৪১তম বিসিএস-এর ফলাফল ঘোষণার পর দেখা গেল অসংখ্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন।
অনেকেই আবেগ নিয়ে পোস্ট দিয়েছেন, শিক্ষকতা মহান পেশা। এই পেশা ছেড়ে ক্যাডার হওয়ার দরকার কী?
যারা এই আবেগ প্রকাশ করেছেন তারা কেন তাদের সবকিছু ছেড়ে এই পেশায় চলে আসেন না?
সদ্য অবসরে যাওয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক তার হতাশার কথা প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন, 'শিক্ষকরা এখন এক দাবি এবং সবাই এক হয়ে এক জায়গায় বসবেন এমনটা আমি আর আশা করি না। কারণ ৩৩ বছর প্রাথমিক শিক্ষকদের তাদের সংগঠনগুলো কাছে থেকে দেখলাম তো তাই।
একটা বাস্তব ঘটনা শুনুন, আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। পাশাপাশি গ্রামে আমাদের জন্ম। সে এইচএসসি পাস করে কৃষি ব্যাংকে জব শুরু করে। সম্ভবত ১৭নং গ্রেডে। পদোন্নতি পেতে পেতে ৫নং গ্রেড নিয়ে গত ৩১ জুলাই অবসরে যায়।
যাইহোক, এই যে সহকারী শিক্ষকগণের ডিজি পর্যন্ত পদোন্নতি এই উর্বর মস্তিষ্ক সম্পন্ন শিক্ষক নেতাদের দিয়ে আর যাইহোক শিক্ষকদের কতটুকু উন্নতি হবে আমি জানি না। চার লাখের মতো শিক্ষক ২৫ বছরেও যারা একটা পদোন্নতি পেয়ে প্রধান শিক্ষক হতে পারেন না সেই সব শিক্ষক (পদোন্নতির সব ব্যবস্থা অবারিত থাকলেও) কয় জনমে কতজন শিক্ষক পদোন্নতি পেয়ে টিও, ডিপিও, ডিজি নয়- মাত্র এটিও হতে পারবেন তার একটা হিসাব দিলে আমি কৃতার্থ হতাম।
আমি ক্ষীণ স্বরে হলেও বলেছিলাম সব শিক্ষক যেন একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর গ্রেড উন্নয়নের আওতায় আসে তার ব্যবস্থা করা।
১০ গ্রেড তো হয়েছিলই কিন্তু প্রজ্ঞাপনের আগেই মাঠ পর্যায়ে বিশৃঙ্খলতার অজুহাতে তা আর আলোর মুখ দেখনি। যাইহোক, ফিরে আসি সেই কৃষি ব্যাংকে আমার এক সিনিয়র এবং এক জুনিয়র ভাই তারাও সেই সমসাময়িকে কৃষি ব্যাংকে একই পদে জব শুরু করে ৫ এবং ৬ গ্রেডে অবসরে গেছেন। জানা মতে ব্যাংকের সবার গ্রেড উন্নয়ন হয়।
আমরা সেই রকম ব্যবস্থায় যেতে পারলাম না।
একটু ভাবুন তো- 'সব শিক্ষকের সম্মান এবং আর্থিক উন্নয়নের জন্য ডিজি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকব, না একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর গ্রেড উন্নয়নের জন্য দাবি জানাব?
ব্যাংকে যারা জব করে শুরুতে যে কাজ করেছিল শেষ করার আগেও তারা ওই কাজই করেন। শিক্ষকের কাজ তো পড়ানো, সে নবীন হোক আর প্রবীণ হোক।'
জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) মহাপরিচালক মো. নিজামুল করিম দাবি করেছেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে অবহেলিত ও নিগৃহীত পেশার নাম স্কুল-কলেজের শিক্ষকতা।
তিনি লিখেছেন, 'কর্তাব্যক্তিরা প্রতিনিয়ত শিক্ষকদের দায়িত্ব, কর্তব্য ও কাঙ্ক্ষিত দক্ষতা নিয়ে নানান অসিহত করেন ও সুযোগ পেলেই পড়াশুনা করে না, মূর্খ, ফাঁকিবাজ, প্রাইভেট পড়ায় এসব নানান বিশেষণসহ অপমানিত করে গৌরব বোধ করেন। কেউ কেউ শ্লেষাত্মকভাবে বলেন, টিচার্স বাই চান্স নট বাই চয়েজ। চমৎকার লাগে শুনতে। একটি পেশা যখন মানমর্যাদা ও সুবিধাদিতে আকর্ষণীয় হয় তখনই বাই চয়েজ সে পেশায় মেধাবীরা আসেন।
যদি প্রশ্ন করা হয়, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে শিক্ষা ও শিক্ষকতা পেশা আকর্ষণীয়করণে কী করেছেন তখন স্বর মিইয়ে যায় আর তখন শিক্ষকতাকে বলেন, মানসম্মান আর অগুনতি সালাম আদাবের পেশা! আর কী চাই?'
বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও পালন করা হয় বিশ্ব শিক্ষক দিবস।
শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্ক। শিক্ষার ভিত তথা ভিত্তিপ্রস্তর প্রাথমিক শিক্ষা। শিক্ষার এই স্তরে শিক্ষাটা আদৌ কি শিক্ষকদের হাতে আছে? মেধাবীদের এই পেশায় আকৃষ্ট করার কোনো প্রচেষ্টা কখনো কি করা হয়েছে?
সব সময় চোর ধরার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত থেকেছে প্রশাসন। কীভাবে শিক্ষকদের ফাঁকি, কাজের অবহেলা ধরা যায়, কী করে তাদের নানা কাজে ব্যস্ত রেখে অপমান অসম্মান করা যায় এ প্রচেষ্টায়ই চলে আসছে গত পঞ্চাশ বছর।
একের পর এক পাহারাদার নিযুক্ত হয়েছে। এই টিম, সেই টিম নিযুক্ত করা হয়েছে শিক্ষকদের অনিয়ম ধরার জন্য।
ফলে দিনে দিনে কর্মকর্তা সন্তুষ্টি আর তাদের আগমনে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে সেটাই মুখ্য হয়ে দেখা দিয়েছে।
একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক যে যে কাজ করেন তা মোটামুটি নিম্নরূপ :
একজন শিক্ষককে যা করতে হয়-
১. শিক্ষার্থী ভর্তি রেজিস্টার
২. বই বিতরণ রেজিস্টার
৩. প্রাক-প্রাথমিক স্টক রেজিস্টার
৪. প্রাক-প্রাথমিক রেজুলেশন রেজিস্টার
৫. ঝরে পড়া শিক্ষার্থী রেজিস্টার
৬. অভর্তিকৃত শিশুর তথ্য রেজিস্টার
৭. এসএমসি রেজুলেশন রেজিস্টার
৮. শিক্ষক অভিভাবক সমিতি রেজিস্টার
৯. মা সমাবেশ রেজিস্টার
১০. অভিভাবক সমাবেশ রেজিস্টার
১১. উঠান বেঠক রেজিস্টার
১২. পাক্ষিক সভা রেজুলেশন রেজিস্টার
১৩. পুনরাবৃত্তি রেজিস্টার
১৪. ছবিসহ উপবৃত্তি রেজিস্টার
১৫. উপবৃত্তি চাহিদা রেজিস্টার
১৬. প্যাক মিটিং রেজিস্টার
১৭. খুদে ডাক্তার তালিকা রেজিস্টার
১৮. কাব রেজুলেশন রেজিস্টার
১৯. কাব আয়-ব্যয় রেজিস্টার
২০. কাব দল গঠন রেজিস্টার
২১. কাব চাঁদা আদায় রেজিস্টার
২২. কাব স্টক রেজিস্টার
২৩. কাব দল নোটিশ বহি
২৪. কাব পরিদর্শন রেজিস্টার
২৫. কাব শিক্ষার্থী হাজিরা রেজিস্টার
২৬. স্টুডেন্ট কাউন্সিল নির্বাচন
২৭. স্টুডেন্ট কাউন্সিল সভা রেজিস্টার
২৮. সমাপনী পরীক্ষা সংক্রান্ত রেজিস্টার
২৯. বিদ্যালয় পরিদর্শন রেজিস্টার
৩০. সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া রেজিস্টার
৩১. অন্য বিদ্যালয়ে গমন রেজিস্টার
৩২. বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর তালিকা রেজিস্টার
৩৩. নৈমিত্তিক ছুটি রেজিস্টার
৩৪. শিক্ষার্থীদের পোশাক ও টিফিন বক্স বিতরণ রেজিস্টার
৩৫. সাব-ক্লাস্টার প্রশিক্ষণ রেজিস্টার
৩৬. বৃক্ষরোপণ সংক্রান্ত রেজিস্টার
৩৭. কম্পিউটার ও মাল্টিমিডিয়া সংরক্ষণ রেজিস্টার
৩৮. পাঠাগার বই আদান-প্রদান রেজিস্টার
৩৯. শ্রেষ্ঠ অভিভাবক নির্বাচন রেজিস্টার
৪০. বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাব ও ক্যাশ রেজিস্টার
৪১. স্স্নিপ রেজুলেশন রেজিস্টার
৪২. স্স্নিপ সরকারি ক্যাশ রেজিস্টার
৪৩. স্স্নিপ বেসরকারি ক্যাশ রেজিস্টার
৪৪. স্স্নিপ স্টক রেজিস্টার
৪৫. সহায়ক পঠনসামগ্রী রেজিস্টার
৪৬. মুভমেন্ট রেজিস্টার
৪৭. ক্ষুদ্র মেরামত ক্যাশ রেজিস্টার
৪৮. সরকারি ক্যাশ রেজিস্টার
৪৯. সরকারি স্টক রেজিস্টার
৫০. জমিসংক্রান্ত রেজিস্টার
৫১. বিদ্যুৎ বিল রেজিস্টার
৫২. ওয়ান ডে ওয়ান ওয়ার্ড (১ম-৫ম শ্রেণি) বাংলা ও ইংরেজি রেজিস্টার
৫৩. সততা স্টোর চালু
৫৪. খাতা-কলম-চক ও আনুষঙ্গিক জিনিস ক্রয়
৫৫. প্রশ্ন প্রণয়ন ও ছাপানো
৫৬. পরীক্ষার কাগজ ক্রয়
৫৭. পরীক্ষার আয়োজন করা
৫৮. পরীক্ষার খাতা দেখা
৫৯. ফলাফল ঘোষণা
৬০. খেলাধুলার আয়োজন করা
৬১. শিক্ষক বদলি/অবসর/মাতৃত্বকালীন/ শিক্ষা ছুটি/ দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতাজনিত কারণে বছরে ২-৩ বার ক্লাস রুটিন তৈরি
৬২. বার্ষিক কর্ম-পরিকল্পনা তৈরি
৬৩. ক্যাচমেন্ট এরিয়া চার্ট তৈরি
৬৪. শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হোম ভিজিট করা
৬৫. শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ (ইউনিয়ন/উপজেলা/ জেলা পর্যায়ে)
৬৬. কমিটির মিটিং আয়োজন করা
৬৭. সভা-সমাবেশ আয়োজন করা
৬৮. বিদ্যালয়ের মেরামত কাজ করানো
৬৯. শিক্ষা অফিস থেকে বই সংগ্রহ
৭০. মাসকাবারি তৈরি করা
৭১. পাঠ পরিকল্পনা করা
৭২. বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে ব্যানার তৈরি ও শিক্ষার্থীদের গানের অনুশীলন করানোসহ. . . . . বহু বহু কাজ!
'কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই।' এই প্রবাদের মতোই সব কার্যক্রম এখন রেজিস্টারে আছে।
এত এত কাজ আর রেজিস্টার ঠিক রাখার পর লেখাপড়া আসলে কোথায়?
শিক্ষক দিবস আসে শিক্ষক দিবস যায়। শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নে কোনো পদক্ষেপ রাষ্ট্র গ্রহণ করে না।
কথায় বলে পেটে খেলে পিঠে সয়। পেট খালি রেখে বছর বছর বাড়ে কাজের পরিধি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের শুরুতে বেতন নিম্নরূপ : গ্রেড-
১৩তম বেতন স্কেল : ১১০০০/- --২৬৫৯০/-
বেসিক সেলারি: ১১০০০/-
বাড়ি ভাড়া: ৪৯৫০/-
চিকিৎসা ভাতা: ১৫০০/-
টিফিন ভাতা :২০০/-
মোট:১৭৬৫০/-
বিএফ কর্তন :১১০/-
রেভি. স্টাম্প: ১০/-
মোট কর্তন :১২০/-
নিট প্রাপ্য :১৭৫৩০/-
একজন বিসিএস উত্তীর্ণ তরুণকে ধরে রাখার জন্য কী আছে এই পেশায়? অর্থ, সম্মান না প্রতিপত্তি?
একটি ক্ষমতাময়, আর্থিক সচ্ছলতা, সম্মানজনক বিসিএস ক্যাডার পদ ছেড়ে কেন প্রাথমিকের শিক্ষক হবেন মেধাবীরা?
কিছুদিন আগে একটি পাত্রচাই বিজ্ঞাপন দেখলাম। যেখানে লেখা ছিল, 'শিক্ষক বাদে'।
মুখে আমরা যতই বলি শিক্ষকতা সম্মানিত পেশা। প্রকৃতপক্ষে, গত পঞ্চাশ বছরে শিক্ষকতা পেশা চরম অসম্মানের জায়গায় পৌঁছেছে।
স্মার্ট নাগরিক তৈরির জন্য স্মার্ট শিক্ষক প্রয়োজন। আকর্ষণীয় বেতন, উন্নত জীবনমান ব্যতীত মেধাবীরা এই পেশায় আসবে না।
স্মার্ট শিক্ষার দায়িত্ব সনাতন শিক্ষকের হাতে তুলে দিলে চলবে কেন? স্মার্ট শিক্ষক তৈরি করতে চাইলে মেধাবীদের এই পেশায় আকৃষ্ট করার ব্যবস্থা নিতে হবে। শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষকদেরও যুগোপযোগী করে তুলতে হবে।
শিক্ষক দিবসে একটি স্মার্ট, যুগোপযোগী শিক্ষক সমাজ গড়ে তোলার জন্য মেধাবীদের এই পেশায় আকৃষ্ট করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
শাকিলা নাছরিন পাপিয়া :কবি, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক ও কলাম লেখক