ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুর হঠাৎই অস্থির হয়ে উঠেছে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে শুরু হওয়া জাতিগত দাঙ্গায় এ পর্যন্ত শতাধিক মানুষের মৃতু্য হয়েছে। কম জনসংখ্যার এই রাজ্যে এই মৃতু্য বড় ঘটনাই। আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে সহিংসতা এখনো চলছে। বহু ঘরবাড়ি ও যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে, কয়েক হাজার মানুষ বাস্তুচু্যত হয়ে নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সামরিক বাহিনীও মোতায়েন করতে হয়েছে। সর্বশেষ খবর জানার চেষ্টা করি। কলকাতার দৈনিক পুবের কলম অনলাইন ২ জুলাই জানাচ্ছে, গত ৩ মে থেকে শুরু হওয়া জাতিদাঙ্গার ফলে মণিপুরে এখনো পর্যন্ত শতাধিক মানুষের মৃতু্য হয়েছে। উত্তর পূর্বের পাহাড়ি এই রাজ্যে কুকি ও মেইতেই জনজাতির মধ্যে সংঘর্ষের ফলে অশান্তির ঘটনা এখনো ঘটে চলেছে। পত্রিকাটি আরও লিখেছে : বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরম বলেছেন, অসমের মুখ্যমন্ত্রী মণিপুরে না নাক গলালে তা ভালো হবে। রোববার টুইটারে তিনি লিখেছেন, 'অসমের মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছেন যে, এক সপ্তাহের মধ্যে মণিপুরে শান্তি ফিরে আসবে। তবে তা সহজ হবে যদি অসমের মুখ্যমন্ত্রী মণিপুরে সংঘাতে নাক না গলান এবং দূরে থাকেন।' একইসঙ্গে তিনি বলেন, 'যদি বীরেন সিং (মণিপুরের) মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেন এবং কয়েক মাসের জন্য মণিপুরে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয় তাতেও মণিপুরে শান্তি স্থাপনের বিষয়টি সহজ হবে।' এএনআই অনলাইন ৩ জুলাই জানাচ্ছে, বিজেপির সহায়ক দল শিবসেনা (ইউবিটি) এমপি সঞ্জয় রাউত ২ জুলাই বলেছেন, 'প্রধানমন্ত্রী মোদি কেন এখনো মণিপুর সফর করছেন না? কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী মণিপুরে সফর করেছেন কিন্তু তিনি আসেননি। মণিপুরের ঘটনায় চীন জড়িত, আমরা জানতে চাই এ বিষয়ে কেন্দ্র সরকার কি করেছে। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেণ সিংয়ের পদত্যাগ করা ও রাজ্যটিতে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা উচিত।' পত্রিকান্তরে প্রকাশ, বীরেণ সিং পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এদিকে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী দু'দিন সফর করে ত্রাণ বিতরণ করে ফিরেছেন ৩০ জুন। বিরোধী দল মণিপুরের ঘটনায় উদ্বিগ্ন তা তাদের ভাষায় বোঝা যাচ্ছে। বিরোধীদলগুলো মণিপুরের ঘটনায় নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি সরকারের সমালোচনা করেছে এবং এই দাঙ্গার জন্য সরকারকেই দায়ী করেছে। ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোতে সংঘাত হলে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও উদ্বেগ থাকা স্বাভাবিক। রাজ্যটি সম্পর্কে সাধারণ কিছু তথ্য দিয়ে মূল আলোচনায় যাব। মণিপুর উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি রাজ্য। সেভেন সিস্টার্স বলা হয় যে সাত রাজ্যকে তার একটি। রাজধানী ইম্ফল। এ রাজ্যের উত্তরে নাগাল্যান্ড, দক্ষিণে মিজোরাম, পশ্চিমে আসাম ও পূর্বদিকে মিয়ানমার। আয়তন ২২ হাজার ৩২৭ বর্গকিলোমিটার। মৈতেই উপজাতি এ রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী (জনসংখ্যার ৬০%)। মণিপুরি বা মৈতেইরা পাঁচটি সামাজিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত। মৈতেইদের মধ্যে সনাতন ধর্মাবলম্বী বা হিন্দুই বেশি। তবে কিছু খ্রিস্টান ও মুসলমানও আছেন। মারুপ (মৈতেই সংস্কৃতি ও ধর্মে বিশ্বাসী), মৈতেই খ্রিস্টান, মৈতেই গৌর চৈতন্য (মৈতেই ও হিন্দুধর্ম উভয়েই বিশ্বাসী), মৈতেই ব্রাহ্মণ (স্থানীয় নাম 'বামোন' ) ও মণিপুরি মুসলমান (স্থানীয় নাম মিয়া মৈতেই বা পাঙাল)। মণিপুরি ভাষা তাদের মাতৃভাষা এবং রাজ্যের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা। এখানে রাজতন্ত্র ছিল। পীতাম্বর চারাইরঙবা প্রথম রাজা। ১৮২৪ সালে বার্মার আসাম আক্রমণ থেকে নিষ্কৃতি পেতে মণিপুর রাজ গম্ভীর সিং ব্রিটিশ সাহায্য চাইলে তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম আমহার্স্ট'র নেতৃত্বে প্রথম অ্যাংলো-বার্মা যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের পর মণিপুর ভারতের একটি দেশীয় রাজ্য হিসেবে ব্রিটিশ রাজের অঙ্গীভূত হয়। ১৮৯১ সালে রাজা কুলচন্দ্র সিং-এর সময়কালে লর্ড ল্যান্সডাউনের সময়কালে ব্রিটিশদের সঙ্গে বিরোধ বাঁধে। ১ বছরের মধ্যে তিনি অপসারিত হন। তার নাবালক পুত্র চূড়াচন্দ্র সিং ক্ষমতায় আসেন। বোধচন্দ্র সিং এই রাজত্বের শেষ রাজা। ১৯৪৭ সালে মণিপুর স্বাধীন রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশের ইচ্ছা প্রকাশ করে। বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) আগ্রাসী মনোভাবে ১৯৪৯ সালে রাজা বোধচন্দ্র সিং ভারত অন্তর্ভুক্তির সম্মতিপত্রে সই করেন। ১৯৫৬ সালে এটি ভারতের কেন্দ্র শাসিত রাজ্য হয়, ১৯৭২-এ পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পায়। জনসংখ্যা ৩০ লাখের মতো। রাজ্যে বিধান সভার আসন সংখ্যা ৬০। বর্তমানে বিজেপি রয়েছে ক্ষমতায়। যা জানা যাচ্ছে বিজেপি সরকারই রাজ্যে সংকটের মূলে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার দাবি করা হলেও মণিপুরে অস্থিতিশীলতার দুই মাস পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি জটিলই রয়ে গেছে। জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যময় ও প্রান্তিক এই জনপদে দশকের পর দশক ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, সহিংসতা ও প্রান্তিকীকরণের রাজনীতি সেখানকার মূল সংকট হয়েই থেকে গেছে। এই রাজ্যে এখনকার অস্থিতিশীলতার নেপথ্যে আসলে কি সে সম্পর্কে সিএনএন জানায়, গত ৩ মে মণিপুরের চন্দ্রচূড় জেলায় হাইকোর্টের একটি আদেশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেয় রাজ্যের আদিবাসী ছাত্রদের ইউনিয়ন 'অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন' (এটিএসইউএম)। ওই মিছিলে স্থানীয় নাগা ও কুকি সম্প্র্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ অংশ নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের সঙ্গে রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্র্রদায় মৈইতেই বা মণিপুরীদের সংঘর্ষ বাঁধে এবং তা দাঙ্গায় রূপ নেয়। মণিপুরের ৩৬ লাখ জনগোষ্ঠীর ৫৩ শতাংশই মৈইতেই জাতিগোষ্ঠীর সদস্য, যারা মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বী বা হিন্দু সম্প্র্রদায় হিসেবে চিহ্নিত। মণিপুরে মৈইতেইরা 'শিডিউলড ট্রাইব' (তফসিলি জাতিগোষ্ঠী) হিসেবে গণ্য হয় না। যে কারণে সরকারি চাকরি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থায় 'সংরক্ষণ সুবিধা'র সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হয়ে আসছে বলে দাবি মৈইতেইদের। ভারতে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে সেদেশের সংবিধানে এই 'শিডিউলড ট্রাইব' স্বীকৃতির বিধান রাখা হয়েছে। সংবিধানে 'শিডিউলড কাস্ট' (ভারতে যারা মূলত দলিত বা হরিজন সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে পরিচিত) ও 'শিডিউলড ট্রাইব' ভারতের রাজনীতিতে দীর্ঘদিনের আলোচনার বিষয়বস্তু। ভারতে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী হিসেবে পরিগণিত হলেও মণিপুরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় মৈইতেইদের 'শিডিউলড ট্রাইব' স্বীকৃতি দিলে অন্য সংখ্যালঘু আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর জন্য ওই রাজ্যে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে- এই আশঙ্কা থেকে মৈইতেইদের 'শিডিউলড ট্রাইব' স্বীকৃতির বিরোধিতা করছে রাজ্যের অন্য আদিবাসী সংখ্যালঘুরা, যাদের একটি বড় অংশ ধর্মীয়ভাবে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। এদিকে মৈইতেই সম্প্রদায় 'শিউউলড ট্রাইব' হিসেবে শ্রেণিভুক্ত হওয়ার জন্য গত কয়েক বছর ধরেই দাবি জানিয়ে আসছিল। ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপিও মৈইতেইদের এই দাবির পক্ষে সহানুভূতিশীল। তাদের এই দাবিকে সমর্থন জানিয়েই মণিপুরে বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে সেখানে সরকার গঠনও করেছে বিজেপি। এই নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম হওয়ার মধ্যেই গত এপ্রিল মাসে মণিপুর হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে মৈইতেইদের দাবি বিবেচনার নির্দেশ দেয়। কিন্তু রাজ্যের অন্য আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এতে উদ্বেগ সৃষ্টি হয় এবং হাইকোর্টের ওই আদেশের প্রতিক্রিয়ায় মণিপুরের অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়নের ডাকা মিছিল শুরু হলে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সহিংস সংঘর্ষের ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, উন্মত্ত জনতা বিভিন্ন ঘরবাড়ি ও যানবাহনে আগুন দিচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা সিএনএনকে জানিয়েছে, তাদের ঘরবাড়ি ও গির্জা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভীত-সন্ত্রস্ত পরিবারগুলো সহিংসতাপূর্ণ এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে এবং অনেকেই সামরিক বাহিনীর আশ্রয় শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। সংঘর্ষের জেরে ৩ মে মণিপুরজুড়ে প্রায় ৩৬ লাখ বাসিন্দার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সব গোষ্ঠীকে শান্তি বজায় রাখার অনুরোধ জানানো হয়। রাজ্যের সাধারণ নাগরিকরা জানাচ্ছেন, সেখানে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। রাজ্যে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকার দাঙ্গার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে 'উপায়ান্তর' না পেলে 'দেখামাত্র গুলি করার' নির্দেশ জারি করে। আগেই বলেছি, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে 'সেভেন সিস্টার্স' নামে পরিচিত যে সাতটি রাজ্য রয়েছে তার একটি মণিপুর। মণিপুরের পূর্বাংশে মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে এবং ওই সীমান্তে যথেষ্ট অস্থিরতাও রয়েছে। বাংলাদেশের সিলেট থেকে পূর্ব দিকে আসামের শিলচর জেলা পার হয়ে মণিপুর রাজ্যের সীমানা শুরু। বাংলাদেশের সঙ্গে মণিপুরের সীমান্ত নেই। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতে 'প্রিন্সলি স্টেট' হিসেবে যে রাজ্যগুলোর মর্যাদা ছিল, তার একটি মণিপুর। কাশ্মীরের মতো মণিপুরও ভারত স্বাধীন হওয়ার পরপরই ভারতে যুক্ত হয়নি। বরং ১৯৪৯ সালে তারা ভারতের যুক্তরাজ্য ব্যবস্থায় যুক্ত হয়। মণিপুরের শাসক মহারাজা বুদ্ধচরণ ভারত সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে চুক্তি সই করেন। আর তা থেকেই ওই রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদের আন্দোলনেরও সূত্রপাত। তবে গত মে মাসে শুরু হওয়া দাঙ্গা ও সহিংস পরিস্থিতি গত কয়েক বছরের মধ্যে সেখানে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। সহিংসতা মাথাচাড়া দেওয়ার কারণ কী? নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইম্ফলের এক আদিবাসী যুব নেতা সিএনএনকে বলেন, তাদের বাড়ি লুটপাট করে ভাঙচুর করা হয়েছে এবং পরিবারকে সামরিক আশ্রয় শিবিরে শরণার্থী হতে বাধ্য করা হয়েছে। তিনি বলেন, 'আমরা এখানে যা দেখছি, দুর্ভাগ্যজনক হলেও মনে হচ্ছে, খুবই পরিকল্পনামাফিকই এই দাঙ্গা বাধানো হয়েছে এবং বিরোধীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। তারা স্পষ্টভাবে জানে কোন বাড়িগুলোতে সংখ্যালঘু আদিবাসী সম্প্র্রদায়ের লোকজন বাস করে এবং সেখানেই হামলা ও অভিযান চালানো হচ্ছে।' দ্বন্দ্ব কোথায়? মণিপুরে মৈইতেই এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদটি রাজনৈতিক ও ভৌগোলিকভাবে স্পষ্ট। গত সপ্তাহের দাঙ্গায় এই বিভেদের চিত্রটি সামনে এলেও দুই পক্ষের মধ্যকার উত্তেজনা দীর্ঘদিনের এবং ভূমি অধিকার, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এই দূরত্ব ও বিভেদ চলছে। রাজ্যে সরকার এবং প্রশাসনের বিভিন্ন পদে মৈইতেইদের আধিপত্য চোখে পড়ার মতো এবং সেখানে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নতির সুবিধা অন্য আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর তুলনায় তারাই বেশি ভোগ করে। সম্প্র্রতি বিজেপি ক্ষমতা গ্রহণের পর সেখানে হিন্দু ও খ্রিস্টানদের মধ্যে ধর্মীয় সাম্প্র্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির প্রবণতা স্পষ্ট হয়েছে। 'শিডিউলড ট্রাইব' না হওয়ায় মৈইতেইরা সংরক্ষিত এলাকায় ভূমির মালিকানা নিতে পারে না। এখন মণিপুর হাইকোর্টের রায়ের পর নাগা ও কুকি সম্প্র্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, এই দাবি পূরণ হলে তারা সরকারের বিভিন্ন সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় প্রতিযোগিতায় পড়বে এবং মৈইতেইরা তাদের এলাকায় ভূমি দখল করতে শুরু করবে। তার ওপর ভূ-রাজনৈতিক সংকট তো রয়েছেই। ২০২১ সালে প্রতিবেশী মিয়ানমারে সামরিক অভু্যত্থান ও সামরিক বাহিনীর অভিযানের ফলে সেদেশের আদিবাসী গোষ্ঠী চীন সম্প্র্রদায়ের অনেকে সীমানা পেরিয়ে মণিপুরে আশ্রয় নেয়। মণিপুরের কুকিরা, যারা জাতিগতভাবে চীন সম্প্র্রদায়ের সমগোত্রীয়, বলছে, ভারতে আশ্রয় নেওয়া এই শরণার্থীদের বিরুদ্ধে অনৈতিক অভিযান পরিচালনা করছে রাজ্য সরকার। যে কারণে কুকিরা নিজেদের জতিগত বিদ্বেষের শিকার ভাবছে এবং অসহায়বোধ করছে। কী বলছে প্রশাসন? মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেণ সিং বলেছেন, তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে ধারাবাহিক যোগাযোগ বজায় রেখে চলছেন এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে বলেও দাবি করেন তিনি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ইনডিয়া টুডেকে বলেন, মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই আছে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ভয় পাওয়ার বা শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। সর্বশেষ পরিস্থিতি কী? রাজ্যজুড়ে বিচ্ছিন্নভাবে এখনো সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। কুকি সম্প্রদায়ের কিছু বসতিতে বাঁশ-কাঠের ব্যারিকেড দিয়ে সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। মণিপুরের অনেক বাসিন্দাই প্রাণ বাঁচাতে পাশের রাজ্য নাগাল্যান্ড, মিজোরাম ও মেঘালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের অনেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে বলে রয়টার্স জানিয়েছে। মণিপুরের ঘটনায় ভারতের বিরোধী দলগুলো বসে নেই। সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল পাঠানোর দাবি করেছিল বিরোধী দল কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেসসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ২৪ জুন এক বৈঠকে বিরোধী নেতারা বলেন, সরকারের উচিত কোনো টালবাহানা না করে অবিলম্বে অস্ত্র উদ্ধারের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সেসব অস্ত্র একে অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। মণিপুরের তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেস নেতা ইবোবি সিং বলেন, এর পাশাপাশি সরকারকে দ্রম্নত ত্রাণ ও পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত করতে হবে। মণিপুরবাসীকে বোঝাতে হবে, তারা দেশের মূলধারার অঙ্গ। তিনি বলেন, দুঃখের বিষয় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতা আজ মণিপুরকে এই অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, যা ছিল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, ক্রমে তা সাম্প্র্রদায়িক দাঙ্গায় পরিণত হয়েছে। তাদের দাবির পর আর সহিংসতা শুরুর ৫২ দিন পর কেন্দ্রীয় সরকার সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে। অথচ ৪ মে থেকে কংগ্রেস এই দাবি জানিয়ে আসছে। বিরোধীরা প্রত্যেকেই বলেন, সরকার কতটা উদাসীন, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নীরবতা। বিজেপি শাসিত একটা রাজ্য দেড় মাস ধরে জ্বলছে, অথচ প্রধানমন্ত্রী নির্বিকার! রাজ্যের পরিস্থিতি কেমন ও সরকার এতদিন ধরে সামাল দিতে কী কী করেছে, বৈঠকে বিরোধীদের কাছে সরকারের পক্ষে তার খতিয়ান তুলে ধরা হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কীভাবে প্রতিদিন খবর নিচ্ছেন, তা জানানো হয়। কিন্তু সরকারবিরোধীদের দাবি মেনে সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল পাঠানোর বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। বিরোধী নেতাদের জানানো হয়, মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে রাজ্যের সীমান্তে ১০ কিলোমিটারজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ছাড়াও ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সংসদীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশি। উপস্থিত ছিলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা। একমাত্র মণিপুরী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তিনবারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেস নেতা ইবোবি সিং। অন্যদের মধ্যে ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সদস্য ডেরেক ওব্রায়ান, আম আদমি পার্টির সাংসদ সঞ্জয় সিং, শিবসেনা (উদ্ধব) মুখপাত্র প্রিয়াংকা চতুর্বেদী, ডিএমকের তিরুচি শিবা, আরজেডির মনোজ ঝা, সিপিএমের জন ব্রিটাস, এআইএডিএমকের এম থাম্বিদুরাই, এসপির সাংসদ রামগোপাল যাদব প্রমুখ। মণিপুরের সংখ্যাগুরু মৈইতেই সম্প্র্রদায়কে তফসিলি উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় কিনা, তা খতিয়ে দেখতে হাইকোর্ট একটা সুপারিশ করার পর থেকে সহিংসতা চলছে। তবে ইতোমধ্যে বিজেপিরই এক বিধায়ক মৈইতেই সম্প্রদায়ের জন্য তফসিলি উপজাতির মর্যাদা সম্পর্কিত মণিপুর হাইকোর্টের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন করেছেন। মণিপুর বিধানসভার পার্বত্য অঞ্চল কমিটির (এইচএসি) চেয়ারম্যান, ডিঙ্গাংলুং গ্যাংমেই যিনি রাজ্য বিধানসভায় ক্ষমতাসীন বিজেপিরই একজন এমএলএ-ও বটে, তিনি তার আবেদনে বলেছেন, তফসিলি উপজাতির তালিকায় কোন সম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত হবে বা হবে না, তা দেখার এবং বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব একমাত্র রাজ্য সরকারের, হাইকোর্টের নয়। হাইকোর্টের অপ্রীতিকর আদেশের ফলে মণিপুরে অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন সংকটের বীজ যেখানে লুকায়িত সে বিষয়টা সামনে এনে সুরাহা করতে চাইলে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ভালো করবেন। পাশে চীন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভালো নয়। চীন মণিপুর ঘটনায় জড়িত এমন অভিযোগও করা হয়েছে। সাম্প্রতিক কিছু কর্মকান্ডে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কেরও অবনতির শঙ্কা আছে। তাছাড়া দেশটিতে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজমান। বাংলাদেশের কোনো স্বার্থহানির আপাত শঙ্কা না থাকলেও সেভেন সিস্টার্স ঘটনাবলি বাংলাদেশের বিশ্লেষকদের শঙ্কিত করে বটে। সব মিলিয়ে মণিপুর পরিস্থিতি শান্ত হলে সবার জন্যই ভালো। আহমদ মতিউর রহমান : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক