শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আমার শিক্ষার্থী উপবৃত্তি কেন পায় না

সাড়ে চার লাখ শিক্ষক। এক লাখ শিক্ষকও যদি জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে, উপবৃত্তির ক্ষেত্রে নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে তাদের নিজ নিজ আইডি থেকে লিখে যান তাহলে সমস্যাটা অন্তত দৃষ্টিগোচর হতো।
শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
  ২৪ মে ২০২২, ০০:০০

আজ আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দশম গ্রেড নিয়ে কথা বলতে চাই না। কেন একজন ঝাড়ুদারের সমতুল্য বেতন একজন শিক্ষকের সে প্রশ্নও তুলব না। কেন আমার চেয়ে কম শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও অন্যরা দশম গ্রেডের কর্মকর্তা আর আমি তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী, সে প্রশ্নটা করতেও আসিনি।

আজ বিনীত ভাবে নয়, কঠোরভাবে জবাব চাই। কারণ, বিগত বছরগুলোতে ইনিয়ে-বিনিয়ে, সবিনয়ে প্রার্থনা করে, বিনয়ের সঙ্গে বহুবার বলেছি উপবৃত্তির টাকা সব শিশুরা পাচ্ছে না। কেন পাচ্ছে না। কী করলে পাবে সে বিষয়েও কোনো জবাবদিহি বা নির্দেশনা নেই।

কোনো সমস্যা থাকলে তা পরবর্তীতে সমাধানের চেষ্টা করা হয় কিন্তু এই উপবৃত্তি প্রতি বছর জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। একটা সার্ভার তৈরি করা হয়েছে যা পিঁপড়ার চেয়েও ধীরগতিতে কাজ করে। প্রথমে শিওর ক্যাশ, তারপর নগদে টাকা দেওয়া হলো। লাখ লাখ টাকা নগদ থেকে উধাও হয়ে গেল।

বিদ্যালয় থেকে নামের তালিকা দেওয়া হলো। শিক্ষকরা সারা দিন-রাত ল্যাপটপের কাছে বসে থাকলেন। রাতের ঘুম হারাম করে নামের তালিকা পাঠালেন। একটা শিক্ষার্থীও যাতে বাদ না পড়ে সে জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করলেন। ফলাফল কী হলো? কেউ প্রাপ্য টাকার দ্বিগুণ পেল। আবার কেউ মোটেও পেল না। কেন পেল না তাও জানার কোনো উপায় নেই। কী করলে পাবে সে ব্যাপারেও কোনো সঠিক নির্দেশনা নেই। শুকনো মুখে শিশুরা জানতে চায় অমুকে টাকা পেল আমি কেন পেলাম না? কোনো উত্তর দিতে পারি না।

রাস্তায় অভিভাবকরা শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, সব টাকা মাস্টাররা মেরে দিয়েছে। মাথা নিচু করে হেঁটে যাই। তর্কে জড়াই না। এভাবে আর কতদিন?

চোর সৃষ্টি বন্ধ না করে চোর ধরায় মেধা নিয়োগ করেছে দেশ। ফলে যে কাজটা সহজ হওয়ার কথা ছিল তা দিন দিন জটিল হচ্ছে। অসংখ্য তথ্য চাওয়া হচ্ছে এবার।

একে খারাপ সার্ভার। আবার বিশাল তথ্য। শিক্ষকদের সারাদিন চলে যাচ্ছে এ কাজে। জন্ম নিবন্ধনের জটিলতায় এবার তিন ভাগের এক ভাগ শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পাবে। অনেক জন্ম নিবন্ধন অনলাইন হয়নি। মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিয়ে অন লাইনে নিতে হচ্ছে জন্ম নিবন্ধন। শুধু টাকাই যে যাচ্ছে তা নয়। নানামুখী হয়রানির স্বীকার হতে হচ্ছে এই জন্ম নিবন্ধন নিয়ে। মানুষের এসব ভোগান্তি বলার কোনো জায়গা নেই।

জন্ম নিবন্ধন অটো অন লাইন যদি না হবে তাহলে দেশ ডিজিটাল হলো কীভাবে? একই কাজের জন্য মানুষ কতবার বৈধ, অবৈধ টাকা গুনবে?

যে সব জন্ম নিবন্ধন অন লাইনে পাওয়া গেছে তার মধ্যে অনেক ইংরেজি থেকে বাংলা করার নমুনা দেখলে মনে হবে চীন দেশ থেকে চীনা ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। হাজারটা ভুলের ছড়াছড়ি।

হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হওয়া দেশে একশত টাকা অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হলেও এই টাকাটা একটা পরিবারের কাছে কতটা গুরুত্ব বহন করে তা বিশাল বিলাসবহুল অট্টালিকায় বসবাসরত মানুষকে বুঝানো সম্ভব নয়।

দরিদ্র মানুষের সংজ্ঞা, দরিদ্রদের জীবন সম্পর্কে ধারণা নেওয়ার জন্য আমেরিকা ভ্রমণের প্রয়োজন নেই। রাজধানীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে যে সব শিশু আসে তাদের বিচিত্র জীবন সম্পর্কে ধারণা নিলেই বোঝা যাবে। জন্ম নিবন্ধন, আইডি কার্ডের ঝামেলা নিয়ে দরিদ্র, লেখাপড়া না জানা অভিভাবকরা ঘুরছে অসহায় অবস্থায়।

কাজ দিন দিন সহজ হওয়ার কথা অথচ যতদিন যাচ্ছে কাজ জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে দালাল। কাজ এক হাত থেকে অন্য হাতে ঘুরছে। বাড়ছে টাকার পরিমাণ। সঙ্গে ভোগান্তি ফ্রি।

উপবৃত্তির সুবিধাভোগীরা অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ। নিন্দুকরা হয়তো বলবেন, এ টাকা তো রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের টাকা সৃজনশীল চিন্তা নিয়ে সাধারণ জনগণের মধ্যে বিতরণ করার যে মননশীল ভাবনা তা সবাই ভাবার ক্ষমতা রাখে না।

লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করে অন্যরকম এক আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আশীর্বাদে সিক্ত হওয়ার কথা ছিল কিন্তু যাদের অবহেলা বা অযোগ্যতার কারণে বঞ্চিতদের দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয় পরিবেশ তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা অবশ্যই কর্তব্য।

আমাদের মিডিয়া ফলাও করে কোনো কিছু প্রচার না করা পর্যন্ত প্রশাসন বা সমাজের বোধদয় হয় না। অনেক ক্ষেত্রে মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনেক খবর পৌঁছে যায় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত।

বর্তমানে মিডিয়া পরীমনির পেটের দৈর্ঘ্য, জয়ার সৌন্দর্যের রহস্য, শ্রাবন্তীর নতুন বিয়ে এ সব নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে। দরিদ্র, অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সামান্য কিছু টাকা কোথায় যাচ্ছে, জন্ম নিবন্ধন, আইডি কার্ডের ভুল এ সব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ভাবার সময় কোথায় মিডিয়ার।

যদি শিক্ষকদের পকেটে যেত এই টাকা তাহলেও হয়তো নিউজ হতো। কিন্তু নগদের অ্যাকাউন্ট থেকে গত বছর যে টাকা লোপাট হলো তার হিসাব পাওয়া তুচ্ছ শিক্ষকের সাধ্য নয়।

মিডিয়ার ভূমিকা আশা করা বৃথা। বাকি রইল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে অনেক বিষয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ফলে সমাধানও হয়েছে। যেমন- একজন নারীর পুলিশে চাকরি পাওয়া, স্বাধীনতা পুরস্কার বাদ হওয়া, রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর আদেশ অমান্য করে টিটির চাকরি সসম্মানে ফিরে পাওয়া।

সাড়ে চার লাখ শিক্ষক। এক লাখ শিক্ষকও যদি জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে, উপবৃত্তির ক্ষেত্রে নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে তাদের নিজ নিজ আইডি থেকে লিখে যান তাহলে সমস্যাটা অন্তত দৃষ্টিগোচর হতো।

আমাদের সমস্যাগুলো বছরের পর বছর চলতেই থাকে। সমাধানের পথ আমাদেরই তৈরি করতে হবে। শিক্ষক সংগঠন কয়েক ডজন। এদের কক্সবাজার, বান্দরবান ঘোরাঘুরির ছবি, ভালো ভালো খাবারের ছবি দেখে দেখে আমরা মুগ্ধ। এ সব সংগঠনের নেতাদের টক শোতে আলোচনা শুনে আমরা কৃতজ্ঞ।

এ পর্যন্ত শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো কাজে কোন সংগঠন কী ভূমিকা রেখেছে তা আমার মতো সামান্য শিক্ষকের বোধগম্য নয়। কাগজপত্রের নানা জটিলতার কারণে তিন ভাগের একভাগ শিক্ষার্থীর নাম উপবৃত্তির তালিকায় এন্ট্রি করা সম্ভব হচ্ছে। বাকিদের সমস্যার সমাধান কী তা জানা আমার আর আমার শিক্ষার্থীদের নাগরিক অধিকার।

প্রধানমন্ত্রীর এই মহতী উদ্যোগের সফল বাস্তবায়নের জন্য স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার ভিত্তিতে সব সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। অভিভাবক এবং শিক্ষকদের নানামুখী হয়রানি বন্ধ করাও জরুরি।

\হ

শাকিলা নাছরিন পাপিয়া : কবি কথাসাহিত্যিক শিক্ষক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে