তীক্ষ্ন দৃষ্টিধারী বড় ডানাওয়ালা এক বৃহদাকার পাখি শকুন। পরিবেশের বন্ধু এক সময়কার অতিপরিচিত এই পাখিটি আজ বিলুপ্তপ্রায়। আগে গ্রাম-গঞ্জে ও শহরের আনাচে-কানাচে প্রায় সর্বত্রই পাখিটির দেখা মিললেও এখন আর দেখা যায় না বললেই চলে। প্রকৃতির 'পরিচ্ছন্নতাকর্মী' বা 'ঝাড়ুদার' নামে খ্যাত পাখিটি বাংলাদেশ তো বটেই পৃথিবী থেকেই বিলুপ্তপ্রায়। এটি দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি থেকে। অথচ প্রকৃতি রক্ষায় এবং পরিবেশের পরিচ্ছন্নতার জন্য পাখিটির গুরুত্ব অপরিসীম। মৃত জীবজন্তুর মাংস খেয়ে এরা পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখতে যেমন সাহায্য করে, তেমনি প্রতিরোধ করে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ। শকুন কমে যাওয়ার কারণে তাই জলাতঙ্কসহ এসব রোগের জীবাণু মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা এবং ঝুঁকি বেড়েছে। শকুনের অবর্তমানে গবাদিপশুর মৃতদেহ এখন শিয়াল, কুকুর, ইঁদুর, কাক, চিলসহ অন্যান্য প্রাণীর খাদ্যে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এদের পেটে রোগ-জীবাণু নষ্ট না হওয়ায় জঙ্গল ও জনপদে ছড়িয়ে পড়ছে এসব মারাত্মক ব্যাধি।
বাংলার আকাশে একসময় প্রচুর শকুন দেখা যেত। আকাশে বিশাল ডানা মেলে শকুনের উড়ে চলা উপভোগ করত অনেকে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় শকুনের সেই ডানা মেলে উড়ে আকাশ পরিভ্রমণের দৃশ্য এখন দেখা মেলা ভার। কোনোমতে টিকে থাকা এই পাখিটি এত দ্রম্নত বিলুপ্ত হয়েছে, যা অন্য কোনো প্রাণীর ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। প্রকৃতি সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা 'ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার' (আইইউসিএন) ইতোমধ্যেই পাখিটিকে তাদের লাল তালিকাভুক্ত করেছে। সাধারণত কোনো প্রাণীর মোট সংখ্যার ৯০ শতাংশ বিলুপ্ত হলে সেটিকে তারা 'রেড লিস্ট' বা লাল তালিকার অন্তর্ভুক্ত করে থাকে।
পৃথিবীতে শকুনের ইতিহাসও অতি প্রাচীন। প্রায় ২৬ লাখ বছর ধরে শকুনের অস্তিত্ব বিদ্যমান। শকুনের প্রজাতিতেও আছে বৈচিত্র্য। পৃথিবীজুড়ে ১৮ প্রজাতির শকুনের বিচরণ রয়েছে বলে জানা যায়। তবে বাংলাদেশে দেখতে পাওয়া যায় ৭ প্রজাতির শকুন। বাংলা শকুন, রাজ শকুন, গ্রীফন শকুন বা ইউরেশীয় শকুন, হিমালয়ী শকুন, সরুঠোঁট শকুন, কালা শকুন ও ধলা শকুন। এর মধ্যে রাজ শকুনের কোনো অস্তিত্বই আর নেই। বাকি ৬ প্রজাতির মধ্যে ৪টি স্থায়ী এবং ২টি অস্থায়ী বা পরিযায়ী। এসবের মধ্যে শুধু বাংলা শকুনটি-ই কোনোমতে টিকে আছে। নানা কারণে বাংলাদেশ থেকে ইতোমধ্যে প্রায় ৯৯ শতাংশ শকুন বিলুপ্ত হয়ে গেছে গত ৫০ বছরে। বিবিসির এক প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৭০ সালের শকুন শুমারিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ৫০ হাজারের মতো শকুন ছিল বলে জানা যায়। ২০০৮-০৯ সালে চালানো শুমারিতে শকুনের সে সংখ্যা নেমে আসে ১৯৭২টিতে। এর কয়েক বছর পর ২০১১-১২ সালে শকুনের সে সংখ্যা আরও কমে দাঁড়ায় ৮১৬ টিতে। আর সর্বশেষ ২০১৪ সালের তথ্য বলছে, কমতে কমতে শকুনের সংখ্যা এখন মাত্র ২৬০টি। ক্রমান্বয় শকুনের সংখ্যা কমে ২৬০-এর কোটায় আসার দায় সম্পূর্ণ মানুষজাতির। আমাদের চরম উদাসীনতা আর অবিবেচনাসুলভ আচরণের কারণে শকুন আজ মহাবিপন্ন। সাধারণত শকুন মৃত পশুর মাংস খেয়েই জীবিকা নির্বাহ করে। কিন্তু যখন থেকে গবাদিপশুর চিকিৎসায় জেনে বা না জেনে ডাইক্লোফেনাক বা কিটোপ্রোফেনের ব্যবহার শুরু হলো, তখন থেকেই তা শকুন বিপন্নের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ালো। কারণ এটি সোডিয়ামজাতীয় ওষুধ, যা সরাসরি প্রাণীর কিডনিতে আঘাত হানে। শকুনের হজমশক্তি প্রবল হলেও তাদের পরিপাকতন্ত্রে কোনো এনজাইম না থাকায় ডাইক্লোফেনাক পরিপাক হয় না। ফলে ডাইক্লোফেনাক বা কিটোপ্রোফেন খাওয়া মৃত পশুর মাংস খেলে শকুনের কিডনি খুব দ্রম্নত অকেজো হয়ে যায় এবং মৃত পশুর মাংস খাওয়ার তিন থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই শকুন মারা যায়। শকুন বিপন্নের অন্যতম কারণ এই ডাইক্লোফেনাক। এর বাইরে এখন গবাদিপশু পালন এবং চিকিৎসা পদ্ধতিতে গত কয়েক দশকে যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, তাতে আগের মতো আর বেশি সংখ্যায় গরু বা বড় প্রাণী অসুখে মারা যায় না। ফলে শকুনের খাদ্য সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। খাদ্য সংকটের পাশাপাশি শকুন বিলুপ্তি হওয়ার পিছনে আরও কিছু কারণ রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো- তাদের আবাস বা বাসস্থানের অভাব। এরা সাধারণত লোকচক্ষুর আড়ালে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা প্রাচীন বট, পাকুড়, অশ্বত্থ, ডুমুর, শিমুল, ছাতিম, দেবদারুর মতো বৃহদাকার বৃক্ষরাজিতে বসতি গড়ে। এ ধরনের বড় ও উঁচু গাছগুলো এখন আর চোখে পড়ে না। অসচেতনতা, ঘর-বাড়ি বা শিল্প অবকাঠামো নির্মাণের জন্য নির্বিচারে বৃক্ষ কর্তনের কারণে এসব বিশালাকার বৃক্ষ প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে।
শকুন বছরে একটি ডিম পাড়ে, এবং সেই ডিম ফুটে বাচ্চা হওয়ার ক্ষেত্রে সাফল্যের হার মাত্র ৪০ শতাংশ। ফলে এদের প্রজননের হার খুবই শ্লথ। অনেকে শকুনকে অশুভ ও অমঙ্গলকর প্রাণী গণ্য করে এগুলো নিধন করে থাকে। এটিকে শকুন বিলুপ্তির প্রচ্ছন্ন কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে শকুন বিলুপ্তির পিছনে কী কারণ ছিল বা আছে, সেগুলোর সুলুক-সন্ধান না করে বরং অবশিষ্টগুলো কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়, তার দিকে অভিনিবেশ করাই এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এজন্য গণসচেতনা বৃদ্ধির এবং শকুন সংরক্ষণে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প নেই। ইতিমধ্যে সরকার শকুন সংরক্ষণের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে ২০১০ সালে দেশব্যাপী শকুনের জন্য ক্ষতিকারক ওষুধ 'ডাইক্লোফেনাক' নিষিদ্ধকরণসহ ২০১৩ সালে 'বাংলাদেশ জাতীয় শকুন সংরক্ষণ কমিটি' গঠন ও ২০১৪ সালে দেশের দুটি অঞ্চলকে শকুনের জন্য নিরাপদ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা অন্যতম। এছাড়া শকুন সংরক্ষণের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে ২০১৬ সালে দশ বছরমেয়াদি (২০১৬-২০২৫) বাংলাদেশ শকুন সংরক্ষণ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। পাশাপাশি ২০১৫ সালে শকুনের প্রজননকালে বাড়তি খাবারের চাহিদা মেটানোর জন্য হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ও সুন্দরবনে দুটি ফিডিং স্টেশন এবং ২০১৬ সালে অসুস্থ ও আহত শকুনদের উদ্ধার ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দিনাজপুরের সিংড়ায় একটি শকুন উদ্ধার ও পরির্চযা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সরকারের এসব উদ্যোগ শকুন সংরক্ষণে এবং বৃদ্ধিতে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তা বলাই বাহুল্য। আইইউসিএন সূত্রে জানা যায়, সরকারের এসব বহুমুখী পদক্ষেপের ফলে হবিগঞ্জের রেমা-কালেঙ্গায় ২০১৪ সালে শকুনের প্রজনন সফলতা ছিল ৪৪ শতাংশ, যা ২০২০ সালে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৫৭ শতাংশ। সুতরাং শকুন সংরক্ষণে সরকারের এসব উদ্যোগ ভবিষ্যতে যে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখবে তা নিঃসন্দেহ।
শকুন পরিবেশের অকৃত্রিম বন্ধু। পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত রাখার ক্ষেত্রে শকুনের অবদান অনস্বীকার্য। তাই এই প্রাণীটি রক্ষায় আমাদের কোনো ধরনের অবহেলা বা উদাসীনতা এটিকে চিরতরে প্রকৃতি থেকে বিলীন করে দিতে পারে। এজন্য পরিবেশের প্রয়োজনেই শকুন সংরক্ষণে আমাদের আরও সোচ্চার হতে হবে।
মনিরুল হক রনি
সমাজকর্মী ও প্রভাষক, সমাজকর্ম বিভাগ
সাভার সরকারি কলেজ, সাভার, ঢাকা