রোববার, ১১ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

পাখি রক্ষায় এগিয়ে আসুন

নগরায়ণ, ধোঁয়া ও ধুলার আস্তরণ এবং অগণিত এসির আগ্রাসন শহুরে পাখির জীবনযুদ্ধকে আরও কঠোর করে তুলেছে। উঠান নেই, বাগান নেই; তবু নগরের ভবনগুলোর কার্নিশ, ছাদ, বারান্দা ও চিলেকোঠায় নিজেদের আবাস গড়তে সচেষ্ট ওরা।
মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী
  ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
পাখি রক্ষায় এগিয়ে আসুন

নগরায়ণ ও আধুনিকতার পরশে জনজীবন আজ যান্ত্রিক জীবনে পরিবর্তিত হয়েছে। ইট-পাথরের নগরী আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় এনেছে বৈপস্নবিক পরিবর্তন। মুঠোফোনের পর্দায় জীবন এখন বন্দি। প্রকৃতি ও পাখির সঙ্গে বন্ধন ছিঁড়ে গেছে। শিশুরা পাখি দেখে স্ক্রিনে। আর স্ক্রিনের বাইরে প্রাণহীন পুতুল, মনোগ্রামের ছবি, খেলনা পাখি তাদের সঙ্গী। অথচ একসময় চোখ ফেরালেই আমাদের চারপাশে শুধু চড়ুই আর চড়ুই। তাদের ফুড়ুত ফুড়ুত আসা-যাওয়া দেখেই কেটে যেত কত শিশু-কিশোরবেলা। দল বেঁধে আসা, খুঁটে খুঁটে খাওয়া, ঠোঁট ডুবিয়ে পানি পান, হঠাৎ উড়াল, হঠাৎ আড়াল- এত মায়াবী, এত আদুরে পাখি! সারা দিনে একটি চড়ুই পাখি মাত্র পাঁচ থেকে সাত গ্রাম খাবার খায়। কত খাবার আমাদের নষ্ট হয়, বিদেশি কুকুর পুষে কত অর্থের অপচয় হয়, আবর্জনায় কত খাবার ফেলে দেওয়া হয়। সুবোধ চড়ুই পাখি আমাদের জীবন বিঘ্নিত করে না, কাকের মতো ছোঁ মেরে খাবার নিয়ে যায় না। ইঁদুরের মতো গর্ণ করে খাবার মজুত করে না। কিন্তু নগরায়ণের দিগন্ত যতই প্রসারিত হচ্ছে, ততই বিলুপ্ত হচ্ছে পাখিদের জলাধার, খাবার, ঝোপঝাড়। ১৯৮৯ সালে ঢাকার বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ছিল ১৮ থেকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০০৯ সালে ২৪ থেকে ৩০ ডিগ্রি এবং ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯ ডিগ্রি। রাত-দিন হাইড্রোলিক হর্নের অসহনীয় শব্দদূষণে চড়ুই আজ সংকটাপন্ন। শব্দদূষণের মাত্রা এখন ঢাকা মহানগরীতে ১৩১ ডেসিবেল পৌঁছেছে। কংক্রিটের এ নগরীতে চড়ুই পাখিরা আজ ছিন্নমূল।

নগরায়ণ, ধোঁয়া ও ধুলার আস্তরণ এবং অগণিত এসির আগ্রাসন শহুরে পাখির জীবনযুদ্ধকে আরও কঠোর করে তুলেছে। উঠান নেই, বাগান নেই; তবু নগরের ভবনগুলোর কার্নিশ, ছাদ, বারান্দা ও চিলেকোঠায় নিজেদের আবাস গড়তে সচেষ্ট ওরা।

মাত্র পাঁচ-ছয় বছর আয়ুষ্কালের এ পাখি মানুষের আড়াল হতে চায় না, শত সংকটেও এ নগরী তাদের প্রাণপ্রিয় চারণভূমি। তারাও এখন শীতার্ত, ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত। পাখিরা কখনই প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে না। মহান আলস্নাহ পৃথিবীতে পাখিসহ সব জীববৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন মানুষের কল্যাণের জন্য। এ সুনিপুণ জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মাধ্যমে আমরা নিজেদের পরিণতিকেই বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছি। যেমন, নির্বিচারে চড়ুই পাখি হত্যার পরিণামে ভয়ানক প্রাকৃতিক দুর্যোগের শাস্তি ভোগ করেছিল, তার জ্বলজ্বলে উদাহরণ চীন। চড়ুই ফসলের ক্ষতি করে, এ ভ্রান্ত ধারণায় ৫০-এর দশকে মাও সে তুংয়ের নির্দেশে লাখ লাখ চড়ুই নিধন করা হয়। কিন্তু চার-পাঁচ বছরের মাথায় চড়ুইয়ের অভাবে শস্যক্ষেত্রে পোকামাকড়ের বিধ্বংসী আক্রমণে খাদ্যসংকটের কবলে পড়ে চীন। দুর্ভিক্ষে মারা যায় প্রায় ২০ মিলিয়ন মানুষ। এরপর আবার শুরু হয় চড়ুই রক্ষার আন্দোলন। ঢাকার বাইরের শহরগুলোতেও বর্তমানে নগরায়ণের পরিধি বাড়ছে, যদিও ঢাকার তুলনায় সেটি অনেক কম। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে প্রায় ৫৫ শতাংশ মানুষ শহরাঞ্চলে বসবাস করে। একসময়ের সবুজ আঙিনা, মাধবিলতার ঝাড়, ফুলের বাগানে সমৃদ্ধ ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের বাড়িগুলো হারিয়ে যাচ্ছে এ নগরী থেকে। স্থান পাচ্ছে আকাশচুম্বী অট্টালিকা। ভূস্থাপত্যিক এ বিবর্তনে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে চড়ুইদের বংশবৃদ্ধি ও টিকে থাকা। মেঘের গর্জনে, মুষলধারে বৃষ্টিতে, কালবৈশাখীর ঝড়ে এরা দলে দলে আশ্রয় নেয় বাসাবাড়ির বারান্দায়, চিপেচাপায়। এ নগরীর হিমশীতলতা, তপ্ত হাওয়া, মশার যন্ত্রণা, তথাপি জীবন-জীবিকার সন্ধানে পেতে চায় মানুষের উষ্ণতা। যত নিঃসীম আকাশ থাকুক, যত অনন্তে ওড়ার ডানা থাকুক, বারবার ফিরে আসে মানুষের কোলাহলে। কীটপতঙ্গ এবং মাছি সাবাড় করে পরিবেশের রক্ষাকবচ হিসেবে অবদান রাখছে এরা। পাখিদের সংরক্ষণ মানে যে শুধুমাত্র এদের প্রতি দয়া প্রদর্শন, তেমনটি নয়; বরং এ কাজটি আমাদের নিজেদের স্বার্থেই জরুরি। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় নির্মল প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিকল্প নেই। শুধু গাছ লাগানো নয়, দেশি লতা-গুল্মসমৃদ্ধ ঝোপঝাড় রক্ষা করতে হবে। তরুণ প্রজন্মের প্রতি অনুরোধ, পড়া আর বিনোদনের ফাঁকে প্রতিদিন দু'বেলা ছাদে বা বারান্দায় পাখিদের জন্য সামান্য খাবার ছিটিয়ে দাও। দেখবে, তাদের কত আনন্দ, আহ্লাদ। প্রিয় গৃহিণীরা, সাংসারিক ব্যস্ততার মাঝে মিটিয়ে দিন পাখিদের ক্ষুধা ও তৃষ্ণার যন্ত্রণা। এ মহৎ কাজে সন্তানদের অনুপ্রাণিত করুন। বিশাল এ প্রকৃতির রাজ্যে জীবনটা পারস্পরিক ও সামষ্টিক। কোনো জীবনই ক্ষুদ্র নয়, কোনো প্রাণীই সামান্য নয়। শুধু জৈব প্র্রবৃত্তি পূরণের জন্য মানুষের জীবন নয়। আমাদের প্রতিটি ঘরবাড়ি যেন হয় চড়ুই পাখির জন্য পরম মমতায় ভরা ভুবন, নির্ভয় আবাসন। আসুন, কম্পিউটার গেমস আর টেলিভিশননির্ভর যান্ত্রিক বিনোদনের আসক্তি কমিয়ে গড়ে তুলি পাখির সঙ্গে মিতালি। শ্রমনিষ্ঠ এ পাখি সারা দিন নগরজুড়ে খুঁজে বেড়ায় আহার। মানুষের একটু খাবার, একটু আদরে এদের অনাবিল প্রশান্তি। ঘরের বারান্দায়, জানালায় ছোট পাত্রে সামান্য চাল, ভাত, পানি রাখলে পাখিদের ভীষণ তুষ্টি। নিয়মিত খাবার পেলে এরা কাছে আসবেই, এটা পরীক্ষিত। শান্ত ও নিরিবিলি পরিবেশ পাখিদের নিরাপদ অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবে। এ লক্ষ্যে আমাদের আবাসিক এলাকা ও অফিস চত্বরে পাখিদের জন্য অভয় আশ্রম গড়ে তুলতে হবে। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাসগুলোও পাখিদের নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। তবেই আমরা নগরায়ণ ও প্রাকৃতিক ভারসম্যের সমন্বয় সৃষ্টি করতে পারব।

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী : মহাপরিচালক, জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে