যেমনটা ভাবা হয়েছিল ইসরাইলে শেষ পর্যন্ত তাই ঘটলো। আল জাজিরার সাংবাদিক, সেখানকার পরিচিত মুখ শিরিন আবু আকলেহ ইসরাইলি সেনাদের গুলিতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকার পর মনে হচ্ছিল জোড়াতালির ইসরাইলি সরকারও সেভাবে পড়ল বলে। প্রথমত, এই সাংবাদিকসহ ইসরাইলি সেনাদের আল আকসা মসজিদ ও আশপাশের এলাকায় অত্যন্ত চরম ব্যবস্থা নেয়ার পর জোট সরকারের সঙ্গে থাকা আরব এমপিরা সমর্থন প্রত্যাহারের হুমকি দেন। আবর লিস্ট নামের এই সংসদীয় গ্রম্নপটি মন্দের ভালো হিসেবে নেতানিয়াহুকে বর্জন করে ইয়াইর লাপিদ ও নাফতালি বেনেটের নেতৃতাধীন জোটকে বেছে নিয়েছিলেন। এটা তারা করেছিলেন অনুন্নত মুসলিম বসতিতে বাতি জ্বালানো ড্রেন সাফ রাখা সড়ক মেরামত করা হবে এ আশায়। সেটা কতখানি হয়েছে তা তেমন একটা জানা যায় না, আসলে হওয়ার কথাও নয়। কেবলি ভোট বাগানোর কায়দা ছিল সেটা।
এখনকার তাজা খবর হচ্ছে জোট সরকারের পতনের পর জোটের শরিক দলের আরেক নেতা ইয়াইর লাপিদ ইসরাইলের নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। লাপিদের কোয়ালিশন সরকারের অর্ধেক মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিষয়ে চুক্তি ছিল। বৃহস্পতিবার তিনি জোট নেতা নাফতালি বেনেটের কাছ থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। লাপিদের নেতৃত্বেই ইসরাইলে ১ নভেম্বর নির্বাচন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি আগের চুক্তি মতো খুব বেশি সময় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না।
ইসরাইলের কোয়ালিশন সরকারের পতনের প্রেক্ষাপটে নতুন নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয়। এটি হবে চার বছরেরও কম সময়ের মধ্যে পঞ্চম নির্বাচন। বিশ্লেষকদের ধারণা নির্বাচনে লাপিদ ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর। নেতানিয়াহু প্রত্যাবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন। জরিপে দেখা যায় যে, তার দলই পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। কিন্তু সরকার গঠনের মতো সমর্থন পাবেন না বলেই মনে হচ্ছে। ফলে ইসরাইলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থেকে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ইসরাইলের নতুন প্রধানমন্ত্রী লাপিদ ইতোপূর্বে বলেছিলেন যে, তিনি ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংঘাত নিরসনে দুই রাষ্ট্র সমাধান প্রস্তাবের প্রতি প্রতিশ্রম্নতিশীল, কিন্তু তিনি অন্তর্বর্তী নেতা হিসেবে নতুন কোনো সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
এর আগে কি ঘটেছিল? সাংবাদিক শিরিন হত্যার ঘটনা বিশ্বকে নাড়া দেয়, ইসরাইলের আসল চেহারা আবার সবার কাছে খুলে দেয়। এ নিয়ে সরকারের ভেতরে বিরোধ দেখা দেয়। এক সময় তা প্রকট আকার নেয়। এরপর ইসরাইলের সংসদ (নেসেট) ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দেশটির শাসক জোট। ২০ জুন দেওয়া এ ঘোষণা অনুযায়ী ইসরাইলের সরকার ভেঙে গেছে এবং তিন বছরের মধ্যে পঞ্চমবারের মতো নির্বাচনের আয়োজন করতে হচ্ছে দেশটিতে।
আগের খবরে জেরুজালেম পোস্ট অনলাইন জানিয়েছিল, পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। বেনেট স্বীকার করেছেন তিনি ব্যর্থ হয়েছেন- তবে ইসরাইলকে বাঁচাতে তিনি সবকিছু করতে রাজি। ২৬ জুন রাজনৈতিক বিশ্লেষক হার্ব কেইনন লিখেছেন: ইসরাইলি নির্বাচনে তিনি টানেলের শেষে কোনো আলো দেখতে পাচ্ছেন না। তার মতে এ দিন নির্বাচন হলে দুই বিরোধী শিবির ৫৯: ৬০ আসন পাবে। মানে এক আসনের রেজর থিন মেজরিটি নিয়ে সরকারের অনিশ্চয়তা আগামীতেও চলতেই থাকবে। এদিকে ফিলিস্তনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস বলেছে, এভাবে চলতে চলতে ইসরাইল নিজেরাই ধংস হয়ে যাবে।
নাফতালি বেনেট বলেছেন, তিনি দেশকে আরো ভালোভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কেয়ারটেকার প্রধানমন্ত্রী ইয়াইর লাপিদের কাছে দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত তাই হলো। এক বছর আগে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু কিন্তু বসে ছিলেন না। জোট সরকারকে বিপদে ফেলার সব আয়োজনই তার করা। আর বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে মিস্টার লাপিদকে এখন নেতানিয়াহুর এসব কাজের মোকাবিলা করতে হবে। নির্বাচন না করে বিচার ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে নেতানিয়াহু ক্ষমতায় বসতে চাইছিলেন, সেটা কাজে দেয়নি। 'ইসরাইল ইলেকশন : নো লাইট অ্যাট দি অ্যান্ড অব দি পলিটিক্যাল টানেল' শীর্ষক এনালাইসিসে এ সব কথা লিখেছেন হার্ব কেইনান। তিনি বলেছেন, গত বছর আমরা যদি কোনো শিক্ষা পেয়ে থাকি তা হচ্ছে দেশ এ ধরনের একটি ন্যারো মেজরিটি দিয়ে চলতে পারে না। আগামী নির্বাচন নিয়েও তিনি তাই রাজনৈতিক টানেলে কোনো আলো দেখতে পাচ্ছেন না। কেন এটি ঘটছে এবং এর পরে কী হবে তা নিয়ে এখন চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। কারণ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইসরাইলের বড় প্রভাব রয়েছে।
ফের ইসরাইলি সরকারের পতন কেন হলো? ডানপন্থি, মধ্যপন্থি এবং ইসরাইলের ফিলিস্তিনি নাগরিকদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি দলসহ ৮টি দলের সমন্বয়ে মাত্র এক বছর আগে গঠন হয় নতুন ইসরাইলি সরকার। তবে কার্যভার নেওয়ার পর থেকেই দৃশ্যমান ছিল এই জোট সরকারের নড়বড়ে অবস্থান। দুই বছরের রাজনৈতিক অচলাবস্থার পর ২০২১ সালের জুন মাসে নতুন জোট গঠন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট এবং তার জোটের অংশীদার ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়ার লাপিদ। দেশটির সংসদের বিরোধীদলগুলোর এ জোট সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর রেকর্ড ১২ বছরের শাসনের অবসান ঘটায়। কিন্তু ক্ষমতায় আসার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে বেনেটের নেতৃত্বাধীন এই জোট সরকারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। কারণ দু'দল ছিল দুই মেরুর। সরকার পতন নিয়ে শুরু হয় নানা জল্পনা-কল্পনা। অবশেষে সোমবার পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে সেসব জল্পনার অবসান হলো। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বিরোধিতাই ঐক্যবদ্ধ করেছিল বিরোধীদের। কিন্তু এটি শেষ পর্যন্ত তাদের একসঙ্গে থাকা এবং সরকার পরিচালনার জন্য যথেষ্ট ছিল না।
কীভাবে খাদের কিনারায় জোট সরকার? বিশ্লেষকরা বলছেন, পার্লামেন্টে যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকার পাশাপাশি ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত, ইসরাইলের পশ্চিম তীরে দখলদারিত্ব এবং ধর্ম ও রাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়গুলোর মতো প্রধান নীতিগত ইসু্যতে বিভাজন থেকেই দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে জোট সরকারের দলগুলোর মধ্যে। এর মধ্যেই মুষ্টিমেয় সদস্যরা দলত্যাগ করলে ভাঙনের মুখে পড়ে জোটটি। গত এপ্রিলে বেনেটের ডানপন্থি ইয়ামিনা পার্টির সদস্য ইডিত সিলম্যান পদত্যাগ করলে জোটটি ইসরাইলের ১২০ আসনের সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়।
সম্প্রতি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে মৌলিক কিছু আইন পাসেও ব্যর্থ হন ইসরাইলের ক্ষমতাসীনরা। মূলত এ কারণেই পতনের মুখে চলে যায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াইর লাপিদের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। অধিকৃত পশ্চিম তীরে বসবাসকারী ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের কাছে ইসরাইলি আইন সম্প্রসারণের প্রস্তাব তুলেছিল বেনেট সরকার। কিন্তু তা বাতিল হয়ে গেলে ইসরাইলি পার্লামেন্টে আরও একটি পরাজয়ের সাক্ষী হয় আটদলীয় জোট সরকার। শেষ পর্যন্ত গভর্নিং কোয়ালিশন অর্থাৎ জোট সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্বগুলো খুব অপ্রতিরোধ্য বলেই প্রমাণিত হয়েছে। আর সংসদে সরকারের নড়বড়ে অবস্থানের সুযোগ নিয়েছে জোটটিকে টেনে নামাতে বদ্ধপরিকর বিরোধী দল।
এরপর কী? দফায় দফায় নির্বাচন নিয়ে ইসরাইলের জনগণ অনেকটা ক্লান্তই বলা যায়। ফলে বছর শেষের আগে আবারও নির্বাচন, বিষয়টি নিয়ে তাদের আরও বেশি উদাসীনতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। আর নতুন ভোটে নেতানিয়াহুর ক্ষমতায় ফেরার মঞ্চ তৈরি করতে পারে বলেও গুঞ্জন রয়েছে।
ফিলিস্তিনের ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের মুখপাত্র ফাওজি বারহুম বলেছেন, নাফতালি বেনেটের সরকারের পতন দখলদার ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ কাঠামোর দুর্বলতার প্রতীক। তিনি আরও বলেছেন, এই ঘটনা ফিলিস্তিনি জাতির প্রতিরোধ সংগ্রামের দৃঢ়তার বহিঃপ্রকাশ। ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের মুখে ইসরাইলিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। ইসরাইলের চ্যানেল-টুয়েলভের বিশ্লেষক অমনুন আব্রামুভিচ বলেছেন, বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতিতে ইসরাইল কার্যত নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে এগোচ্ছে। ২০২১ সালের জুন মাসে ইসরাইলে সর্বশেষ আট দলীয় জোট সরকার গঠিত হয়। এই জোটে নাফতালি বেনেটের উগ্র ডানপন্থি দল যেমন ছিল, তেমনি ছিল লাপিদের মধ্যপন্থি ইয়েশ আতিদ পার্টি। তাদের সঙ্গে সরকারের যোগ দিয়েছিল আরব ইসলামী পার্টি।
\হমূলত দীর্ঘ সময়ের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ঠেকাতে তারা এই জোট গঠন করেন। গত প্রায় দুই মাস যাবৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াই সরকার চালিয়ে আসছিলেন নাফতালি বেনেট। আগামী নির্বাচনে কী হয় সেটাই এখন দেখার বিষয়।
আহমদ মতিউর রহমান : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক