শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

পুঁজিবাদের ফাঁদেই পুঁজিবাদ

এক সময় চীন ছিল মার্কিনীদের ঘনিষ্ঠ বন্ধ। আজ বিশ্ববাজারে চীনের প্রভাব আমেরিকার চেয়ে বেশি। এখন চীন আর আমেরিকার কথা শুনতে চায় না। মার্কিন মদদে মিখাইল গর্ভাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙেছিল। জন্ম নিয়েছিল রাশিয়া। রাশিয়া কী এখন মার্কিনীদের কথা শুনে। পুঁজিবাদের বিকাশ হবে ঠিকই। এর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার হাতবদল হবে। এ রকম হাতবদলের ঝগড়ায় এক সময় নিজেরাই নিজেদেরকে কামড়ে ধরবে আর এভাবেই পতন ঘটবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার। তা থেকে জন্ম নেবে প্রগতিশীল সাম্যবাদের। শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
  ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
পুঁজিবাদের ফাঁদেই পুঁজিবাদ

দুনিয়ায় তত্ত্ববিহীন একটি মতবাদ আছে,তা হলো পুঁজিবাদ। পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্য ধর্ম-রীতি-নীতি বা আর্দশের কোনো পরিকাঠামো নেই। এর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো মুনাফা অর্জন আর ভোগ। সুতরাং কোনো নীতি এবং আর্দশকে পুঁজিবাদীরা ধারণ করে না। তাই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নীতি গর্হিত কর্মকান্ডসম্পন্ন হয়। বর্তমান পৃথিবীতে যে সব যুদ্ধ ও সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে সেগুলো নীতির মানদন্ডে মাপলে কী দেখা যায়? মূলত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কায়েমী স্বার্থ হাসিলের জন্য এই সংঘাত ও যুদ্ধ। যেমন আফ্রিকার বর্ণবাদী দাঙ্গা, ইসরাইলের ফিলিস্তিন আক্রমণ, সিরিয়ার যুদ্ধ, তালেবান সৃষ্টি, আলকায়েদাসহ নানা গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠা করে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করাটাই পুঁজিবাদের কাজ। এসব কর্মকান্ড করে পুঁজিবাদীরা কী কর্তৃত্ব ধরে রাখতে পারবে? তা দেখার বিষয়, কারণ সময় তার জবাব দিয়ে দিবে। ১৯৯০ সালে তথাকথিত মুক্তবাজার অর্থনীতি চালু করার নামে পুঁজিবাদীরা সারা বিশ্বজুড়ে মুনাফা লুটার নতুন প্রক্রিয়া শুরু করে। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়াটা মুক্তবাজার অর্থনীতির ডামাঢোলে ভেঙে যায়। পণ্য বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বিশ্ববাজার ব্যবস্থাকে করা হয় উন্মুক্ত। পাবলিকাইজেশন বাদ দিয়ে প্রাভেটাইজেশনের দিকে ঝুঁকে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর বাণিজ্য নীতি। ২০০০ সালে এসে প্রাইভেটাইজেশনটা দুনিয়ার বাণিজ্যব্যবস্থায় কর্তৃত্ব শুরু করে। মুক্ত বাজারে প্রভাবে রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় বণিক শ্রেণির হাতে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে নাটকীয় পরির্বতন চলে আসে। রাজনীতিতে স্থান করে নেয় বণিক, আমলা, শিল্পপতি, তারকাসহ কিছু ধনিক শ্রেণির ব্যক্তিরা যাদের রাজনৈতিক কোনো জ্ঞান নেই। ফলে রাজনীতিবিদরা হয়ে যায় এদের অধীনস্ত। রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র, অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, বাণিজ্যসহ বেশ কিছু বিষয় রাষ্ট্র চাইলেও এখন আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। উলিস্নখিত বিষয়গুলোর জন্য এখন নীতি নির্ধারণ করে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নিজের স্বার্থে। সাধারণ মানুষের স্বার্থে এই নীতিগুলো তেমন কাজে আসে না। এত কিছু করার পর কী পুঁজিবাদীরা ভালো থাকতে পারবে? ১৯৭৫ সালের পটপরির্বতনের পর বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থার অনেকটা তদারকের দায়িত্ব পালন করছিল আমেরিকা। ১৯৭৫ থেকে ২০২৩ এই সময়টা পর্যবেক্ষণ করলে কী বুঝা যায়। আমেরিকার সরকার এখন কী তা পারছে, যা পেরেছিল ১৯৭৫ সালে। যদিও বাংলাদেশের সরকার কাঠামোর পরির্বতন হয়েছে এখন যে কাঠামোতে সরকার ব্যবস্থা আছে তা ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের কাঠামোতে নেই। মার্কিনী প্রেসক্রিপশনে ৭৫-এর পরবর্তীতে যে ব্যবস্থাটা হয়েছিল তাই রয়েছে। তবে খবরদারিত্বটা ধীরে ধীরে কমেছে। কারণ বাংলাদেশও পুঁজিবাদী দুনিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মাঝে বড় স্থান দখল করে ফেলেছে। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে জ্যামিতিক হারে দরিদ্র সংখ্যা বাড়লেও অপরদিকে সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়ে গিয়ে গাণিতিক হারে বেড়েছে কোটিপতির সংখ্যা। সুতরাং এখন বাংলাদেশের বাণিজ্যসহ কিছু ব্যবস্থা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে ছাড়াই ব্যবসায়ীরা চালাতে পারে আমেরিকার মতো।

বাংলাদেশের আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বাংলাদেশ আমেরিকার সম্পর্ক ক্রমশ হয়ে যাচ্ছে শীতল। আমেরিকার রাষ্ট্রদূত নানা ধরনের দৌড়ঝাঁপ দিয়েও নিজেকে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান প্রভাবক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। তাই তিনি দশ দিনের ছুটিতে চলে যান নিজ দেশে। তিনি ফিরে আসার পর যা শোনা যাচ্ছে,তা হলো বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ব্যবস্থাটায় মার্কিন সরকার কাচি চালাতে পারে। বাংলাদেশ থেকে পোশাক কেনার বিষয়ে আমেরিকার সরকার আইন তৈরি করেছেন। আইনের প্রভাবে বাংলাদেশের পোশাক আমেরিকায় রপ্তানি করার ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্থ হতে পারে। আমেরিকা ও বাংলাদেশের পুঁজিবাদীরা অর্থাৎ ধনিকগোষ্ঠী কতটা প্রভাবশালী তা দেখার প্রয়োজন। আমেরিকা বা বাংলাদেশের সরকার কী স্ব স্ব রাষ্ট্রের ধনিক ব্যবসায়ীদের কী নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে? বাংলাদেশে প্রায় ৪০ লক্ষ শ্রমিক পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত। এই শিল্প থেকে ২ কোটি মানুষ উপকার ভোগ করে। এই ব্যবস্থায় আমেরিকার সরকার ছুরি চালাতে পারলে সরকারকে সহজেই বেকায়দায় ফেলতে পারবে। তবে তা কী সম্ভব হবে? পৃথিবীর সবচাইতে সস্তা শ্রম বাংলাদেশে। তাই বাংলাদেশের পোশাক আমেরিকার ব্যবসায়ীরা কম দামে কিনে নিয়ে গিয়ে বেশি দামে বিক্রি করতে পারে। যার ফলে মার্কিন ব্যবসায়ীরা প্রচুর মুনাফা অর্জন করে থাকে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, পোশাক কেনা-বেচার বিষয়টা সম্পন্ন প্রাইভেটাজেশন ব্যবস্থায় চলে। তাই তিনি বলেন, মার্কিন সরকার তাদের ব্যবসায়ীদের কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন তা দেখার বিষয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যথার্থ বলেছেন। কারণ ব্যবসায়ীরা ছুটবে মুনাফার পেছনেই। এক সময় মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি পোশাকের কোটা ছিল। এক পর্যায়ে মার্কিন সরকার কোটা ব্যবস্থা রহিত করেন। তখন অনেকেই ধারণা করেছিল, বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি আমেরিকার বাজারে কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল কোটাব্যবস্থা রহিত করার পরও পোশাক রপ্তানিতে কোনো প্রভাবই পড়েনি। কারণ মার্কিনী ব্যবসায়ীরা লাভের পেছনে ছুটে, মুনাফার লোভ তাদের প্রবল। অন্য দেশ থেকে পোশাক কিনলে তারা লাভবান হতে পারবে না। তাই এখানে নীতির কথা বলাটা ভুল। কারণ মার্কিন ব্যবসায়ীরা অস্ত্র বিক্রির জন্য রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধ বাধায়। তাই তাদের কাছে ন্যায়বাক্য বলাটা ভুল। সুতরাং কম মূল্যে পোশাক তারা বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশ থেকেই কিনতে পারবে না। তাই হোয়াইট হাউসের নীতিবাক্য কোনো কাজেই লাগবে না। বাংলাদেশ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বিশ্ববাজারে একটি বিশেষ স্থান দখল করে ফেলেছে। সুতরাং বাংলাদেশ নিজেই বিশ্ববাজারে বিশেষ স্থান দখল করে ফেলবে অচিরেই। বাংলাদেশ গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের বদৌলতে বিশ্বের বাজারে বিরাট ভূমিকা রাখবে। বিশ্ববাজারের সব চেয়ে বড় বাজার চীন ও ভারতের। দেশ দু'টি এই গভীর সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করবে। গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চীন ও ভারত এ দু'টি দেশকে কূটনৈতিক কৌশলে আয়ত্তে রাখতে পেরেছে-যা বাংলাদেশের বড় কূটনৈতিক সাফল্য। এটাই হলো মার্কিনীদের গাত্রদাহের মূল কারণ। কারণ ভূ-রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য এই বন্দরটা মার্কিনীদের কব্জায় নিতে চেয়েছিল। যদি পারত তাহলে এই অঞ্চলটি মার্কিনীদের কথায় উঠত-বসত। যেমনটি মার্কিনীরা করতে পারছে আরব দুনিয়ায়। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি হত্যা করছে ইসরাইল মার্কিনীদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় তা দেখেও আরব বিশ্ব নীরব। মার্কিনীরা কী বাংলাদেশের গণতন্ত্র চায়? যদি কেউ বলে চায় তাহলে বুঝতে হবে তিনি বোকার স্বর্গে বাস করেন। কারণ বাংলাদেশে ওয়ান এলিভেন, মে. জে. জিয়ার সামরিক সরকার ও লে. জে. এরশাদের সামরিক সরকার- এই সরকারগুলোর আবির্ভাব ঘটেছে মার্কিনীদের পৃষ্ঠপোষকতায়। মার্কিনীদের গণতন্ত্র চাওয়া আর কুমিরের কান্না সমান কথা।

এক সময় চীন ছিল মার্কিনীদের ঘনিষ্ঠ বন্ধ। আজ বিশ্ববাজারে চীনের প্রভাব আমেরিকার চেয়ে বেশি। এখন চীন আর আমেরিকার কথা শুনতে চায় না। মার্কিন মদদে মিখাইল গর্ভাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙেছিল। জন্ম নিয়েছিল রাশিয়া। রাশিয়া কী এখন মার্কিনীদের কথা শুনে। পুঁজিবাদের বিকাশ হবে ঠিকই। এর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার হাতবদল হবে। এ রকম হাতবদলের ঝগড়ায় এক সময় নিজেরাই নিজেদেরকে কামড়ে ধরবে আর এভাবেই পতন ঘটবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার। তা থেকে জন্ম নেবে প্রগতিশীল সাম্যবাদের। শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে