একটি রাষ্ট্রের জন্য যে ধরনেরই হোক একটি সরকার অপরিহার্য। গণতন্ত্র অপরিহার্য নয়। অনেক রকম সরকারপদ্ধতির মধ্যে গণতন্ত্রও একটি পদ্ধতি মাত্র। গণতন্ত্র একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা। হাজার হাজার বছর পৃথিবীতে রাষ্ট্র ছিল, গণতন্ত্র ছিল না। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বয়স সবচেয়ে কম। একটি রাষ্ট্রে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম সরকার থাকতে পারে। রাজতন্ত্র-সামজতন্ত্র অতীতের বিষয়। সামরিক সরকার থাকতে পারে। অগণতান্ত্রিক অসামরিক সরকার থাকতে পারে। আধা সামরিক, আধা গণতান্ত্রিক সরকার থাকতে পারে। সাংবিধানিক সরকারই যে থাকবে সব সময়, তার নিশ্চয়তা একেবারেই নেই; অসাংবিধানিক সরকার দ্বারাও দেশ পরিচালিত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, মোটেই সমর্থনযোগ্য না হলেও, বেশ ভালোভাবেই চলে। বাংলাদেশের হতভাগ্য মানুষের নিয়তি এমনই যে, সব ধরনের সরকার দ্বারাই তারা শাসিত হয়েছে। স্বাধীনতার আগেও হয়েছে, স্বাধীনতার পরেও হয়েছে এবং হচ্ছে। গণতন্ত্রের স্বাদ ছাড়া আর সব রকম সরকারের স্বাদই তারা পেয়েছে। রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক সরকার না থাকাটা অস্বাভাবিক নয়, যদিও থাকাটাই কাম্য। তবে গণতন্ত্রহীনতা এক কথা আর রাজনীতিহীনতা আরেক কথা। এবং বিরাজনীতি সম্পূর্ণ আরেক জিনিস। বাংলাদেশের মানুষ সামরিক একনায়কত্ব দেখেছে। কিন্তু সেই সামরিক শাসনের মধ্যেও রাজনীতি ছিল। রাজনৈতিক কর্মকান্ডে বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও রাজনীতি ছিল। সে রাজনীতি ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতি। বাংলাদেশে কিছুকাল যাবত বেসামরিক সরকার আছে, সংসদ আছে, গণতন্ত্রও আছে। বাংলাদেশ এখন বিরাজনীতির পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। বিদেশিদের পরিকল্পনামতো বাংলাদেশকে বিরাজনীতিকরণ শুরু করেছিল চারদলীয় জোট সরকারের সময়, এক যুগ পরে এখন সে পরিকল্পনা পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নের পথে। যে নেতারা সেদিন বিরাজনীতিকরণ পরিকল্পনাকে প্রতিহত করেছিলেন, এখন তারাই রাষ্ট্রকে রাজনীতিশূন্য করার জন্য সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন। রাজনীতির মাধ্যমেই এ দেশের জনগণ ও নেতারা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেন। রাজনীতির মাধ্যমেই পাকিস্তানি সিকি-ঔপনিবেশিক ও পরিপূর্ণ সামরিক স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। স্বাধীনতার পর অসামরিক ও সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজনীতিই ছিল জনগণের অধিকার আদায়ের একমাত্র রক্ষাকবচ। যদি দেশে রাজনীতি না থাকতো, তাহলে আজও ইংরেজ লেফটেন্যান্ট গভর্নরই কলকাতার রাজভবনে বহাল তবিয়তে থাকতেন অথবা ঢাকার বঙ্গভবনের ওই বাড়িতে পাঞ্জাবিদের লেফটেন্যান্ট জেনারেল কেউ গভর্নর হয়ে থাকতেন। একজন মুখ্যমন্ত্রী ও জনা কয়েক মন্ত্রী থাকতেন তার অধীনে। অথবা তা-ও থাকতেন না। থাকতেন ওমরাও খান বা টিক্কা খানের মতো একজন আঞ্চলিক সামরিক আইন প্রশাসক। স্বশাসিত বা স্বাধীনতার মুখ পৃথিবীর সেরা মুখ। জনগণের নির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা শাসিত হওয়ার আনন্দ অন্য রকম। বহু পরাধীন জনগোষ্ঠীই খেয়ে পরে ভালো আছে। স্বাধীনতার সুখটা থেকে তারা শুধু বঞ্চিত। কোনো কোনো স্বৈরশাসনের মধ্যে বা একনায়কত্বে সাধারণ মানুষ পেট ভরে খায়, সন্ধ্যায় প্রিয়জনদের নিয়ে নদীর তীরে অথবা পার্কে হাওয়া খায়, রাতে শান্তিতে নাক ডেকে ঘুমায়, নিরাপদে পথেঘাটে চলাফেরা করে। সে ধরনের শাসনে বিপদ ও ভয় শুধু সরকারবিরোধী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের। তাদের প্রতি সরকারের শ্যেনদৃষ্টি থাকে। তাদের ফাটকে ঢোকায় অথবা ফাঁসিকাষ্ঠে লটকায়। দমন-পীড়ন তাদের ওপর দিয়েই যায়। সাধারণ মানুষ আথালে বাঁধা গরুর মতো খেয়ে দেয়ে ভালোই থাকে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকর থাকলে খুব ধীরে ধীরে একটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে ও সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে উন্নতি করে। আমরা উন্নতি চাই, আগ্রগতি চাই ও রাজনীতিতে অ্যাকটিভ থাকতে চাই। বাংলাদেশের জনগণ রাজনীতি বুঝে। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রচলিত আছে। জনগণ রাজনীতি করছে, দল করছে। দেশব্যাপী বিভিন্ন দলের অফিস ও সাংগঠনিক কার্যক্রম আছে। নির্বাচন কমিশন আছে সময় মতো নির্বাচন অনুষ্ঠান হচ্ছে। দেশের সরকার রাজনৈতিক দল নির্বাচনমুখী। সাংবিধানিক ভাবে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্রকে অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীন সার্বভৌম দেশকে রক্ষার করার জন্য নিজের তাজা রক্ত দিতেও পিচ পা হয় না। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা কোনোভাবেই দেশের জনগণ ষড়যন্ত্রের শিকার হতে দেবে না। বাংলাদেশ পৃথিবীর মধ্যে আলোচিত একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। এখানে মাটির নিচে এবং উপরে বহু প্রকারের খনিজসম্পদ রয়েছে। সৃষ্টি কর্তার অপার মহিমায় বাংলাদেশ সম্ভাবনাময়ী একটি দেশ। এ দেশ নিয়ে দেশের মানুষ যেভাবে গর্ব করে সেভাবে এগিয়ে নিতে ও পিছু হাঁটবে না। এ দেশের অব্যাহত উন্নতি অগ্রগতি দেখে অনেকের মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম। ফলে বাংলাদেশবিরোধী চক্রান্ত ষড়যন্ত্র চলমান আছে। ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করছে সরকার ও জনগণ। হাজার চক্রান্তের মধ্যে বাংলাদেশের অব্যাহত অগ্রগতি এগিয়ে চলছে। দেশবিরোধী যে কোনো চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের মধ্যেও সঠিক সময়ে নির্বাচন গণতন্ত্রচর্চা জনগণের মধ্যে বিদ্যমান। অর্থনৈতিকভাবে এই অঞ্চলের অনেক দেশের চেয়েই বাংলাদেশের অবস্থান ভালো, সে কৃতিত্ব কোনো সরকারের নয়। সব সরকারই রুটিন কাজ করছে। আজ বাংলাদেশের তুলনামূলক ভালো অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য ব্যক্তিগত, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগই প্রধান। এনজিওগুলোর ভূমিকা ও ভালো। গণতান্ত্রিক রাজনীতির উপহার বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সেই গণতন্ত্রই যদি শেষ হয়ে যায়, রাজনীতিই যদি না থাকে, তাহলে সেই স্বাধীনতা জনগণের কাছে অর্থহীন হয়ে পড়বে। যে অর্থনৈতিক উন্নতিতে লাভবান হয় অন্যান্য দেশ, বহুজাতিক কোম্পানি ও দেশের অল্পসংখ্যক মুৎসুদ্দিগোছের মানুষ, তা দিয়ে জনগণের লাভ কী? যে অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নষ্ট হয়, সে উন্নতিতে ফায়দা কী? সরকারি দলের এক নেতাই বলেছেন, রাজনীতি অরাজনৈতিক লোকের হাতে চলে গেছে। গেল কেন? সে দায় তো তিনিও এড়াতে পারেন না। যে দেশে ওয়ার্ড বয় সার্জনের দায়িত্ব পালন করে এবং অপারেশন করতে গিয়ে মানুষ মারে এবং তার সাজা হয় না, সে দেশে রাজনীতিকের দায়িত্ব অরাজনৈতিক লোকেরাই এবং বহুজাতিক কোম্পানির কর্মকর্তারাই পালন করবেন। রাজনীতি রাজনীতিবিদদের জন্য। অরাজনৈতিক লোক দিয়ে দল ও দেশ চালানো যায় না। কিন্তু দেশের রাজনীতি ও সরকারে তাই চলছে। এটা কোনোভাবেই জনগণ মেনে নিতে পারে না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জবাবদিহিতা থাকা চাই। সরকারের মন্ত্রিপরিষদের দপ্তরের কার্যক্রমের হিসাব নিতে হবে। ইচ্ছে করে কোনো মন্ত্রী সিন্ডিকেট করে মূল্যবৃদ্ধি করতে পারে না। সিন্ডিকেট বাণিজ্যকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী প্রশ্রয় দিতে পারে না। থাকে আইনের আওতায় জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। জনগণের মৌলিক অধিকার রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। ভোট প্রদান ভোটের আমেজ এবং অধিকার থাকতে হবে। গণতন্ত্রের সুরক্ষা জনগণের অধিকার ভোট নামক সংস্কৃতির চর্চা সঠিকভাবে থাকা চাই। গণতন্ত্রের নামে যে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণ। দেশের জনগণ জাতীয় আন্তর্জাতিক কোনো ষড়যন্ত্রের কাছে মাথানত করবে না। আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব আমরাই দেখব। \হঅয়াচিতভাবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ জনগণ কোনোভাবেই মেনে নেবে না। আন্তর্জাতিক সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা বাংলাদেশের রাজনীতি নির্বাচন ও সরকার দেশের জনগণেই ঠিক করবে। কোনো ধরনের চাপাচাপি অহেতুক হস্তক্ষেপ আন্তর্জাতিকভাবে রাজনীতিবিরোধী। এ ধরনের কালচার শিষ্ঠাচার বহির্ভূত অপতৎপরতা থেকে সংশ্লিষ্ট সবার বিরত থাকা চাই। মাহমুদুল হক আনসারী :কলাম লেখক