শুক্রবার, ০৬ জুন ২০২৫, ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

জন্মদিন উদযাপন : অতীত ও বর্তমান

শাহরিম আল ফারাবি
  ১৪ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
জন্মদিন উদযাপন : অতীত ও বর্তমান

একটা বিস্ময়কর ঘটনা আমাকে ভাবনার গভীরে নিয়ে গেল। ঘটনাটির সংঘটন ২০২৩ পঞ্জিকাবর্ষের প্রথম দিন। কারণ এ দিন ফেসবুকে আমার ৯৩ জন বন্ধুর জন্মদিনের বার্তা পেলাম। পুরো বছর জুড়ে প্রতিদিন গড়পড়তা ৫/৭ জনের জন্মদিনের বার্তা পাই। অবশ্য, সবাইকে সময়ের অভাবে অনেকদিনই জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো হয়ে ওঠে না। ভাবনার কারণ, এই দিন এত সংখ্যক লোক কি আদৌ ধরণিতে আগমন করেছেন? এই সূত্র ধরেই মনেই উদগ্র ইচ্ছার জন্ম হলো জন্মদিন উদযাপনের বিষয়টি জানবার। জানিয়ে রাখি, ফেসবুকে আমার বন্ধু সংখ্যা নেহাত কম নয়। কোনো কোনো বন্ধুর বয়স ৯০ ছুঁই ছঁই, কেউবা আবার ১৪/১৫ বছরের কিশোর। নেট দুনিয়ায় বন্ধু মানেই সমবয়সি খেলার সাথী কিংবা সহপাঠী নয়। বন্ধুর সংজ্ঞা আজ অনেকখানিই বদলে গেছে। বন্ধুর তালিকায় ঠাঁই পেতে ধনী-গরিব, ছোট-বড় ভেদাভেদ নেই। তথ্যপ্রযুক্তি বন্ধুত্বে এনে দিয়েছে নতুন এক সাম্য।

জানুয়ারির ১ তারিখে বন্ধুদের প্রোফাইল আইডি চেক করতেই ভড়কে গেলাম। কারণ প্রায় ৮০ ভাগ বন্ধুর বয়স হাফ-সেঞ্চুরি পেরিয়েছে। এ নিয়ে পহেলা জানুয়ারি জন্মদিন উদযাপনকারী ঘনিষ্ঠ একজনের সঙ্গে কথা হয়। তার ভাষ্য অনুযায়ী আজ থেকে ৪০/৫০ বছর আগে ছেলেমেয়েদের জন্মদিনের তারিখ নিয়ে পিতামাতার আগ্রহ ছিল না। এসএসসি পরীক্ষার জন্য নবম শ্রেণিতে উঠলে বোর্ড রেজিস্ট্রেশন করতে হতো। পিতামাতা কিংবা শিক্ষকরা মনে রাখার সুবিধার জন্য জন্মদিন হিসেবে বছরের প্রথম দিনটিই বেছে নিতেন। ফেসবুকে বেশির ভাগ বয়সি বন্ধুদের জন্মদিন মূলত কাগজি। দিনবদলে এখন আর কাগজি জন্মদিন তেমন নেই। বেশির ভাগ পিতামাতাই জন্ম নিবন্ধন করিয়ে নেন সন্তানদের।

1

জন্মদিন উদযাপন কবে শুরু হয়, তার সঠিক ইতিহাস আজও পাওয়া যায়নি। তবে মোটামুটি সবাই একমত যে, দেবতা, ঈশ্বর বা মহাপুরুষের নামে জন্মদিন উদযাপন কালচার শুরু হয়। যেমন, যীশু খ্রিষ্টের বড়দিন, শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী, গৌতম বুদ্ধের বুদ্ধপূর্ণিমা এবং হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর ঈদে মিলাদুন্নবী। সাধারণ মানুষের জন্মদিন উদযাপন শুরু হয় প্রাচীন রোমানে। সেখানে শুধু পুরুষদের জন্মদিনই উদযাপিত হতো। মহিলাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় দ্বাদশ শতকে। কালক্রমে অষ্টাদশ শতকে উন্নত বিশ্বে জন্মদিন উদযাপন ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের উপমহাদেশে প্রথমবারের মতো জন্মদিন পালিত হয় ১৮৮০ সালে। রবীন্দ্রনাথের বড়ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র সুরেন ও কন্যা ইন্দিরাকে দিয়ে শুরু হয় জন্মদিনের উদযাপন। উলেস্নখ্য, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তা ছিলেন এবং চাকরির কল্যাণে কিছুদিন বিলেতে (লন্ডন) প্রবাসজীবনে জন্মদিন উদযাপন-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন এবং স্বদেশে ফেরত এসে পরিবারের মধ্যে এ সংস্কৃতি চালু করেন। আঠারো ও উনিশ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশের জন্মদিনের উদযাপন তেমন হতো না। কারণ হিসেবে অনেকে মনে করবেন, দারিদ্র্য বা ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জন্মদিন উদযাপন না করার মূল কারণ ছিল আঠারো ও উনিশ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল যথাক্রমে ২১ ও ২৪ বছর। এত স্বল্প আয়ুর জীবন নিয়ে মানুষের আনন্দ-উৎসবের চেয়ে মৃতু্যভীতি বেশি কাজ করত। এ সময়ে যুক্তরাজ্যের মানুষের গড় আয়ু ছিল যথাক্রমে ৪০ ও ৫০ বছর। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতিতে এ দেশের মানুষের বর্তমান গড় আয়ু দাঁড়িয়েছে ৭৩ বছর। পাশাপাশি শিক্ষা ও আর্থিক দিকে মানুষের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। এখন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জন্মদিন উদযাপনের সংস্কৃতি কাছাকাছি পর্যায়ে চলে এসেছে।

আইনগত দিক দিয়ে জন্মদিন এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বটে। যে কোনো প্রতিষ্ঠানে নিজের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদানকালে জন্ম তারিখের বিষয়টি উলেস্নখ করতে হয়। জন্ম তারিখ ধরে ভোটাধিকার, বিয়ের অধিকার, ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তির অধিকার পাওয়া যায়। ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডায় মেয়েদের বয়স ১৬ পূর্ণ হলে 'সুইট সিক্সটিন' পার্টি করে। পর্তুগাল ও ব্রাজিলে 'সুইট ফিফটিন' পালন করা হয়। জাপানে কারো বয়স ২০ হলে 'পূর্ণবয়স্ক হওয়ার দিনটিকে স্বাগত' নাম দিয়ে দিনটি উদযাপন করা হয়। কোনো শিশুর পিতামাতা না থাকলে এবং জন্ম তারিখ জানা না থাকলে পহেলা জানুয়ারি জন্মদিন উদযাপন করা হয়।

জন্মদিন উদযাপন করা হয় সাধারণত সন্ধ্যাবেলা। এ সময়ে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা জন্মদিনকে উদযাপন করে উৎসবমুখর পরিবেশে। তাদের এই আনন্দ ঈদের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। জন্মদিনের এই উৎসবকে কেন্দ্র করে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়। তবে অনেকেই জন্মদিন উদযাপনকে আনন্দের চেয়ে লোক দেখানোটাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। বিশাল হলরুম ভাড়া করে বড়ো বড়ো পার্টির আয়োজন করেন। এতে অপ্রয়োজনে বিপুল অংকের অর্থ অপচয় হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি এমন জমকালো অনুষ্ঠানের ঘোর বিরোধী।

জন্মদিন উদযাপনকে আমি স্বাগত জানাই। আমার প্রথম জন্মদিন উদযাপনের কথা আমার মনে নেই। কিশোর বেলায় পারিবারিক অ্যালবামে জন্মদিনের ফটোগ্রাফ ও ভিডিও দেখে আমি পুলকিত হয়েছি বহুবার। আমার প্রথম জন্মদিনে আমাদের বাসাটি রঙিন বেলুন ও কাগজ, আলোকসজ্জা, মোমবাতি এবং নান্দনিক কেক কেটে উদযাপিত হয়েছিল। আমাকে পরনো হয়েছিল জন্মদিনের নতুন পাঞ্জাবি, মাথায় ছিল তাজ। আমার পাশে ছিল আমার বাবা, মা, বোন, দাদা, দাদি, পাশের বাসার ছোটো ছোটো শিশু এবং কিছু আত্মীয়স্বজন। অতিথিদের জন্য বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। একটু বড়ো হওয়ার পর ঘটা করে জন্মদিন উদযাপনের আমার তেমন আগ্রহ ছিল না। কারণ, আমি অনেক লোকের মাঝে অস্বস্তি বোধ করি। আমি চাই, আমার জন্মদিনটি পালিত হোক আমার পরিবারের আপনজনদের সঙ্গে।

জন্মদিনকে ইংরেজিতে বলে 'হ্যাপি বার্থডে'। বাংলায় এর অর্থ করা হয়েছে শুভ জন্মদিন। জন্মদিন উদযাপন করা হয় 'হ্যাপি বার্থডে টু ইউ' ইংরেজি গানের সুরে। জন্মদিন উদযাপনের জন্য অনেক সময় জনপ্রিয় গান পরিবেশন করা হয়। মাইল্‌স ব্যান্ডের 'আজ জন্মদিন তোমার' গানটির প্রথম অন্তরাটি নান্দনিক শব্দের ছন্দে ভরা।

'তোমার জন্য এই রোদেলা স্বপ্ন সকাল

তোমার জন্য হাসে অগনন স্নিগ্ধ বিকেল।

ভালোবাসা নিয়ে নিজে তুমি

ভালোবাসো সব সৃষ্টিকে।

তুমি এই দিনে পৃথিবীতে এসেছো শুভেচ্ছা তোমায়

তাই অনাগত ক্ষণ হোক আরও সুন্দর উচ্ছল দিন কামনায়

আজ জন্মদিন তোমার।'

এছাড়া প্রতিটি পিতামাতার সন্তানের জন্য হৃদয়ের চাওয়া প্রকাশ পায় 'আমার পরমায়ু নিয়ে তুমি আয়ু পাও' গানটিতে। গানটির দ্বিতীয় অন্তরাটুকু চেনা শব্দের সুমধুর সুরে ভরপুর।

'সারাজীবন খুশির গানে,

জাগাও খুশি সবার প্রাণে।।

অন্ধকারের ভুবনটাকে

আলোয় ভরে নাও।'

জন্মদিনকে শুধু আনন্দ উৎসবের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। কারণ জন্মদিন প্রতিটি ব্যক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ দিন আমাদের পৃথিবীতে আগমন ঘটেছে নিজেকে বিকশিত করার জন্য। জীবনের প্রাপ্তি ও হারানোর হিসাব, সফলতা ও ব্যর্থতার হিসেব দেখে নব উদ্যমে সামনে চলার পথ ধরে এগিয়ে যেতে হবে। জীবন মানে বহতা এক নদী। নদীর গন্তব্য সমুদ্র। সমুদ্রে পৌঁছে নদী বিশালতায় তৃপ্ত হয়। মানবের জীবনের গন্তব্য হওয়া উচিত মহৎ কর্মের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বড়োদের জন্মদিনে এ উপলব্ধি খুব বেশি প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে কবি সুকান্তের 'ছাড়পত্র' কবিতার কয়েকটি পঙক্তি স্মরণ করে সমাপ্তি টানছি আমার এ লেখার।

'এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;

জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে

চলে যেতে হবে আমাদের।

চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ

প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,

এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি

নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।'

শাহরিম আল ফারাবি : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে