শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

কমছে পাঠক বাড়ছে নোমোফোবিয়া

সুমন চৌধুরী কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক শিক্ষার্থী শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
  ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০
কমছে পাঠক বাড়ছে নোমোফোবিয়া

'বই আছে পাঠক নাই' বই পড়ার জগতে এত নিষ্ঠুর বাক্য হয়তো দ্বিতীয়টা নাই। উক্ত বাক্যটি দৃষ্টিগোচর বা শোনামাত্র অনেকের স্বাভাবিক অনুভূতি হলেও ভালো পাঠকদের কাছে মর্মস্পর্শী অনুভূতি হবে তা নিঃসন্দেহে বলতে পারি। কমছে পাঠক, বাড়ছে নোমোফোবিয়া। মুঠোফোন ব্যবহার করতে না পারা অথবা মুঠোফোন ছাড়া থাকার ভয় থেকে তৈরি হওয়া আতঙ্ক বা উদ্বিগ্নতাকে নোমোফোবিয়া বলা হয়। বাড়ছে প্রযুক্তি, কমছে বই পড়ুয়া। ফলাফলস্বরূপ, হ্রাস পাচ্ছে স্মৃতিশক্তি, উদ্ভাবনী দক্ষতা, নূতনত্ব, সৃজনশীলতা ও ব্যয় হচ্ছে মূল্যবান সময়। বর্তমানে আমরা এমন এক সময় অতিবাহিত করতেছি যখন কাগজে ছাপানো এক গুচ্ছ পৃষ্ঠার সমন্বয়ে তৈরি চকচকে বইগুলোর ইচ্ছাকৃত পরিবর্তক ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। দেশের বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিটা জেলা-উপজেলার প্রধান গ্রন্থাগারসহ ইত্যাদি স্থানে বই আছে, কিন্তু নেই বই পড়ার নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রাণ। গ্রন্থাগারের এমনও জায়গায় বই আছে যা গত কয়েক বছরে খোলাই হয় নাই। শুধু তাই নয়, বরং খুব প্রয়োজন ছাড়া বাজারের বিভিন্ন দোকান থেকে প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ্যক্রমের বাইরের বই কিনছে না বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী শিক্ষকের দেওয়া বিভিন্ন বই নতুন করে না কিনে, শ্রেণিতে পড়ানো গুরুত্বপূর্ণ কাগজ প্রিন্ট না করে মুঠোফোন বা কম্পিউটারে পিডিএফ করা নামক বিকল্প সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলে ব্যক্তির বা শিক্ষার্থীর খুব বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছেই সঙ্গে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে সবচেয়ে আপন বন্ধু বই। যে বই পড়া মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ শখ ছিল বর্তমানে বই পড়া হয়েছে এক রকম জোর করে কাজ করা, আগে সাহিত্যের রস উপভোগ করার জন্যও বই পড়া হতো আর এখন বই পড়া মানে শিক্ষার ফল লাভ করার আশা। লাইব্রেরিকে স্কুল-কলেজের ওপর স্থান দেওয়া, লাইব্রেরি হাসপাতালের চেয়ে কম উপকারী নয় এমন অনেক কিছু লেখক প্রমথ চৌধুরী 'বই পড়া' প্রবন্ধকে কেন্দ্র করে লিখেছিলেন। ওই ভদ্র লেখক আজ আমাদের মাঝে নেই, থাকলে বইয়ের এই দুর্ভিক্ষ, বইয়ের প্রতি মানুষের বর্তমান এত উদাসীনতা দেখে খুবই কষ্ট পেতো।

বই অনীহার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে আমাদের মুঠোফোন। মুঠোফোনে খুব বেশি আসক্ত বিষয়টাই নোমোফোবিয়া। শিশু-কিশোর-যুবক-বৃদ্ধা সবাই আমরা মুঠোফোনে আসক্ত। বিশেষ করে শিশু-যুবকদের মধ্যে নোমোফোবিয়ার শতাংশ বেশি। ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমানোর পূর্ব পর্যন্ত মুঠোফোনের বিশ্রাম নাই এমনকি অনেকেই রাতে পর্যাপ্ত না ঘুমিয়ে মুঠোফোনের খারাপ ব্যবহার করে। চব্বিশ ঘণ্টার বেশির ভাগ সময়ই ব্যস্ত থাকি ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার, লিংডিন, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপসহ ইত্যাদি মিডিয়ায়। আর মোবাইল গেম আসক্তি ব্যক্তি যে খুবই মারাত্মক নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সব ধরনের আসক্তির ফলে আমরা পড়তে গেলে মুঠোফোন, খেতে গেলে মুঠোফোন, খেলতে গেলে মুঠোফোন, এমনকি ঘুমাতে গেলেও মুঠোফোন ব্যবহার না করে পারছি না।

সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের এক-তৃতীয়াংশ (৩৪ দশমিক পাঁচ শতাংশ) চরম মাত্রায় নোমোফোবিয়ায় আসক্ত। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের এ আসক্তি সবচেয়ে বেশি। গবেষণায় আরও উলেস্নখ করা হয়, মাত্রাতিরিক্ত এবং অসচেতন ব্যবহার যুবসমাজকে নোমোফোবিয়ার দিকে ধাবিত করে। যেটাকে একধরনের 'মানসিক সমস্যা' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত হন তারা মুখোমুখি কীভাবে একজন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে হয় তা ভুলে যান।

পরিশেষে, আমার সবার নিকট অনুরোধ থাকবে শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত সবাইকে নোমোফোবিয়া নামক নীরব ঘাতক থেকে সচেতন রাখার জন্য। যেহেতু আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ, তাই শিশুর শারীরিক-মানসিক সুস্থতা চিন্তা করে, শিশুর উন্নতির চিন্তা করে নোমোফোবিয়া থেকে দূরে রেখে বই পড়ার মাধ্যমে শিশুর বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলব। সর্বোপরি আমাদের আগামী প্রজন্ম যাতে বলতে পারে বাড়ছে পাঠক, কমছে নোমোফোবিয়া এমন বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।

সুমন চৌধুরী

কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক

শিক্ষার্থী

শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে