি ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের অনুশীলন সাধারণ আদালতের পর্যালোচনাধীন থাকে, যে আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার অধিকার সব নাগরিকের সমান। নাগরিকদের জন্য আইন হতে হবে পরিষ্কার ও জনবান্ধব। মানুষ যাতে সহজে বুঝতে পারে। আইনের আশ্রয় যাতে সবাই সহজে পেতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। আদালতে সবাই বিচার চাইতে পারবে। বিচার বিভাগ থাকবে নির্বাহী বিভাগ বা অন্য যে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক প্রভাব হতে সম্পূর্ণ মুক্ত ও স্বাধীন। রাজনৈতিক কোনো পরিচয়ে নয়, তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়াও নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে হতে হবে। বিচারক হবেন নিরপেক্ষ ও স্বাধীন, তবে স্বেচ্ছাচারী নয়। বিচারক নিরপেক্ষ হয়ে সব পক্ষের কথা শুনবেন, সমান সুযোগ দেবেন। আদালত হবে প্রকাশ্য। প্রশাসনের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে আইনের শাসন থাকা দরকার। তবে ব্রিটিশ শাসনামলের আইন এখনো প্রচলিত আছে- যা সময়োপযোগী নয়, তাই সংস্কার ও কিছু আইন বাতিল করা সময়োপযোগী ও সমীচীন হবে। আইনের মাধ্যমেই স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা ও আধিপত্য রোধ করা যায়। আইন হতে হবে অবশ্যই নিরপেক্ষ। রাষ্ট্রের সংবিধান হচ্ছে একটি রাষ্ট্রের আইনের প্রধানতম উৎস। গোপনে যেনতেনভাবে বিচার করে শাস্তি দেয়া যাবে না কাউকে। ন্যায্যতা ও ন্যায়ের মানদন্ডে বিচারক গঠনমূলক রায় প্রদান করবেন। যে কোনো প্রণীত আইন জনস্বার্থবিরোধী বা কালো আইন হলো কিনা, বিচার বিভাগ বা আইন কমিশন তা খতিয়ে দেখবে, প্রয়োজনে বাতিল করবে। তবেই প্রকৃত আইনের শাসন বাস্তবায়ন হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আইনের শাসনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, আইনের শাসন ছাড়া কোনক্রমেই একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠন সম্ভব হবে না। আসুন আমরা সবাই দেশের সুনাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করি এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে দেশের মানুষকে হয়রানি ও ভোগান্তির জাঁতাকল থেকে মুক্ত করি এবং দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন এই নীতিবাক্যকে ধারণ করে শোষণ ও বৈষম্যহীন একটি সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গঠনে সবাই মনোযোগী ও সচেষ্ট হই। ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও ভিডিপি, কলামিস্ট ও গবেষক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে