আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে ন্যায়-বিচার নিশ্চিত করবে রাষ্ট্র। নাগরিকের জান-মাল রক্ষা ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিতেরও দায়িত্ব রাষ্ট্রের। বিচারপ্রার্থীদের ন্যায়-বিচার প্রাপ্তিটা একটা সাংবিধানিক অধিকার; আর এ অধিকার কোনোভাবেই খর্ব হতে পারে না। ন্যায়-বিচার প্রাপ্তি একজন নাগরিকের কোনো দয়া নয়; বরং আইনগত অধিকার বটে। রাষ্ট্রের চারটি গুরুত্বপূর্ণ অর্গানের মধ্য অন্যতম হলো বিচার বিভাগ। এই বিচার বিভাগের মাধ্যমেই বিচারিক সেবা দান করা হয় নাগরিকদের।
আমাদের বাংলাদেশ সংবিধান বলা আছে, 'আইনের কাছে সমান আশ্রয় লাভের অধিকার শুধু অধিকারই নয়, মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত'।
মৌলিক অধিকার হচ্ছে এমন অধিকার যা রাষ্ট্র তার নাগরিকদের প্রদান করতে আইনত বাধ্য। অর্থাৎ রাষ্ট্র নাগরিকদের এসব মৌলিক অধিকার বলবৎ করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। তবে আইনের আশ্রয় লাভের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কিছু শর্ত ও পদ্ধতি আরোপ করেছে। সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে কিছু শর্ত ও পদ্ধতির কথা বলা আছে যা পূরণ সাপেক্ষে মৌলিক অধিকার তথা আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার প্রয়োগ করা যায়। বিদ্যমান এ অধিকার বিচার বিভাগ আদালতের মাধ্যমেই মানুষের এ অধিকার প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠা করার বিধান আছে।
আইনের কাছে আশ্রয় লাভের বিষয়টি স্পষ্ট করেছে বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদ। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহারলাভ যে কোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ছাড়া এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।"
তাই সংবিধান অনুযায়ীই বাংলাদেশের সব নাগরিক ও দেশে অবস্থানরত অন্যান্য দেশের নাগরিকরাও তাদের জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম ও সম্পত্তির অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী। রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য সৃষ্টি করেনি। সব নাগরিকই রাষ্ট্র কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আদালতে ন্যায়-বিচার পাওয়ার অধিকারী। তবে রাষ্ট্র যে শর্তহীনভাবে নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তা ২৭ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট। ২৭ অনুচ্ছেদ নাগরিকের আইনের অধিকার লাভের মৌলিক অনুচ্ছেদ, যেখানে বলা হয়েছে, "সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।'
বর্তমানে আইনের সুনিশ্চিত শাসন প্রতিষ্ঠায় নানান প্রকার প্রতিবন্ধকতা বিরাজমান রয়েছে। ব্রিটিশ আইন দ্বারা এখনো বিচারকার্য পরিচালনা চলছে। তৎকালীন সামাজিক অবস্থা ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ব্রিটিশ আইনগুলো তৈরি হয়েছিল। বর্তমান অবস্থাধীনে সামাজিক সমস্যা, অপরাধপ্রবণতার ধরন অনেকাংশে পরিবর্তন হয়েছে। সেই সনাতন আইনের প্রয়োগ ও বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এখনো বিচারপ্রার্থীদের বিচারিক সেবা দান করা হয়। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ স্বাধীন হলেও বিচারিক কাজে ব্রিটিশ আইনের প্রক্রিয়া প্রয়োগ হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ সংবিধানের ১১৬ক অনুচ্ছেদে বিচার বিভাগীয় কর্মচারীদের স্বাধীনতা সম্পর্কে বলা আছে। এমনটা বলা আছে' এই সংবিধানের বিধিবিধান সাপেক্ষে কর্মবিভাগের নিযুক্ত ব্যক্তি ও ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন'। এ স্বাধীনতা দলীয় প্রভাবে কতটা রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত তা অনেকের মনে এখনো প্রশ্নবিদ্ধ।
আইনের শাসন পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা দি ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (ডবিস্নইউজেপি)-এর রুল অব ল ইনডেক্স ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে সর্বশেষ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন, সে প্রতিবেদনে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের ১১৩ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০২তম স্থানে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। (সূত্র : প্রথম আলো, ১ ফেব্রম্নয়ারি, ২০১৮)।
একটি মামলা নিষ্পত্তিতে মামলার বিচার সংশ্লিষ্টদের নানান প্রকার গাফিলতি, অবহেলা ও অনিয়মের ফলে একজন বিচারপ্রার্থীর হয়রানির শিকার হতে হয়। বিচারপ্রার্থীরা আর কতদিন বিচারের বাণী শুনে চলবে। যেহেতু বিচারপ্রার্থীদের শেষ আশ্রয়স্থল হলো আদালত। আর সেখানেও যদি কোনো কারণে হয়রানি বা ন্যায়-বিচারে ব্যাহত হতে হয় তাহলে তাদের আর যাওয়ার জায়গা থাকে না। আদালতপাড়ায় একটা কথা অহরহ শোনা যায় 'কোর্টের লাল ইটেও টাকা খায়'। এটার বিশ্লেষণে এতটুকু বোঝা যায় যে টাকা ছাড়া বিচারিক সেবা পাওয়া দুরূহ। আসলে এটাও সত্য, বিচারপ্রার্থীদের বিচার পেতে মামলা চালাতে গেলে মামলায় সরকারি কোর্ট ফিস, সরকারি ডেমি, ওকালতনামা কেনা, নিযুক্তীয় আইনজীবীকে ফিসহ আনুষঙ্গিক খরচ বহন তো করতে হবে। বিচারপ্রার্থীরা অনেকেই আদালত আঙিনার বাইরে আইনজীবী ছাড়া টাউট, দালালের খপ্পরে পড়ে মামলার ব্যয়ভার বহনে আর্থিকভাবে অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আর এ ক্ষতিতে তারা অনেকে হয়তোবা গ্রামে গিয়ে বলে 'কোর্টের লাল ইটেও টাকা খায়'।
বর্তমানে যে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সে হারে মামলার বিচার করার জন্য বিচারক সংকুলান নেই। সনাতন স্টাফ প্যাটার্ন দিয়েই চলে অধিকাংশ দপ্তর। মামলা বাড়লেও, বাড়েনি কর্মচারীর সংখ্যা। অনেক আদালত দীর্ঘদিন ধরে বিচারক শূন্য থাকে। অনেক বিচার আদালতের কর্মচারী সংকট। অনেক দপ্তরে প্রেষণে একজনে আরেকজনেরও দায়িত্ব পালন করে। এতে বিচারপ্রার্থীদের বিচারিক সেবা পেতে পড়তে হয় ভোগান্তিতে। ধরে নিই একটা দেওয়ানি মামলার প্রথম ধাপ হলো প্রতিপক্ষের প্রতি সমন জারি।
আর এ সমন জারি করবে কোর্টের জারিকারক। এখানে একটা বিষয় পরিলক্ষিত যে, এই জারিকারক প্রতিপক্ষের ঠিকানায় যায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে। এ সমন জারিতে জারিকারকের নেই কোনো সরকারি টিএ/ডিএ বিলের ব্যবস্থা। ফলে অনেকেই হয়তোবা অসাধুভাবে এই টিএ/ডিএ বিলটা বাদীর কাছ থেকে নেওয়ার চেষ্টা করে। বাদী কিছু খরচাপাতি দিলে সমন জারি হয় নয়তো বা কলমের মার-প্যাঁচে সমন জারিতে বিলম্বিত হয়, এমনটাও ঘটে। এ কারণেও অনেকাংশে মামলার সমন জারিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়; চলতে থাকে দীর্ঘদিন ধরে মামলা। একটি মামলা নিষ্পত্তিতে বড় অংশ হলো মামলাটিতে সাক্ষ্য গ্রহণ। সাক্ষ্য আইনের ১০১ ধারায় বলা আছে সাক্ষ্যের মাধ্যমে মামলা প্রমাণের দায়িত্ব বিচারপ্রার্থীর। ধরে নেওয়া যাক, একটি হত্যা মামলার সাক্ষী দিতে বাদীকে প্রসিকিউশন পক্ষ প্রসেসে ডেকেছে। কিন্তু অনেক বাদী সাক্ষী দিতে নারাজ। কিন্তু কেন? তারা কি হত্যার বিচার চায় না? নিশ্চয়ই চায়। হয়তোবা গভীরে খোঁজখবর নিয়ে দেখা যায়, বাদী-আসামিদের দ্বারা ভয়-ভীতি, হুমকির শিকারে সাক্ষ্য দিতে বিলম্ব করছে। এভাবেও মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্বিত হচ্ছে।
এ ছাড়া মামলা নিষ্পত্তিতে আরও প্রতিবন্ধকতা হলো-অনেক বিচারকের মামলা নিষ্পত্তিতে প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব, আইনজীবীর মামলা নিষ্পত্তিতে স্বদিচ্ছার অভাব, বিচারঙ্গনে দুর্নীতি, ঘুষ, অনিয়ম, মামলা জটসহ নানান প্রতিবন্ধকতা।
জাতীয় দৈনিক 'আমার সংবাদ' পত্রিকায় ২৯ নভেম্বর, ২০২১ তারিখে 'মামলার ব্যয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন বিচারপ্রার্থীরা, বকশিশ ছাড়া নথি নড়ে না' এই শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে এমনটিও বলা হয়- 'থানায় মামলা হওয়ার পরই এজাহার পাঠিয়ে দেওয়া হয় আদালতে। আসামি গ্রেপ্তার হলে পুলিশ প্রতিবেদনসহ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। শুরু হয় আইনি লড়াই। এখানে থেকে শুরু হয় ঘাটে ঘাটে টাকা দেওয়ার খেলাও। চলতে থাকে বছরের পর বছর ধরে। মূলত মামলার নথি দেখা, হাজিরা দেওয়া, ওকালতনামায় সই করা, জামিননামা দেওয়া, মামলা লিস্টে আনা, শুনানির সিরিয়াল এগিয়ে আনা, জামিনের শুনানি করা, মামলার নকল তোলাসহ মামলাসংক্রান্ত যে কোনো সেবায় বকশিশ বা খরচাপাতি ছাড়া এখন চলেই না'।
আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সোনার বাংলা গড়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বর্তমান সরকার। সে মোতাবেক বিভিন্ন পদক্ষেপে এগিয়ে চলছে কার্যক্রম। সম্প্রতি বিভাগ অনুসারে মামলা নিষ্পত্তির ব্যাপারে মনিটরিং সেল গঠন করেছে সরকার। মামলা নিষ্পত্তিতে নতুন ট্রাইবু্যনালসহ বিচারপ্রার্থীদের সুবিধার্থে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে চলছে বিচারিক কার্যক্রম। বিচারপ্রার্থীদের যেহেতু শেষ আশ্রয় হলো আদালত, সেহেতু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচারিক সেবাসংক্রান্ত সরকারি উদ্যোগগুলোকে আরও ত্বরান্বিত করতে হবে। বিচারঙ্গনে উদ্ভুত সমস্যাগুলো নিরসনে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি জনগণকেও সচেতন হতে হবে। বিচারের বাণী যেন নিভৃতে না কাঁদে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। মামলা নিষ্পত্তিতে বিচারক, আইনজীবীসহ বিচার সংশ্লিষ্টদের স্বদিচ্ছা বাড়াতে হবে; নিশ্চিত করতে হবে আইনের সুশাসন।
অ্যাডভোকেট মো. রায়হান আলী
আইনজীবী ও কলামিস্ট, জজ কোর্ট খুলনা