বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সবুজ বিপস্নবের মশাল হাতে এগিয়ে বাংলাদেশ

আর্থিক ক্ষেত্রে গ্রিন ব্যাংকিং ধারণার বিকাশ সময়ের দাবি হয়ে উঠেছিল। বর্তমানে যা দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। টেকসই অর্থনীতির জন্য গ্রিন ব্যাংকিং ধারণার অনুসারী হয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে। যার চমৎকার ফলাফল ক্রমেই অর্থনীতিতে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একইভাবে গার্মেন্টস শিল্পে গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার পরিপূর্ণ বিকাশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নেবে- আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
রেজাউল করিম খোকন
  ২৪ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তা সাজ্জাদুর রহমান মৃধার হাত ধরে ২০১২ সালে প্রথম পরিবেশবান্ধব কারখানার যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশে। পাবনার ঈশ্বরদী ইপিজেডে তিনি স্থাপন করেন ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও। তার দেখানো পথ ধরে দেশে ইতোমধ্যে পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা ও বস্ত্রকল হয়েছে ১৮৩টি। এর মধ্যে চলতি বছরে পরিবেশবান্ধব কারখানার তালিকায় যুক্ত হয়েছে ১৫টি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে বিশ্বে অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি পরিবেশবান্ধব পোশাক ও বস্ত্রকল রয়েছে। তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের পাশাপাশি শিপইয়ার্ড, জুতা ও ইলেকট্রনিক পণ্য খাতেও আছে পরিবেশবান্ধব কারখানা। বাণিজ্যিক ভবনও হচ্ছে পরিবেশবান্ধব, তবে সংখ্যায় কম। বিশ্বের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সনদ দিয়ে থাকে। তাদের মধ্যে অন্যতম একটি যুক্তরাষ্ট্রের ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি)। তারা 'লিড' নামে পরিবেশবান্ধব স্থাপনার সনদ দিয়ে থাকে। লিড-এর পূর্ণাঙ্গ রূপ লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন। ইউএসজিবিসি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের স্থপতিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কাউন্সিল। পৃথিবীজুড়ে এটি পরিবেশবান্ধব ভবন ও কারখানা নির্মাণে পরামর্শ ও সহায়তা করে থাকে। এমনকি পরিবেশবান্ধব কারখানা বা স্থাপনার তৈরির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট মানদন্ডও রয়েছে তাদের। সংস্থাটির দেওয়া সনদ এখন পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। বিশ্বের বড় বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এ সংস্থার সনদকে গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করে। এ জন্য ইউএসজিবিসির সনদকে এ দেশের শিল্প উদ্যোক্তারাও বেশ গুরুত্ব দেয়। ইউএসজিবিসির তালিকায় শীর্ষ দশে থাকা সব কারখানা লিড পস্নাটিনাম সনদ পেয়েছে। বিভিন্ন মানদন্ডে ১১০ নম্বরের মধ্যে ৮০ বা এর বেশি নম্বর পায়, এমন কারখানাকে এ সনদ দেওয়া হয়। লিড-এর পূর্ণাঙ্গ রূপ হচ্ছে লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন। সনদটি পেতে একটি প্রকল্পকে ইউএসজিবিসির তত্ত্বাবধানে নির্মাণ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত বিভিন্ন মানদন্ডে নির্ধারিত মান রক্ষা করতে হয়। নির্ধারিত মান বজায় রেখে নতুন ভবন নির্মাণ কিংবা পুরনো ভবন সংস্কার করেও এ সনদের জন্য আবেদন করতে পারে কারখানাগুলো। সনদটি পেতে একটি প্রকল্পকে ইউএসজিবিসির তত্ত্বাধানে নির্মাণ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে সর্বোচ্চ মান রক্ষা করতে হয়। এ জন্য নতুন ভবন নির্মাণ কিংবা পুরনো ভবন সংস্কার করেও আবেদন করা যায়। ১৯৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইউএসজিবিসি। সংস্থাটির অধীনে কলকারখানার পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভবন, স্কুল, হাসপাতাল, বাড়ি, বিক্রয়কেন্দ্র, প্রার্থনাকেন্দ্র ইত্যাদি পরিবেশবান্ধব স্থাপনা হিসেবে গড়ে তোলা যায়। লিড সনদের জন্য ৯টি শর্ত পরিপালনে মোট ১১০ পয়েন্ট আছে। এর মধ্যে পয়েন্ট ৮০-এর ওপরে হলে 'লিড পস্নাটিনাম', ৬০-৭৯ হলে 'লিড গোল্ড', ৫০-৫৯ হলে 'লিড সিলভার' এবং ৪০-৪৯ হলে 'লিড সার্টিফায়েড' সনদ মেলে। বাংলাদেশের পরিবেশবান্ধব স্থাপনাগুলো অধিকাংশই ইউএসজিবিসির অধীনে সনদ পেয়েছে। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, গত সেপ্টেম্বর ২০২২ পর্যন্ত বাংলাদেশে লিড সনদ পাওয়া ১৭১টি পোশাক ও বস্ত্র কারখানার মধ্যে ৫৩টি লিড পস্নাটিনাম, ১০৪টি গোল্ড, ১০টি সিলভার ও ৪টি সার্টিফায়েড সনদ পেয়েছে। পাইপলাইনে রয়েছে আরও পাঁচ শতাধিক কারখানা। প্রতি বছরই পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার তালিকায় নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান যুক্ত হওয়াটা খুবই ইতিবাচক। এতে সামাজিক ও পরিবেশগত সুবিধা পাচ্ছি আমরা। তবে ব্যবসায়ে এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে না। এ ক্ষেত্রে দেশ হিসেবে পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার ব্র্যান্ডিং না করতে পারাটাই মূল সমস্যা। কিছু প্রতিষ্ঠান নিজেরা চেষ্টা করে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পোশাকের বাড়তি দাম নিতে পারছে। তবে অধিকাংশই পারছে না। ব্যবসায়িক সুবিধা নিতে পারলে পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা স্থাপনে আরও বেশি আগ্রহী হতেন উদ্যোক্তারা।

লিড সনদে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে বাংলাদেশের গ্রিন টেক্সটাইল লিমিটেড এখন বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব কারখানা। ১১০ নম্বরের মধ্যে তারা পেয়েছে ১০৪। শুধু তারাই নয়, বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব ১০টি কারখানার ৮টি বাংলাদেশের। শীর্ষ ১০-এর মধ্যে থাকা দেশের অন্যান্য পরিবেশবান্ধব কারখানা হলো রেমি হোল্ডিংস লিমিটেড, ফতুলস্না অ্যাপারেলস, তারাসিমা অ্যাপারেলস লিমিটেড, পস্নামি ফ্যাশনস লিমিটেড, সিল্কেন সুইং লিমিটেড, মিথেলা টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। তবে তালিকার তৃতীয় স্থানে থাকা বাংলাদেশি কারখানার নাম প্রকাশ করা হয়নি। শুধু দেশের নাম উলেস্নখ করা হয়েছে। এই ১০ কোম্পানির সব কটিই পস্নাটিনাম সনদ পেয়েছে। লিড তালিকার শীর্ষ ১০০টি কোম্পানির মধ্যে ৫২টি বাংলাদেশের। অর্থাৎ, এ তালিকায় থাকা সবচেয়ে বেশি কোম্পানি বাংলাদেশের। এরপর সবচেয়ে বেশি কোম্পানি আছে চীনের। তাদের আছে ১০টি কারখানা। এরপর পাকিস্তানের আছে ৯টি কারখানা। শ্রীলঙ্কা ও ভারতের আছে ৬টি করে কারখানা। ভিয়েতনাম ও তাইওয়ানের আছে ৪টি করে কারখানা।

পরিবেশবান্ধব শিল্পকারখানা স্থাপনে একের পর এক নতুন রেকর্ড করছে বাংলাদেশ। বিশ্বের ১ নম্বর পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত গ্রিন টেক্সটাইল লিমিটেডের চতুর্থ ইউনিট। নতুন খবর হচ্ছে, চট্টগ্রামের প্যাসিফিক জিনস গ্রম্নপের এনএইচটি ফ্যাশনস উন্নীত হয়েছে লিড পস্নাটিনামে। এত দিন এই পোশাক কারখানাটি ছিল লিড গোল্ড সনদপ্রাপ্ত পরিবেশবান্ধব কারখানা। এনএইচটি ফ্যাশন লিড পস্নাটিনামে উন্নীত হওয়ার সনদ পেয়েছে। পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছে, পরিবেশবান্ধব কারখানার এমন মানোন্নয়ন এটিই প্রথম। ২০১৭ সালে এনএইচটি ফ্যাশনস ১১০ নম্বরের মধ্যে ৬৪ নম্বর পেয়ে লিড গোল্ড সনদ পেয়ে পরিবেশবান্ধব কারখানার স্বীকৃতি পায়। আর এখন কারখানাটি মানোন্নয়ন করে ১১০ নম্বরের মধ্যে ৮৪ পেয়ে লিড পস্নাটিনাম সনদ পেল। নতুন নতুন পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনের পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব কারখানার রিসার্টিফিকেশন প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে বাংলাদেশে। এনএইচটি ফ্যাশনস তারই প্রথম উদাহরণ। তার মানে আমরা দ্বিতীয় পরিবেশবান্ধব কারখানার দ্বিতীয় পর্যায়ে পদযাত্রাও শুরু করেছি। এর মাধ্যমে আমাদের উদ্যোক্তারা দেখিয়ে দিয়েছেন, পরিবেশবান্ধব কারখানার উন্নয়নেও কাজ করছেন তারা। এ অর্জন বাংলাদেশের এসডিজির লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের সুনামও বিশ্বে অনেক বাড়িয়ে দেবে। আশা করছি, বৈশ্বিক এ স্বীকৃতি পণ্যমূল্যের দর-কষাকষির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে। বৈশ্বিক ব্র্যান্ডগুলো যে কোনো ক্রয়াদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে এ স্বীকৃতির বিষয়টি বিবেচনায় নেবে। এ অর্জন বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের। পরিবেশবান্ধব কারখানায় প্রতিযোগী দেশগুলোর কেউই বাংলাদেশের ধারে কাছে নেই। আশা করছি, বৈশ্বিক এ স্বীকৃতি পোশাকের দাম বাড়াতে সহায়তা করবে।

লিড সনদে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে বাংলাদেশের গ্রিন টেক্সটাইল লিমিটেড এখন বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব কারখানা। ৫৪ হাজার বর্গফুটের কারখানাটি তৈরিতে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক উৎসকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে কারখানায় ৬৫ শতাংশ পানি ব্যবহার করা হয় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে। এ ছাড়া কারখানাটিতে জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে সবুজ জ্বালানির ব্যবহার বেশি করা হয়। কারখানার বিদু্যতের চাহিদার ৮০ শতাংশই পূরণ করা হয় সৌরবিদু্যতের মাধ্যমে। ভালুকায় গ্রিন টেক্সটাইল কোম্পানিটির নিজস্ব শিল্প এলাকায় এরই মধ্যে চারটি ইউনিট রয়েছে। এ চারটি ইউনিটের মধ্যে চতুর্থটি পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে বিশ্বসেরার স্বীকৃতি পেয়েছে। বাকি তিনটি ইউনিটের মধ্যে তৃতীয়টিও 'লিড পস্নাটিনাম' কারখানার স্বীকৃতি পেয়েছে। বাকি দুটি ইউনিট 'গোল্ড' সনদপ্রাপ্ত। তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের হিসাবে, বর্তমানে লিড পস্নাটিনাম, গোল্ড, সিলভারসহ বিভিন্ন শ্রেণিতে বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যা ১৮৩। এর বাইরে আরও পাঁচ শতাধিক কারখানা পরিবেশবান্ধব কারখানার সনদ পাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। বেশ কিছু শ্রেণিতে নম্বর বণ্টনের মাধ্যমে লিড পস্নাটিনাম সনদ দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে টেকসই কারখানা প্রাঙ্গণ, দক্ষতার সঙ্গে পানির ব্যবহার, টেকসই জ্বালানি ও পরিবেশ, উপকরণ ও সম্পদ, উদ্ভাবন ও আঞ্চলিক অগ্রাধিকার ইত্যাদি।

দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশই আসে পোশাকশিল্প খাত থেকে। তবে মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যে এ খাত নিয়ে চরম শঙ্কা তৈরি হয়। বাতিল হয়ে যায় অনেক অর্ডার। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে স্বরূপে ফিরতে খুব বেশি দেরি হয়নি। অল্প সময়ের ব্যবধানে বাতিল হওয়া অর্ডারগুলো পুনরায় ফিরে আসতে থাকে। ফলে করোনার মাঝেও চমক দেখিয়েছে পোশাক খাত। একই সঙ্গে বেড়েছে পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানা বা গ্রিন ফ্যাক্টরির সংখ্যাও। আগে থেকেই সবুজ কারখানার তালিকায় বিশ্বে শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। গ্রিন ফ্যাক্টরিতে আমাদের দেশ এখনো শীর্ষে রয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা বাড়াতে এলইইডির সার্টিফিকেট গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রথমেই জানতে চায়, তাদের পোশাকপণ্য কোথা থেকে এসেছে? কোন পরিবেশে তৈরি হয়েছে? সেখানে কীভাবে উৎপাদন হয়েছে বা কোনো ধরনের ক্ষতিকর কেমিক্যাল আছে কি না? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে এলইইডি সার্টিফিকেটের বিকল্প নেই। শিল্পায়ননির্ভর অর্থনীতির টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বিগত চার দশকে একটি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পেছনে আমাদের যে যাত্রা তার মূলে রয়েছে শিল্পের অভাবনীয় বিকাশ, বিশেষ করে শ্রমনির্ভর ম্যানুফ্যাকচারিং খাত। ৭০ দশকের শেষের দিকে যাত্রা শুরু করে ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে আমরা দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছি। প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান এবং পরোক্ষভাবে প্রায় এক কোটি মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস এই শিল্পের জিডিপিতে অবদান ১১%। দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে অব্যাহত অবদান রাখার পাশাপাশি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত, শ্রমিকের ক্ষমতায়ন এবং সবুজ শিল্পায়নেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে এই শিল্প। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অডিট প্রতিষ্ঠান কিউআইএমএ বাংলাদেশের পোশাক খাতকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এথিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পরিবেশবান্ধব সবুজ শিল্পায়নেও আমাদের গার্মেন্টস খাত অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। ক্রমপরিবর্তনশীল আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনে শিল্পের ভূমিকার বিষয়টিকেও নজর রাখতে হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থায় পরিবেশ ও জলবায়ুর বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। গ্রিন ফ্যাক্টরির ধারণাটি আমাদের দেশে নতুন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছে। গ্রিন ফ্যাক্টরির ধারণা আমাদের গার্মেন্টসশিল্পে ব্যাপকভাবে চালু হওয়ায় গোটা অর্থনীতিতে এর চমৎকার অনুকূল প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আমাদের গার্মেন্টস খাত থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের যে রূপকল্প নির্ধারণ করা হয়েছে, তার যথাযথ বাস্তবায়নে গ্রিন ফ্যাক্টরির ধারণার দ্রম্নত বিকাশ সবাইকে আস্থাশীল করে তুলেছে। সাভারে রানা পস্নাজা ধস কিংবা তাজরিন গার্মেন্টস এ ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনার পর বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছিল, এর ফলে ভাটা পড়েছিল এ খাতে। বিদেশি ক্রেতারাও আস্থার সংকটে পড়েছিল। বড় ধরনের ধাক্কা খাওয়ার পর ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প। পরিবেশবান্ধব টেকসই কারখানা বা ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠায় রীতিমতো তুমুল প্রতিযোগিতা শুরু হয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে। এর মাধ্যমে সারা দেশে একে একে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরি। এগুলো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গ্রিন ফ্যাক্টরির ধারণাটি আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দিনে দিনে আরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরি। আগামীতে আরও অনেকগুলো গার্মেন্টস কারখানাকে সবুজায়নের আওতায় আনার প্রক্রিয়া জোরেশোরে চলছে। শ্রমিকবান্ধব গার্মেন্টস কারখানা প্রতিষ্ঠায় মালিকদের আন্তরিক প্রচেষ্টা সুফল বয়ে এনেছে, অর্থনীতিতে নতুন প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছে বলা চলে। গার্মেন্টসশিল্পে গ্রিন ফ্যাক্টরির ধারণা নিঃসন্দেহে নতুন জাগরণ সৃষ্টি করেছে উদ্যোক্তাদের মধ্যে। গ্রিন ফ্যাক্টরির ধারণা দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে সন্দেহ নেই। এতে বিদেশি ক্রেতারা অবশ্যই আকৃষ্ট হবেন জোর দিয়ে বলা যায়। রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে যাবে বহুগুণ। বর্তমানে যারা নতুন কারখানা চালু করছেন, তারা গত কয়েক বছরে লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকেই কারখানা স্থাপন করছেন, তা বলাই বাহুল্য। কারণ তারা উপলব্ধি করেছেন, ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কারখানা না হলে বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার দেবেন না। তাই উদ্যোক্তারা ব্যবসার আইনকানুনের পাশাপাশি দেশের প্রচলিত বিভিন্ন আইন মেনে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছেন। আবার সম্পূর্ণ কমপস্নায়েন্ট না হলে নতুন কোনো কারখানাকে বিজিএমইএ থেকে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না। একটি পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানায় উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে পানি, বিদু্যৎ, রং এবং বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার পরিবেশবান্ধব উপায়ে হচ্ছে কিনা তা দেখা হয়। অধিকাংশ পোশাকশিল্প কারখানা ইটিপি ব্যবহারের ক্ষেত্রে গতানুগতিক ইটিপির পরিবর্তে বায়োলজিক্যাল ইটিপি ব্যবহার করছে- যা আমাদের সবুজ বিপস্নবেরই একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত। বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে টেকসই উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করে তুলতে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থায় মনোযোগী হতে হবে। পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নে অর্থায়নের পাশাপাশি এনভায়রনমেন্টাল, সোশ্যাল ও করপোরেট গভর্ন্যান্স (ইএসজি) প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকে আরও গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। বিশ্বব্যাপী ভোক্তাদের টেকসই ও স্বল্প কার্বন ফুটপ্রিন্ট সম্পন্ন পোশাকের প্রতি আগ্রহ ক্রমশ বেড়ে চলেছে এবং জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোও পরিবেশবান্ধব পোশাক তৈরির নিত্যনতুন প্রতিশ্রম্নতি নিয়ে কনজুমারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। গ্রিন ফ্যাক্টরির ধারণার একটি উলেস্নখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, পরিবেশের সুরক্ষা। পরিবেশবান্ধব, বিদু্যৎ, পানি ও গ্যাস সাশ্রয়ী, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু রাখা কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হলেও গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই চ্যলেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে কঠিন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হচ্ছে আমাদের গার্মেন্টস খাতকে। অনেক বাধা, বিপত্তি প্রতিকূলতা, ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে আমাদের গার্মেন্টস খাতকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এখন পরিবেশ সুরক্ষার দিকে সবাইকে আলাদা মনোযোগ দিতে হচ্ছে। গার্মেন্টসসামগ্রী ক্রেতা দেশ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, গোষ্ঠী এখন গার্মেন্টস উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবেশবান্ধব, শ্রমিকবান্ধব নানা শর্ত আরোপ করছেন। যে সব শর্ত পূরণের মাধ্যমেই কেবল তাদের সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব। আর এ জন্য এখন গার্মেন্টস শিল্পে কমপস্নায়েন্সকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। অতীতে এ বিষয়টিকে এক প্রকার অগ্রাহ্য করা হয়েছে। গ্রিন ফ্যাক্টরির ধারণার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার পেছনেও বিদেশি ক্রেতাগোষ্ঠীর চাপ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।

আর্থিক ক্ষেত্রে গ্রিন ব্যাংকিং ধারণার বিকাশ সময়ের দাবি হয়ে উঠেছিল। বর্তমানে যা দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। টেকসই অর্থনীতির জন্য গ্রিন ব্যাংকিং ধারণার অনুসারী হয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে। যার চমৎকার ফলাফল ক্রমেই অর্থনীতিতে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একইভাবে গার্মেন্টস শিল্পে গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার পরিপূর্ণ বিকাশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নেবে- আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও কলাম লেখক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে