শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আমাদের করণীয়

গাড়ির গতিসীমা কখনোই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাতে না যায় সেদিকে অবশ্যই চালককে খেয়াল রাখতে হবে। বেপরোয়া গতিতে কখনোই গাড়ি চালানো যাবে না।
আলকামা সিকদার
  ৩০ মে ২০২৩, ০০:০০

বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি নাম। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের এ মাতৃভূমি বাংলাদেশও উন্নত বিশ্বের ন্যায় এগিয়ে চলতে চেষ্টা করছে। যে দেশের যাতায়াত ব্যবস্থা যত উন্নত সে দেশের উন্নয়নও তত বেশি। বর্তমানে বাংলাদেশের যাতায়াত ব্যবস্থা গত এক দশকের চাইতে অনেকাংশেই উন্নত হয়েছে। আমাদের দেশও তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে। যাতে আমরাও উন্নত দেশের কাতারে দাঁড়াতে সক্ষম হই।

আমাদের দেশ যাতায়াত ব্যবস্থায় উন্নত হয়েছে ঠিকই কিন্তু এখনো রয়ে গেছে কিছু অন্তরায়। রাস্তা-ঘাটের ট্রাফিক ব্যবস্থায় রয়েছে যাত্রী সাধারণের অবহেলা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আছে সামান্য আইন প্রয়োগ ব্যবস্থা। আর এজন্য আমাদের এ দেশের সড়ক পথে প্রতিনিয়ত ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা। প্রতিদিন সড়কে ঝরছে প্রাণ। প্রতিদিনই খবরের কাগজ ও অন্য মিডিয়াগুলোয় ভেসে উঠছে বীভৎস সব লাশের ছবি। অহরহ ঘটা সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার খবর যেন আমাদের গা-সহা হয়ে গেছে। ফলে প্রতিদিন সড়কে প্রাণ ঝরলেও তা আমাদের মনকে এখন আর আবেগতাড়িত করে না আগের দিনের মতো।

নিহতের আত্মীয়স্বজনদের আর্তচিৎকার আকাশ-বাতাস ভারী করলেও তা যেন আমাদের বিবেককে নাড়া দিতে পারছে না কোনোভাবেই। কিন্তু আমরা কি একবারের জন্যও ভেবে দেখি নিহতদের ওই পরিবারের কথা? তারা কি ভুলতে পারে তাদের স্বজন হারানোর বেদনা?

যে মানুষটি ছিল পরিবারের কর্মক্ষম একমাত্র অবলম্বন, একটি সড়ক দুর্ঘটনায় তার মৃতু্য সেই পরিবারের অন্য সদস্যদের সব স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্ক্ষা ভেঙে চুরমার করে দেয়। তাদের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ে অনিশ্চিত।

আমাদের দেশের মতো অন্য দেশগুলোয় সড়ক দুর্ঘটনার খবর আমরা এত পরিমাণে দেখতে পাই না। না পাওয়ার যথেষ্ট কারণও আছে, তারা আমাদের মতো সড়কে এত বেখেয়ালিভাবে চলাফেরা করে না, তাদের রয়েছে নিয়ম শৃঙ্খলিত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, রয়েছে আইনের যথাযথ প্রয়োগ।

আমাদের দেশের সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো কম-বেশি সবারই জানা। বিশেষ করে চালকের অসতর্কতা, অসচেতনতা, অজ্ঞতা, অপ্রশিক্ষিত, বেপরোয়া বা অনিয়ন্ত্রিত গতিতে গাড়ি চালনা, অপরিচিত রাস্তায় বেপোরোয় গতিতে গাড়ি চালনাসহ ত্রম্নটিপূর্ণ রাস্তা দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।

এ ছাড়া চালকরা অনেক সময় ঘুম ঘুম অবস্থায়, ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থায় গাড়ি চালায়, যার ফলে এক সময় নিজের অজান্তেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পতিত হয় সড়ক দুর্ঘটনা। তাই চালকদের এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। কোনোভাবেই অসুস্থ বা ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত, চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ি চালানো যাবে না। প্রত্যেক মানুষেরই পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম প্রয়োজন। দূরের রাস্তায় প্রয়োজনে দুজন চালকের মাধ্যমে গাড়ি চালনা করা।

দেশে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম আরও একটি কারণ হলো ওভারটেকিং প্রবণতা। বিশেষ করে রাস্তায় চলতে গিয়ে ধীরগতির গাড়িগুলোকে গতিসম্পন্ন গাড়িগুলো ওভারটেকিং করতে গিয়ে যখন অপরদিক থেকে আসা গাড়ির মুখোমুখি হয় তখন তারা গাড়িকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণে উভয় গাড়িই দুর্ঘটনায় পতিত হতে হয়। তাই সঠিক নিয়ম মেনে সতর্কতার সঙ্গে ওভারটেক করা উচিত।

সড়ক দুর্ঘটনার আরও একটি অন্যতম কারণ রাস্তার পাশে হাট-বাজার স্থাপন এবং ওভারব্রিজ না থাকা। মহাসড়কগুলোয় বাঁক থাকার কারণে সামনের দিক থেকে আসা গাড়ি দেখতে না পেয়ে অনেক চালক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। মহাসড়কগুলোয় দ্রম্নতগতির যানবাহনের পাশাপাশি ধীরগতির যানবাহন চলাচল। গতির তারতম্য থাকায় দ্রম্নতগতির গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লেগে ধীরগতির বাহন রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ে। তাই মহাসড়কে ধীরগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ অথবা তাদের জন্য আলাদা লেন করা জরুরি।

এ ছাড়া আমাদের বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার আরও একটি অন্যতম বড় কারণ বা উপদ্রব হলো বেপোরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানো। অপ্রাপ্তবয়স্ক, অপ্রশিক্ষিত হেলমেট বিহীনভাবে সড়ক, মহাসড়কগুলোয় বেপোরোয়া গতিতে মোটর সাইকেল চালানোর ফলে ঘটছে অহরহ দুর্ঘটনা। বিশেষ করে খবরের কাগজগুলোয় তাকালে দেখতে পাওয়া যায় টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলায় এমন কোনো দিন নেই যে, সেখানে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনা না ঘটছে।

প্রতিদিনই পঙ্গুত্ববরণ করছে কেউ না কেউ এই উপজেলাটিতে। সরেজমিন দেখা গেছে এ উপজেলায় যে পরিমাণ মোটর সাইকেল আছে বড় কোনো জেলায় ওই পরিমাণ গাড়িও চলাচল করে না। আর তাই এখানে মোটর সাইকেল চালকদের নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়েও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির গত এপ্রিলে প্রতিবেদনে দেখা যায়, শুধু এক মাসেই ৫২৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৫২ জন নিহত হয়েছেন। আর আহত হয়েছেন ৮৫২ জন। এতো গেল যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাব প্রকৃত পক্ষে এর পরিমাণ হয়তো আরও বেশি। একই প্রতিবেদনে আরও উঠে এসেছে ৪২টি রেল দুর্ঘটনায় ৩৪ জন নিহত ও ৬৭ জন আহত হয়েছেন। ১০টি নৌদুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত এবং ১৬ জন নিখোঁজ রয়েছেন। সড়ক, নৌ ও রেলে মোট ৫৭৮টি দুর্ঘটনায় ৫৯৭ নিহত ও ৯১৯ জন আহত হয়েছেন। এ ছাড়া এ মাসে ২১৫টি মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় ২৩১ জন নিহত ও ১৭১ জন আহত হয়েছেন। যাদের অধিকাংশই এখন পঙ্গু হয়ে ঘরে পড়ে আছেন। যা মোট দুর্ঘটনার ৪০.৮৭ শতাংশ। নিহত ৪৮.৮৪ শতাংশ এবং আহত ২০.০৭ শতাংশ। যা আমাদের প্রতিনিয়ত ব্যথিত করছে।

আর তাই মনে করা হচ্ছে দুর্ঘটনা রোধে পদক্ষেপ গ্রহণ করলে হয়তো উত্তরণ ঘটানো সম্ভব। সড়কে যখন আমরা গাড়ি চালাব তখন অবশ্যই আমাদের মনোযোগী হয়ে গাড়ি চালনা করতে হয়। চার চাকার গাড়ি চালানোর সময় অবশ্যই সিট বেল্ট লাগাতে যেন ভুলে না যাই। অল্প দক্ষ বা অদক্ষ চালক দিয়ে কখনোই গাড়ি চালানো ঠিক নয়। কারণ বেশি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে অদক্ষ চালকের জন্য। মাতাল বা নেশাগ্রস্ত চালককে দিয়ে গাড়ি না চালানো।

গাড়ির গতিসীমা কখনোই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাতে না যায় সেদিকে অবশ্যই চালককে খেয়াল রাখতে হবে। বেপরোয়া গতিতে কখনোই গাড়ি চালানো যাবে না।

রাস্তা বিশ্লেষণ বা রোড স্ক্যানিং নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যখন গাড়ি চালাবেন তখন অবশ্যই আপনার চলার রাস্তাটিকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করবেন। গাড়ি চালানোর সময় ফোনে বা যাত্রীর সঙ্গে কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। কথা বলতে বলতে বেখেয়ালি হয়ে যাওয়ার কারণে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

অনেক সময় প্রতিযোগিতা করে অনেক ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে থাকেন। এটি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। আপনি প্রতিযোগিতায় নামেননি, নিরাপদে নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে গাড়ি চালাচ্ছেন। গাড়ি চালানোর সময় লুকিং গস্নাস দেখা জরুরি।

যাতে আপনি আশপাশের গাড়ি দেখতে পারেন এবং দুর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা পান। তাই অবশ্যই প্রতিটি গাড়িতে লুকিং গস্নাস থাকা অতীব জরুরি অতএব আমরা যদি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজনে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করি তাহলে দুর্ঘটনা অনেকাংশেই কমে আসবে। আর এজন্য সরকার, চালক, মালিক, শ্রমিক ও যাত্রী সবাইকে সতর্ক ও সচেতন থাকতে হবে- মনে রাখতে হবে, সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।

আলকামা সিকদার :গণমাধ্যম কর্মী

ধষশধসধংযরশফবৎ৮৯৬@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে