শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
পাঠক মত

যৌতুক নামক কুপ্রথা বন্ধ হোক

নতুনধারা
  ২৩ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০

যৌতুক প্রথা অতি প্রাচীন একটি কুপ্রথা। তৎকালীন হিন্দু সমাজে কন্যাকে দশ/বারো বছরের মধ্যে বিয়ে দিতে না পারলে পুরুষ নরকবাসী হবেন বলে এক প্রকার অন্ধ বিশ্বাস বা ভয় ছিল। তাই হিন্দু সম্প্রদায়ে মেয়েদের দ্রম্নত বিয়ে দিয়ে দিত। আর হিন্দু সমাজে পিতা ও স্বামীর সম্পদে কনের অধিকার নেই বিধায় বিয়েতে কনেপক্ষ থেকে যৌতুক প্রদান করত। সেখান থেকেই অর্থাৎ সনাতন বা হিন্দু ধর্মের বিধিবিধান থেকেই যৌতুক প্রথার প্রচলন হয়ে পড়ে। কিন্তু যৌতুকের সূচনা হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সূত্রপাত হলেও মুসলিম সমাজের শিরায় শিরায় আজ যৌতুক প্রথা বিরাজ করছে। যৌতুক যেন বর্তমানে একটি অঘোষিত বিধান। যা সংক্রামক রোগের মতো আঁকড়ে ধরছে পুরো সমাজকে। শুধু সমাজ বললে ভুল হবে এখন যৌতুক একটি রাষ্ট্রীয় ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।

আমাদের শরীরে যেমন অসংখ্য রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে তেমনি আমাদের সমাজেও রয়েছে অজস্র রোগের বিস্তার ও বিচরণ। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই যৌতুক রোগ। যা প্রাচীনকালের থেকে বর্তমানে বেশি ভয়াবহ হয়ে পড়ছে। গ্রাম থেকে শহর, নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সবাই এই ব্যাধিতে আক্রান্ত। যৌতুকের কথা চিন্তা করে অনেক পরিবার এখন সন্তান জন্ম দিতেই ভয় পায়। তারা ভাবে যদি মেয়ে সন্তান হয় তাহলে তাকে বড় করতে হবে, লেখা-পড়া শেখাতে হবে এবং বিয়ের সময় যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ বা সমমূল্যের সাংসারিক উপকরণ দিতে হবে। সভ্যতার যুগে এসে যে আমরা কতটা অসভ্য তার বহিঃপ্রকাশ এই যৌতুক। যৌতুকের কারণে প্রতিনিয়ত নারী নির্যাতনের মতো পাশবিক ঘটনা ঘটছে। হত্যা এবং আত্মহত্যার কারণও হচ্ছে যৌতুক। মেয়ের বাড়িতে যৌতুকের টাকা না দিতে পেরে পিতা-মাতার আত্মহত্যা করার ঘটনা কারও অজানা নয়।

বলছি যৌতুক প্রসঙ্গে বরপক্ষের একটা যুক্তি-তর্কের কথা। বরপক্ষের কথা, আমরা একটা মেয়েকে বিয়ের পর বাকি জীবন খাওয়াবো, পরাবো এ ছাড়া আমাদের ছেলেকে বড় করতে, পড়াশোনা করাতে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। তাই আমরা যৌতুক দাবি করতেই পারি। আসলেই কি এটা যুক্তিসঙ্গত? একটা ছেলের পড়াশোনা করাতে টাকা লাগে, বড় করতে টাকা লাগে। একটা মেয়ে কি এসব ছাড়াই বড় হয়?

এই যে দৈনিক খবরের পাতাজুড়ে যৌতুক না পেয়ে বউকে পিটিয়ে হত্যা, যৌতুকের টাকা না আনতে পারায় স্ত্রীকে গলাটিপে খুন, যৌতুকের জন্য মার খেয়ে হসপিটালে ভর্তি রহিমা। এগুলো আর কতদিন চলবে?

এমনও দরিদ্র পরিবারের মেয়ে আছে, তার শ্বশুরবাড়ি থেকে যৌতুকের টাকার জন্য চাপ সৃষ্টি করায় বাবার বাসায় বলতে না পেরে নীরবে প্রাণ বলি দিচ্ছে। যৌতুকের পাটাতলে শুধু যে দরিদ্র পরিবারগুলো পড়ছে তা কিন্তু নয়- এটা শিক্ষিত ধনী শ্রেণির পরিবারগুলোকে পিষছে। তারাও এর ভয়াবহতার শিকার। তাদের মধ্যে যৌতুকের হিসাব হয় প্রাইভেট গাড়ি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, ভরি ভরি স্বর্ণ আর বিশাল অংকের টাকা দিয়ে। অথচ এই যৌতুক নেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। বরং যৌতুক নিয়ে বিয়ে করায় নারীদের সমাজ এবং রাষ্ট্রের চোখে ছোট বলে প্রমাণ করা হচ্ছে। একটা পুরুষ যেমন নিজেকে তৈরি করে, কাজ করে একটা মেয়েও কিন্তু তাই করে। হিসাব করলে দেখা যাবে, একজন পুরুষের চেয়ে একজন নারী বেশি কাজ করে। তারা পরিবারের সবার দেখাশোনা করে, সন্তানের যত্ন নেয়, বাসার সব কাজ করে এমনকি অনেক নারী আছে যারা এসবের পাশাপাশি বিভিন্ন অফিশিয়াল কাজে নিয়োজিত আছে। তবুও তাদের বিয়েতে গুনতে হয় টাকা। এটা কি নারীদের প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে না? আর কতদিন নারীদের প্রতি এই অন্যায় চলবে, তার সঠিক তথ্য কি কেউ দিতে পারবে?

আমরা যদি গত বছরের বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যানুযায়ী দেখি তাহলে দেখা যায়, জানুয়ারিতে যৌতুকের দাবিতে নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৪ জন হত্যা হয়েছে ২ জন। ফেব্রম্নয়ারিতে নির্যাতন হয় ৪ জন হত্যার শিকার ৫ জন। মার্চে নির্যাতন ১১ জন হত্যা ৯ জন। এপ্রিলে নির্যাতনের শিকার ১০ জন মৃতু্য হয় ৬ জনের। এভাবে পর্যায়ক্রমে নির্যাতনের শিকার ও হত্যার সংখ্যা বেড়ে সেপ্টেম্বরে ১৬ জন নির্যাতিতা এবং ৫ জন হত্যার শিকার হয়। এভাবেই যৌতুকের জন্য নারী নির্যাতন আর হত্যার সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। অথচ নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আমাদের দেশে আইনি ব্যবস্থা আছে, শুধু দেখা যায় না আইনি ব্যবস্থার নজির।

১৯৮০ সালে যৌতুক নিষিদ্ধ করে আইন পাস।

এরপর দুই দফায় সংশোধন করে যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ নামে নতুন আইন পাস করা হয়।

যেখানে যৌতুকের দাবি করা হলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত শাস্তির ব্যবস্থা অথবা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করা হবে বলে আইন পাস হয়। কিন্তু এই আইনের কোনো ফলাফল আজ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না, যদি যেত তাহলে এভাবে যৌতুকের কারণে নির্যাতন কিংবা হত্যার ঘটনাগুলো ঘটত না। আর এভাবে এই ঘটনাগুলো বাড়তে থাকত না। তাই বলতে হচ্ছে আইনের জোরালো পদক্ষেপ বহাল করা হোক। দরকার হলে আরও কঠোর আইন পাস করা হোক। আইনের ঊর্ধ্বে তো আর কিছু হতে পারে না। সেই সঙ্গে যৌতুককে না বলে সভা, সেমিনার, মিটিং, মিছিলের আয়োজন করা হোক। সবাইকে যৌতুকের বিরুদ্ধে কথা বলার আহ্বান করা হোক। যৌতুক দাবি করা যে একটি অপরাধ সেই সম্পর্কে বর-কনে উভয় পক্ষকে সচেতন হতে হবে। যৌতুক দেওয়া-নেওয়া উভয় পক্ষের কঠোর শাস্তি প্রদান করা হোক। যৌতুক বরপক্ষের প্রাপ্য হতে পারে না।

লাইজু আক্তার

শিক্ষার্থী

নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে