বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

অর্থনীতির প্রাণ পোশাক শিল্প অলোক আচার্য

প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকতে একটি শিল্পকে এগিয়ে নিতে সঠিক পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।
  ০৩ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০
অর্থনীতির প্রাণ পোশাক শিল্প অলোক আচার্য
অর্থনীতির প্রাণ পোশাক শিল্প অলোক আচার্য

পোশাক শিল্প আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির অগ্রযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে আশির দশকে যে শিল্প যাত্রা শুরু করে সেই পোশাক শিল্পই আজ আমাদের অর্থনীতির প্রধান নিয়ামক। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে আমরা পেছনে ফেলেছি পোশাক রপ্তানির বড় বড় দেশকে। আজ বাংলাদেশ তৈরি পোশাকের এক অন্যতম দেশ। যাত্রা শুরুর পর থেকে অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েকটি থেকে কয়েক হাজার পোশাক কারখানা হয়েছে। পোশাক শিল্প আমাদের অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার করে দেশকে একটি গতিশীল অর্থনীতির দেশে পরিণত হতে সাহায্য করেছে। আমাদের অর্থনীতিতে সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত তৈরি পোশাক শিল্প। এই খাতে সৃষ্টি হয়েছে বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থান। আর কর্মসংস্থানের একটি বড় অংশই নারী। যা দেশের নারীদের সাবলম্বী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এই নারীদের একটি বড় অংশই অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত। করোনা অতিমারি শুরু হওয়ার পর থেকে অন্যান্য খাতের মতোই পোশাক খাতেও তার আঘাত লাগে। ক্রেতারা অর্ডার বাতিল করতে থাকে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কেউ কেউ কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটতে বাধ্য হয়। করোনা অতিমারিতে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। করোনার দুর্দিন কাটিয়ে এখন সুদিন ফিরতে শুরু করেছে পোশাক শিল্পে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে পোশাক শিল্পকে কেন্দ্র করে দেশের অর্থনীতিতে বেগবানের স্বপ্ন গড়ে উঠছে। আমাদের স্বপ্ন এখন ম্যান মেইড ফাইবারে পোশাক উৎপাদন করে চীনকে পেছনে ফেলা। গত এক দশকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় অর্থনীতির দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের রপ্তানি কমলেও একই সময়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে শতকরা ৮০ শতাংশ। সামনে থাকা গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, প্রধান ক্রেতা দেশগুলোতে বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে এবং এর সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো এবং দক্ষিণ কোরিয়া, ভারতের মতো নতুন দেশের বাজারেও পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮১ শতাংশ পর্যন্ত।

অতিমারি শুরুর পর পোশকা কারখানা সাময়িক বন্ধ, স্থায়ী বন্ধ ও কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো পরিস্থিতির শিকার হওয়ার পর যে আশঙ্কা চেপে বসেছিল তা দূরীভূত হয়েছে। করোনার সেই দিন কাটিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামকে পেছনে ফেলতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। গত বছর বাংলাদেশকে টপকে গিয়েছিল ভিয়েতনাম। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে (জানুয়ারি-জুলাই) যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশ ৩৭০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৮ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ বেশি। চীনের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। বিজিএমইএ জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে ১ হাজার ৮৭৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। আর একই সময়ে ১ হাজার ৬৮৬ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে ভিয়েতনাম। এসব বিবিধ কারণে পোশাক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- যা এখন কাটিয়ে ওঠার প্রাণপণ চেষ্টা করে পোশাক কারখানাগুলো। ক্রেতাদের আস্থা অর্জনের পাশাপাশি প্রতিযোগী দেশের তুলনায় নিজেদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা করছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প পূর্ণ গতিতে চলা আবশ্যক। পোশাক শিল্পের মতো রপ্তানিমুখী একটি শিল্প যা আমাদের দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করেছে, চাকরির বাজারে মহাগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, দেশে এবং দেশের বাইরে বাংলাদেশের পোশাকের একটি অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও জীবনমান উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছে। প্রায় ৪০ লাখের বেশি নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে পোশাক শিল্প। এর মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগই নারী। প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবহেলিত নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

1

বর্তমানে মোট শিল্প খাতে নিয়োজিত শ্রমশক্তির ৩৩ শতাংশ এই খাতে নিয়োজিত। এটি আমাদের অর্থনীতির প্রাণস্বরূপ। করোনায় শিল্প খাত টিকে রাখার স্বার্থে সরকার যে বড় অঙ্কের প্রণোদনা ঘোষণা করে তার শুরু হয়েছিল পোশাক শিল্প দিয়ে। সৃষ্ট সমস্যা মোকাবিলা করে পোশাক কারখানাগুলো ফের ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে আমাদের অর্থনীতিও শক্তিশালী হচ্ছে। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশ থেকে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি বিশেষত পোশাক শিল্প উত্তরণের এই চিত্র দেশের অর্থনীতিকেই পাল্টে দিয়েছে। পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার সংখ্যার দিক থেকেও বিশ্বে শীর্ষে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ পোশাক শিল্পের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় ক্রমেই শক্তিশালী অবস্থানে যাচ্ছে। মুখোমুখি হতে হবে শক্তিশালী দেশগুলোর সঙ্গে। সেসব দিক বিবেচনায় পোশাক শিল্পের বিদ্যমান প্রতিকূলতা অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধি, উৎপাদন খরচ হ্রাস, পণ্য সরবরাহের সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটাতে হবে।

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরো ও বিজিএমইএ সূত্রে জানা যায়, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট মাসের রপ্তানির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ সময় পোশাক বাজারের নতুন দেশগুলোতে তুলনামূলকভাবে প্রবৃদ্ধি বেশি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডবিস্নউটিও) প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড স্ট্যাটিসটিক্যাল রিভিউ-২০২১ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০ সালে ভিয়েতনাম ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। আর বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের পোশাক। অথচ তার আগের বছর বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। তখন ভিয়েতনামের রপ্তানি ছিল ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার; পাশাপাশি বৈশ্বিক বাজারে হিস্যাও কমেছে বাংলাদেশের। ২০১৯ সালে বিশ্বে যত পোশাক রপ্তানি, তার মধ্যে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল বাংলাদেশ। গত বছর সেটি কমে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। পোশাক রপ্তানিতে বড় বাজার অর্থাৎ ৩১ দশমিক ৬ শতাংশ দখলে রেখেছে। ডবিস্নউটিওর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে চীন সবচেয়ে বেশি ১৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। বিজিএমইএর তথ্য মতে, এই শিল্পে এখন তৈরি পোশাকের মোট কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ৩০০টি প্রায়। আরেকটি বড় বিষয় হলো, ১৩৫টি গড়ে ওঠা গ্রিন ফ্যাক্টরির শীর্ষ ১০টির মধ্যে ৭টিই বাংলাদেশের।

প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকতে একটি শিল্পকে এগিয়ে নিতে সঠিক পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। পোশাক শিল্পের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান বিশেষত সুতার মূল্য কম রাখা এবং পোশাক শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে জোর দিতে হবে। তাদের নিরপত্তা এবং সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। পোশাক শিল্পকে এগিয়ে নিতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের উদ্যোগের বাস্তবায়ন করা জরুরি।

\হ

অলোক আচার্য : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে