বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তৃণমূলে স্থানীয় সরকার :জবাবদিহিতার সংকট

তৃণমূলের জনগণের রাজনৈতিক অধিকারকে খর্ব করা পথে হাঁটা কতটা যৌক্তিক ভাবতে হবে।
স্বপন দাশ
  ০১ জুন ২০২৩, ০০:০০

বাংলাদেশে এসডিজির স্থানীয়করণ বিষয়ে 'দি হাঙ্গার প্রজেক্ট'-এর গেস্নাবাল টিমের উপস্থিতিতে ১৩ নভেম্বর, ২০২২ সালে ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে কৌশল নির্ধারণের একটি গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। দি হাঙ্গার প্রজেক্ট বাংলাদেশের আয়োজনে এই সেমিনারে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রীসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনে যারা নিরলসভাবে কাজ করছেন এমন বিদগ্ধ ব্যক্তি, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও মাঠপর্যায়ে যারা এ নিয়ে ব্যাপৃত আছেন এমন অনেক ব্যক্তি বা সংস্থার প্রতিনিধিরা সেদিন উপস্থিত ছিলেন। তারা মূল্যবান মতামত দিয়েছেন, অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে নানা চ্যালেঞ্জের কথা তুলে এনেছেন। যা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক। এসডিজি স্থানীয়করণে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা গুরুত্বসহকারে আলোচনায় আসে। সঙ্গতকারণেই স্থানীয় সরকারের ব্যবস্থাপনা, বিকেন্দ্রীকরণ ও চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে কথা উঠেছে। কথা হয়েছে জবাবদিহিতা, দায়বদ্ধতা ও জনগণের মালিকানা বোধ নিয়ে। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহম্মদ তার বক্তব্যে স্পষ্ট উলেস্নখ করেছেন, রাজনীতিকরণের জন্য জবাবদিহিতার জায়গাটি নষ্ট হচ্ছে। এই বিষয়টি নিয়েই আজকের এই আলোচনার অবতারণা।

তোফায়েল স্যার তৃণমূলে অর্থাৎ ইউনিয়ন পর্যায়ে ও উপজেলা পর্যায়ে দলীয় মনোনয়ন বা প্রতীক দিয়ে নির্বাচন করার প্রতিও ইঙ্গিত করেছেন, যা জবাবদিহিতাকে ব্যাহত করেছে। আমি নিজেও এই প্রক্রিয়ার একবার ইউনিয়ন পর্যায়ে এবং বর্তমানে উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচিত হয়ে আসায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছি মনে করেই নানাভাবে চিন্তা করেছি। আসলে কি তাই? রাজনীতিকরণ নাকি উপযুক্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভাবের কারণে এই ধারণা? প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম মহোদয় কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক দায়বোধ না থাকার কারণকে দায়ী করেছেন। একটি রাজনৈতিক জাতীয় সরকারের কিছু এজেন্ডা থাকে বা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে তৃণমূলে বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। সেই এজেন্ডাগুলো জনকল্যাণমুখী কিনা, সেটা জনগণ ভালোভাবে নিয়েছে কিনা সেটি বোঝার জন্য গণমাধ্যমসহ আরও অনেকভাবে যাচাই-বাছাই করার সুযোগ রয়েছে। যে কর্মসূচিগুলো জনবান্ধব বা জনগণ গ্রহণ করেছে সেটি বাস্তবায়নে জনগণকে এই অধিকার দেওয়া উচিত, তারা সিদ্ধান্ত নেবে কার মাধ্যমে এই বাস্তবায়ন সহজতর ও সুষ্ঠু হতে পারে, কার এই দায়বদ্ধতা বা রাজনৈতিক অঙ্গীকার আছে। যেমন- প্রধানমন্ত্রীর দশটি বিশেষ উদ্যোগ যা এই সরকারকে নয় প্রান্তিক পর্যায়ে দেশকে এগিয়ে নিয়েছে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে। এটি কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক স্বদিচ্ছার ফসল। এটি বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ কোনো রাজনৈতিক কর্মী ছাড়া স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত সম্ভব নয়। সম্ভব নয় এগুলো বাস্তবায়নে জনঅংশীদারিত্বকে প্রধান্য দেওয়া। তৃণমূলের জনগণকে এই রাজনৈতিক অধিকার দেওয়া, যাতে তারা তাদের অধিকার বুঝে পেতে পারে সেরকম জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে। আর এটি না হলে অতীতের মতো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকা অবস্থায় গ্রাম সরকারের মতো আর একটি অনির্বাচিত রাজনৈতিক বাহিনী বা যুব কমপেস্নক্সের মতো বাহিনী তৈরি করে সামাজিক সুস্থিতা বিনষ্টের এবং সংঘাতের জায়গা তৈরি করতে আমরা দেখেছি।

বরং সরকারের কোনো কর্মসূচি জনবান্ধব না হলে বা কল্যাণধর্মী কোনো কর্মসূচি বাস্তবায়নে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরা স্বচ্ছতা প্রদর্শনে কার্পণ্য করলে, ব্যর্থ হলে শুধু সেই জনপ্রতিনিধি নয় কেন্দ্রীয় সরকারও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ কারণে, সরকারি দলেরও একটা দায়বদ্ধতা এসে যাবে নির্বাচিতদের কাজ দেখার বা বুঝে নেওয়ার। না হলে দলগতভাবে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে পরবর্তী সংসদীয় নির্বাচনে, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে। বিরোধীরাও এটিকে জনসমক্ষে তুলে ধরে সুবিধা আদায়ে সচেষ্ট হবে। আমি সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম সাহেবের ওই কথাতে আসতে চাই রাজনীতিকরণের কথা বলে জনগণকে অবজ্ঞা করার থেকে খুঁজে দেখতে হবে বিরোধীদের আচরণ কি? বিজয়ী হওয়া ছাড়া নির্বাচন প্রক্রিয়ার থেকে দূরে থাকার নীতি, মাঠ ফাঁকা করতে সমমনাদের উদ্বুদ্ধ করার ও জনগণের প্রতিবাদী চেতনাকে ধ্বংস করার এই সংস্কৃতি গড়ার কারণে ঘটেছে বিপত্তি ও বিপর্যয়। প্রতিরোধ ছাড়া কোনো ডায়ালগ নির্বাচনের ত্রম্নটি দূর করবে না। তেমনটি হলে জনগণের ঐক্যবদ্ধ শক্তিই এবং চেতনাই পারে সব অপশক্তি, অপকর্মকে প্রতিহত করতে।

আজ সরকারের কল্যাণমুখী কর্মসূচি টিকিয়ে রাখাই প্রান্তিক জনগণের মুখ্য বিবেচনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপযুক্ত প্রতিনিধি বাছাইয়ে বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থা দীর্ঘদিনের, বিরোধীদের অনুপস্থিতি শুধু নয়- তাদের এই মানসিকতাকেও জনগণ প্রশ্রয় দিচ্ছে না। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার লড়াইয়ের পাশাপাশি নির্বাচন প্রক্রিয়াকে দূরে ঠেলে লড়াইয়ে সাফল্য আসবে কি ? অনির্বাচিত পন্থায় তৃণমূলে ক্ষমতা বদলে জনগণের আস্থা? কারা ভাবছেন? বর্তমান সরকারি দল দীর্ঘ ২১ বছর অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জাতীয় পর্যায়ে আন্দোলন, সংলাপ ও নানামুখী তৎপরতা দেখিয়েছে, পাশাপাশি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে। বিরোধীদের নির্বাচন বর্জনের বর্তমান নীতি সরকারি দলে যে রসায়নের জন্ম দিচ্ছে সেটিতে রাজনীতিকরণের প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে। সরকারি দলের দলীয় গঠনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে মনোনয়ন প্রক্রিয়া, দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা বা ঐক্য রক্ষার তাগিদে ফাঁকা মাঠে মাইম্যান খোঁজার রাজনীতি প্রাধান্য পেয়েছে। পোড় খাওয়া, পরীক্ষিতদের থেকে হাইব্রিড না সাময়িক সুবিধা প্রাপ্তির জন্য জিন্দাবাদকে প্রাধান্য দেওয়ার এক অপসংস্কৃতি কিছুটা পেয়ে বসেছে। কারণ তাকে শক্ত কোনো বাধা অতিক্রম করতে হচ্ছে না। নিজেদের ভিতর প্রতিবাদ হলে তাকেই বিরুদ্ধবাদী বা হাইব্রিড বলা হচ্ছে। ছলে বলে প্রতিপক্ষ কেউ হলে নানা প্রক্রিয়ায় তাকে বসিয়ে দিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে জনবিচ্ছিন্নতার পথে চলার অভ্যাস রপ্ত করছে। এক্ষেত্রে জনগণের কাছে জবাবদিহিতার সংকট তৈরি হচ্ছে। এটা ওই দলের সংকট। এটা পদ্ধতির সংকট নয়। এ জন্য জনগণের রাজনৈতিক অধিকারকে বিপন্ন করার পথে হাঁটা ঠিক কি? পুরো পদ্ধতির দোষ দেওয়া কতটা সমীচীন? আর এই পরিস্থিতির জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দায়বোধ এড়াতে পারে না।

তৃণমূলের জনগণের রাজনৈতিক অধিকারকে খর্ব করা পথে হাঁটা কতটা যৌক্তিক ভাবতে হবে।

স্বপন দাশ : উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ফকিরহাট, বাগেরহাট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে