শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গাছ রক্ষা আন্দোলন সময়ের দাবি

গাছকে মানুষের বোবা বন্ধু বলা হয়। দেশে এটাই বাস্তবতা যে, মানুষের বোবা বন্ধু গাছের গুরুত্ব-প্রয়োজনীয়তা তেমনভাবে উপলব্ধি করা হচ্ছে না। দেশে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় গাছের গুরুত্ব-প্রয়োজনীয়তা প্রকারান্তরে অস্বীকারই করা হচ্ছে।
জহির চৌধুরী
  ০১ জুন ২০২৩, ০০:০০

উন্নয়নের অজুহাত দেখিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকাধীন সাতমসজিদ সড়কের বিভাজকে থাকা বহুদিনের পুরাতন গাছের অনেকই কেটে ফেলেছে সম্প্রতি। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে গাছ কর্তন বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় তুলেছে। বিভিন্ন সংগঠন ও শ্রেণিপেশার মানুষ গাছ কর্তনের প্রতিবাদে রাজপথে বিক্ষোভ প্রদর্শন, সমাবেশ করছে। গাছ কাটার প্রতিবাদে এবং বাকি গাছ রক্ষার দাবিতে পরিবেশবাদীদের উদ্যোগে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) কার্যালয় (নগর ভবন) ঘেরাও কর্মসূচিও পালন করা হয়েছে সম্প্রতি। ওই কর্মসূচি থেকে গাছ রক্ষার আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

গাছের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বলা নিষ্প্রয়োজন। গাছের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তি মাত্রই অবগত থাকার কথা। প্রাণ রক্ষার জন্য গাছ বাঁচানো বা রক্ষা করা অতি আবশ্যক। কে না জানেন যে, প্রাণীর জীবন রক্ষার জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য। গাছ অক্সিজেনের বড় উৎস। বলা হয়, গাছ অক্সিজেন উৎপাদনের ফ্যাক্টরি। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিটি মানুষের জন্য দিনে ৫৫০ লিটার অক্সিজেন প্রয়োজন পড়ে। উদ্ভিদ বিষয়ক ওয়েবসাইট ফ্যান্থমফরেস্ট ডটকমের তথ্যানুযায়ী- একটি পূর্ণাঙ্গ গাছ অন্তত ১৮ জন মানুষের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন উৎপাদন করতে পারে।

তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখতে, পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গাছের অপরিহার্যতা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত। অক্সফোর্ডশায়ারের ওয়াইথাম উডবনের ১ হাজার গাছের বিশ্লেষণ করে গবেষকরা বলেছেন, আগে যা ধারণা করা হয়েছিল তার তুলনায় দ্বিগুণ কার্বন শুষে নেয় বনাঞ্চল। যে এলাকায় গাছ কম সে এলাকায় রেসপিরেটরি প্রবলেম (শ্বাসকষ্ট), স্কিন ডিজিজ বেড়ে যায়। অনেকেই জানেন যে, সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাবে স্কিন ক্যানসারের আশঙ্কা থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গাছের ছায়া সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করে স্কিন ক্যানসার থেকে বাঁচতে সাহায্য করে। আন্তর্জাতিক পরিবেশ বিষয়ক জার্নাল 'এনভায়রনমেন্টাল ইন্টারন্যাশনাল'-এ প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাড়ির আশপাশে ৩০০ মিটার বা এক মাইলের ৫ ভাগের একভাগ দূর পর্যন্ত সবুজ পরিবেশ থাকলে স্টোকের আশঙ্কা ১৬ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের একদল গবেষক দেখিয়েছেন, গাছের আচ্ছাদন গ্রীষ্মকালে দিনের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মতো প্রশমন করতে পারে। গাছের গুণাগুণ, গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা বলে কয়ে শেষ করার মতো নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি জনপদে জনপদবাসীর ৩ গুণ গাছ থাকা দরকার।

গাছকে মানুষের বোবা বন্ধু বলা হয়। দেশে এটাই বাস্তবতা যে, মানুষের বোবা বন্ধু গাছের গুরুত্ব-প্রয়োজনীয়তা তেমনভাবে উপলব্ধি করা হচ্ছে না। দেশে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় গাছের গুরুত্ব-প্রয়োজনীয়তা প্রকারান্তরে অস্বীকারই করা হচ্ছে।

\হরাজধানী ঢাকায় দুই কোটিরও বেশি মানুষের বাস ধরা হয়। এত সংখ্যক মানুষ বিশ্বের বহু দেশেই নেই। জনবহুল-ঘনবসতিপূর্ণ নগরী ঢাকায় লোক সংখ্যা অনুপাতে যে সংখ্যক গাছ থাকা দরকার তার সিকিভাগও নেই। কথিত উন্নয়নের নামে ঢাকা নগরীতে 'বৃক্ষ নিধন উৎসব' চলছে বছরের পর বছর। ১৯৯৫ সালেও ঢাকায় সবুজ অঞ্চল ছিল মোট আয়তনের ১৭ শতাংশ। কমতে কমতে বর্তমানে ঢাকায় সবুজ অঞ্চলের পরিমাণ এসে ঠেকেছে কমবেশি ৮ শতাংশে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জনপদ বা নগরীর আয়তনের অন্তত ২৫ শতাংশ সবুজ অঞ্চল প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই আশঙ্কা করছেন, ঢাকায় গাছ যে হারে কমছে তাতে আগামী ২০ বছর পর ঢাকায় অক্সিজেনের স্বল্পতা দেখা দিতে পারে। এক সময়কার সবুজনগরী ঢাকা এখন কংক্রিটের জঙ্গল বলা যায় নির্দ্বিধায়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পস্ন্যানার্স (বিআইপি) ২০২০ সালে এক প্রতিবেদনে বলেছে, ঢাকার প্রায় ৮২ শতাংশ এলাকা কংক্রিটে আবৃত।

ঢাকা নগরী এখন বিশ্বের অন্যতম উষ্ণ নগরী। আবহাওয়া বিভাগের হিসাবে, গত ১০০ বছরে দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় ঢাকার তাপমাত্রা দুই গুণের বেশি বেড়েছে। গত বছরের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়ান্স সেন্টারের 'হট সিটিস, চিলড ইকোনমিস: ইমপ্যাক্টস অব এক্সট্রিম হিট অন গেস্নাবাল সিটিস' শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, উচ্চ তাপমাত্রায় বছরে ঢাকার ক্ষতি ৬০০ কোটি ডলার। ঢাকা নগরী তপ্ত ভূখন্ডে (হিট ল্যান্ড) পরিণত হওয়ার অন্যতম কারণ বৃক্ষ হ্রাস। ঢাকা নগরীতে নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের কুফল দৃশ্যমানই। গাছ রক্ষা আন্দোলন বেগবান ও শক্তিশালী করতে হবে- পরিবেশ-প্রতিবেশ, জীববৈচিত্র্য, জনস্বাস্থ্য- প্রাণ রক্ষার প্রয়োজনেই। গাছ রক্ষা আন্দোলন পাড়া-মহলস্না পর্যন্ত সম্প্রসারিত করতে হবে, ছড়িয়ে দিতে হবে। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে নির্বিচারে গাছ নিধন করে সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা/ভবন/ অবকাঠামো নির্মাণের চরম মাশুল দেওয়া ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। ভূমির অন্তত ২৫ শতাংশ সবুজায়নের ব্যবস্থা নিশ্চিত না করে সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা/ভবন/ইমারত/অবকাঠামো নির্মাণের সুযোগ কোনো অজুহাতেই দেওয়া যাবে না। এ ক্ষেত্রে নমনীয় হয়ে সর্বনাশ করা হয়েছে। ঢাকা নগরী গাছশূন্য করে ফেলার তৎপরতা রুখতে না পারলে সামনের দিনে বহুমাত্রিক বিপর্যয়ের শিকার হতে হবে- তার বার্তা পাওয়া যাচ্ছে। গাছ রক্ষার ক্ষেত্রে এগিয়ে না এলে প্রাণ বাঁচানোই দায় হতে পারে। আজকের সাহারা মরুভূমি একসময় সবুজ-শ্যামল ভরা ছিল। সবুজ-শ্যামল সাহারা অঞ্চল মরুভূমিতে রূপ নেওয়ার অন্যতম কারণ নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন। প্রাণ বাঁচাতে হলে, মরুকরণ রুখতে চাইলে, গাছ রক্ষা করতেই হবে। গাছ রক্ষার তাগিদে ঘাটতি মহাসর্বনাশ ডেকে আনছে। চৈতন্যোদয় জরুরি। গাছ রক্ষার আন্দোলন সুসংগঠিত করে ছড়িয়ে দিতে হবে- এটাই সময়ের দাবি।

জহির চৌধুরী :কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে