সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুস্থ,সুন্দর ও আনন্দময় জীবনের জন্য খেলাধুলার বিকল্প নেই

দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কিন্তু এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুধু শিক্ষার্থীদের পাঠদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শারীরিক ও মানসিক বিকাশ তথা সৃজনশীল কার্যক্রমের কোনো সুযোগ নেই। দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেই নিজস্ব কোনো খেলার মাঠ। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠের অভাব চোখে পড়ার মতো। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রম্নতই এদিকে নজর দেওয়া দরকার। শিক্ষার্থীদের জন্য লেখাপড়ার ভালো পরিবেশের পাশাপাশি একটি ভালো মাঠের নিশ্চয়তা যেন দেওয়া হয়, সেটাই আমাদের কাম্য।
আর কে চৌধুরী
  ২০ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

রাজধানী ঢাকা থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে খেলার মাঠ। কালের বিবর্তনে সেগুলো আজ অপদখলের শিকার। এক সময় যেসব মাঠে ছিল ফুটবল নিয়ে শিশু-কিশোরদের অনুশীলন, যেসব পার্কে ঘোরাফেরা করে মুক্তবায়ু সেবনের সুযোগ পেত এলাকার মানুষ সেগুলোতে। এখন তা অপদখলের শিকার। তার কোনোটিতে গড়ে উঠেছে সরকারি স্থাপনা, কোনোটিতে মার্কেট।

শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদের প্রয়োজন সুস্থ, সুন্দর ও আনন্দময় জীবন। আর এ জন্য খেলাধুলার কোনোই বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের অন্যতম মাধ্যম খেলাধুলা। এজন্য প্রয়োজন খেলার মাঠ। খেলাধুলা চর্চার প্রতি শিশু-কিশোরদের সব সময়ই আগ্রহ থাকে। তারা খেলাধুলা করতে চায়। ভালো পরিবেশে খেলাধুলা করতে পারলে তাদের পড়ালেখার প্রতিও মনোযোগী করে তোলা যায়। একটা সময় ছিল যখন মাঠ বা স্কুল-কলেজের খেলার চত্বর মুখর থাকত। এখন তেমনটি খুব একটা চোখে পড়ে না। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে পুরোনো কিছু স্কুল-কলেজ ছাড়া নতুন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ নেই বললেই চলে। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

সম্প্রতি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেল, সিরাজগঞ্জে ৫২১টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনো খেলার মাঠ নেই। একই অবস্থা কিন্ডার গার্টেনগুলোতেও। প্রতিবেদনে উলেস্নখ করা হয়, জেলার ৯টি উপজেলায় ১ হাজার ৬৭১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও ৫২১টিতেই নেই খেলার মাঠ। তবে এই চিত্র যে শুধু সিরাজগঞ্জের এ কথা বলা যাবে না, তা প্রায় সর্বত্র বিরাজমান। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে উচ্চ বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কলেজের মাঠে খেলাধুলার পরিবর্তে চলে বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এ অবস্থায় যে লোভের সংস্কৃতির জন্ম হচ্ছে, এর থেকে পরিত্রাণ দরকার। কারণ খেলার মাঠে পশু চড়ানো, ময়লা-আবর্জনা ফেলা, গরু-ছাগলের হাট এগুলো সৃজনশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। স্কুলের মাঠে প্রভাবশালীদের গাছ লাগানোর খবরও সংবাদমাধ্যমে পড়তে হচ্ছে আমাদের। সবার লোভের দৃষ্টি যেন স্কুলের ওই সবুজ মাঠটি ঘিরে। অথচ যা হওয়ার কথা ছিল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বেড়ে ওঠার সহায়ক, তা যেন দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। স্কুল থাকবে, মাঠ থাকবে না, শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা করতে পারবে না এটা কি ভাবা যায়? মাঠের অভাবে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলাধুলার চর্চা নেই, নেই সাংস্কৃতিক পরিবেশ। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা কোনোভাবে কাম্য নয়। স্কুলের কার্যক্রম শুধু পাঠদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে যেসব চর্চার প্রয়োজন তা নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশে শহরাঞ্চলে বেসরকারি পর্যায়ে এমন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলোর কোনো খেলার মাঠ নেই। আবার সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের মাঠ প্রায় বছরজুেড়ই নানা ধরনের কাজে ব্যবহার করা হয়। কোথাও মেলা হয়, কোথাও আবার প্রতি সপ্তাহে পশুর হাটও বসে। স্বার্থান্বেষী মহলের দখলের কারণে শিশু-কিশোর ও এলাকাবাসী খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নগর-গ্রাম সব জায়গায়ই খেলাধুলার সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। নগর ও গ্রামীণ পরিকল্পনায় খেলার মাঠকে বিনোদন ক্ষেত্রের পাশাপাশি স্বাস্থ্য অবকাঠামো হিসেবে বিবেচনা করা জরুরি। এলাকাভিত্তিক খেলার মাঠ তৈরির ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ ও ভাবনাচিন্তা খুবই স্বল্প। এই বাস্তবতায় খেলাধুলার সুযোগকে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার মৌলিক অধিকার বিবেচনা করে সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, কার্যকর বাস্তবায়ন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ প্রয়োজন।

পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, ফরিদপুর জিলা স্কুলের মাঠ দখল করে একের পর এক ভবন তৈরি হচ্ছে। বিদ্যালয়ের উত্তর পাশের খেলার মাঠের পূর্ব কোণে ৩০ শতাংশ জমিতে স্কাউট ভবন নির্মাণ করা হয় ১৯৮২ সালে। এরপর ওই ৩০ শতাংশ জমির মধ্যে দক্ষিণে শিক্ষা ভবন নির্মিত হয়। সর্বশেষ গত নভেম্বরের শেষ দিকে সেখানে আবার শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের কাজ শুরু হয়েছে। এসব ভবন নির্মিত হওয়ায় শিক্ষার্থীদের খেলার মাঠ ছোট হয়ে আসছে। ফরিদপুর শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী বলেছেন, যে ভবনে তাদের কার্যালয় ছিল সেটিতে জায়গার সংকুলান হচ্ছিল না। প্রশ্ন হচ্ছে, তাই বলে কি স্কুলের মাঠ দখল করতে হবে? ভবিষ্যতে যদি বিদ্যালয়ের সম্প্রসারণ কাজ তথা ভবন স্থাপনের জন্য জমির প্রয়োজন হয় তখন কী হবে?

সুস্থ, সুন্দর ও আনন্দময় জীবনের জন্য খেলাধুলার কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য প্রয়োজন ভালো পরিবেশ। একটা সময় ছিল যখন ফাঁকা জায়গা, খেলার মাঠ এবং স্কুল-কলেজের খেলার চত্বর খেলাধুলার কর্মকান্ডে মুখর থাকত। মাঠ দখল, মাঠে স্থাপনা নির্মাণ, স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজের মাঠ খেলাধুলা ছাড়া বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য কাজে ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের বিভিন্ন সময় নির্দেশনা আছে। কিন্তু সরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সদিচ্ছার অভাব তো স্পষ্টই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।

মাঠের অভাবে, সুস্থ পরিবেশের অভাবে বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলাধুলার চর্চা নেই। এই অবস্থায় ফরিদপুর জিলা স্কুলের মাঠ দখল করে স্থাপনা নির্মাণ কেন?

শুধু পাঠদানের মধ্যেই একটি বিদ্যালয়ের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে যেসব চর্চার প্রয়োজন তা নিশ্চিত করতে হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কিন্তু এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুধু শিক্ষার্থীদের পাঠদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শারীরিক ও মানসিক বিকাশ তথা সৃজনশীল কার্যক্রমের কোনো সুযোগ নেই। দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেই নিজস্ব কোনো খেলার মাঠ। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠের অভাব চোখে পড়ার মতো।

বালক, কিশোর ও তরুণদের খেলাধুলা চর্চার প্রতি ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। তারা খেলাধুলা করতে চায়, অংশ নিতে চায়। কিন্তু তাদের সুযোগ নেই। অথচ একটা সময় ছিল, যখন ফাঁকা জায়গা, খেলার মাঠ এবং স্কুল-কলেজের খেলার চত্বর খেলাধুলার কর্মকান্ডে একটা সময় মুখর থাকত। এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া দেশজুড়ে বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত কয়টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাস ও খেলার মাঠ আছে?

প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে হাই স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ, এমনকি বিভিন্ন শহরে স্টেডিয়াম নামধারী মাঠের ভেতরে ও বাইরে ছোট-বড় অংশ দখল, খেলাধুলার পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক কাজে এবং ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে নিয়মিত ব্যবহারের মাধ্যমে যে লোভের সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে, এর থেকে আর পরিত্রাণ মেলেনি। বরং এই অসুস্থ সংস্কৃতির পরিধি বেড়েই চলেছে।

মাঠের অভাবে, সুস্থ পরিবেশের অভাবে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাধুলার চর্চা নেই, এটা নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা কি সংশ্লিষ্ট মহলের আছে?

দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। কিন্তু এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুধু শিক্ষার্থীদের পাঠদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শারীরিক ও মানসিক বিকাশ তথা সৃজনশীল কার্যক্রমের কোনো সুযোগ নেই। দেশের অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেই নিজস্ব কোনো খেলার মাঠ। বিশেষ করে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠের অভাব চোখে পড়ার মতো। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রম্নতই এদিকে নজর দেওয়া দরকার। শিক্ষার্থীদের জন্য লেখাপড়ার ভালো পরিবেশের পাশাপাশি একটি ভালো মাঠের নিশ্চয়তা যেন দেওয়া হয়, সেটাই আমাদের কাম্য।

আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে