বুধবার, ২৮ মে ২০২৫, ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

আজও প্রাসঙ্গিক বেগম রোকেয়ার শিক্ষাদর্শন

মোহাম্মদ আলী
  ০৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
আজও প্রাসঙ্গিক বেগম রোকেয়ার শিক্ষাদর্শন
আজও প্রাসঙ্গিক বেগম রোকেয়ার শিক্ষাদর্শন

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন। বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত। একজন খ্যাতিমান বাঙালি সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক। তিনি জীবদ্দশায় সৃজনশীল ও বৈপস্নবিক লেখনির মাধ্যমে নারীর সামাজিক ও বিধানগত মর্যাদা রক্ষায় অনন্য ভূমিকা রেখে গেছেন। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র ও জাতের ঊর্ধ্বে থেকে নারী জাগরণ ও নারীর মর্যাদা রক্ষায় যে আন্দোলনের সূত্রপাত করে গেছেন প্রায় শতবর্ষ অতিবাহিত হয়ে আজও প্রাসঙ্গিক।

রোকেয়া অর্থ জ্যোতির্ময়ী। নামের অর্থের সঙ্গে যথার্থতা রয়েছে তার কর্মেও। তৎকালীন পুরুষশাসিত সমাজের নির্মম নিষ্ঠুরতা, অবিচার ও কুসংস্কারে জর্জরিত অশিক্ষা ও অবরুদ্ধ জীবনযাপনে বাধ্য অন্ধকারাচ্ছন্ন নারীসমাজকে দেখিয়েছেন আলোর পথ। তিনি নারীর উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন ও মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে মুক্তচিন্তার অকুতোভয় একজন সাহিত্যসেবী ছিলেন।

1

১৮৮০ সালে রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে রোকেয়ার জন্ম হয়। তার বাবা পায়রাবন্দের শিক্ষিত জমিদার জহিরুদ্দীন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের বিলাসিতা এবং অপচয়ে শেষ জীবনে নিঃস্ব হন। তার (বাবা) চার স্ত্রীর প্রথম জন রাহাতুন্নেসার দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। রোকেয়ার বড় দুই ভাই ইব্রাহিম সাবের ও খলিলুর সাবের কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বি. এ পাশ করেন। কিন্তু তিন বোন করীমুন্নেসা, রোকেয়া ও হোমায়েরা শিক্ষালাভে বঞ্চিত ছিলেন। সাংসারিক কাজ ও ধর্মকর্মের জন্য প্রাথমিক কিছু তালিম তাদের জুটেছে। কারণ এদেশে প্রায় সব সম্ভ্রান্ত পরিবারে তখন মেয়েরা ছিল অন্তঃপুরে বন্দি ও আধুনিক শিক্ষালাভে বঞ্চিত। সে সময় কী হিন্দু? কী মুসলমান? অভিজাত বংশের মহিলা সম্পর্কে রোকেয়া নিজেই বলেছেন, 'যিনি যত বেশী পর্দা করিয়া গৃহকোণে যত বেশী পেচকের মত লুকাইয়া থাকিতে পারেন, তিনিই তত বেশী শরীফ'।

কুসংস্কারের বিপক্ষেও রোকেয়ার ছিল সরব উপস্থিতি। রোকেয়া লিখেছেন, 'এখানকার মুসলমানেরা মাতৃহীন অর্থাৎ তাহাদের মাতৃভাষা নাই। এমন বিকৃত উর্দু বলে যে, তাহা শুনিলে শ্রবণবিবর ক্ষত-বিক্ষত হয়'। হিন্দু অভিজাত পরিবারেও 'বিধবা হবে' এমন ভয় দেখিয়ে নারীশিক্ষা বন্ধ রেখেছিল। রোকেয়ার উপলব্ধি ছিল আভিজাত্যবোধ সমাজ প্রগতির অন্তরায়। বেগম রোকেয়ার এমন ভাবনা ও কর্মকান্ডই চিত্রায়িত হয় তৎকালীন ধর্মীয় কুসংস্কার ও অন্ধকারাচ্ছন্ন সামাজিক অপপ্রথার প্রকৃত রূপ। তিনি তার জীবদ্দশায় সৃজনশীল ও বৈপস্নবিক লেখনির মাধ্যমে নারীর সামাজিক ও আইনগত মর্যাদা রক্ষা ও উন্নয়নে আজীবন লড়াই করে গেছেন।

বেগম রোকেয়া মতে, শুধু পাস করা বিদ্যা প্রকৃত শিক্ষা নয়। শুধু সনদলাভ করলেই মানুষ শিক্ষিত হয় না, জ্ঞান ও গুণের সদ্ব্যবহার করতে পারা, মস্তিষ্ক ও মন উন্নত করতে পারাটাই হচ্ছে শিক্ষিত জনের মূল্যায়নের মাপকাঠি। রোকেয়া বলেন, 'সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে যে হাত, পা, চোখ, কান, মন এবং চিন্তাশক্তি দিয়েছেন, আমরা যদি সেগুলোকে সবল করি, হাত দিয়ে সৎকাজ করি, চোখ দিয়ে কার্যকরভাবে প্রত্যক্ষ করি, কান দিয়ে মনোযোগের সঙ্গে শুনি এবং চিন্তাশক্তি দিয়ে আরো সূক্ষ্ণভাবে চিন্তা করতে শিখি, তবে সেটাই প্রকৃত শিক্ষা'। বেগম রোকেয়া শিক্ষা বলতে প্রকৃত সুশিক্ষা বুঝেন এবং তার মতে শুধু গোটা কতক বই পড়তে পারা বা দু'ছত্র কবিতা লিখতে পারা শিক্ষা নয়। তিনি চেয়েছেন সেই শিক্ষা মানুষকে নাগরিক অধিকার অর্জন করতে সক্ষম করবে।

মানসিক শিক্ষার মধ্যে যে দু'টি বিষয়ে রোকেয়া বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন তা হলো ধর্ম ও নৈতিকতার শিক্ষা। তার মতে, ধর্ম ও নৈতিকতার শিক্ষা নিয়মিত পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হবে।

বেগম রোকেয়া শিশুদের মানসিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য পুঁথিগত বিদ্যাশিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন রকম সৃজনশীল কর্মের সুযোগ সৃষ্টির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন এবং এর মাধ্যমে তার আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক মানসিকতারও পরিচয় দিয়েছেন। চারু ও কারু কলাকে যে তিনি কেবল তাত্ত্বিকভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন তা নয়, তার প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের শ্রেণি তালিকাতে এসব বিষয়ের জন্য সময় বরাদ্দ রেখে নিয়মিত শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি পাঠ্যক্রমে হাতের কাজের বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। শিক্ষার্থীদের দিয়ে নানা রকম হাতের কাজ করাতেন এবং হাতে তৈরী সেই সব শিল্পদ্রব্যের প্রদর্শনীরও ব্যবস্থা করেছিলেন।

অসাধারণ আর এক প্রতিভা ছিল রোকেয়ার, সেটি হলো বিজ্ঞানের। হয়তো বিলেতে কৃষিবিদ্যায় প্রশিক্ষিত স্বামীর সাহচর্যেই বিজ্ঞানে রোকেয়ার হাতেখড়ি হয়েছিল। কিন্তু হাতেখড়িতেই তা সমাপ্ত হয়নি। বিজ্ঞান বিষয়ক গভীর আগ্রহ এবং সাধারণ জ্ঞান তার চিন্তাকে সমুজ্জ্বল করেছিল। বিজ্ঞানের সুস্পষ্ট ছাপ মুদ্রিত দেখা যায় তার রচিত গ্রন্থ 'সুলতানার স্বপ্নে'। তিনি বিজ্ঞানচর্চার প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতার কথা বর্ণনা করেছেন এবং অল্প বয়স থেকেই যে এই পাঠ শুরু করা দরকার তারও ইঙ্গিত দিয়েছেন। রোকেয়া জানতেন, বিজ্ঞানের চর্চাই উন্নয়নের চাবিকাঠি।

বাল্যবিবাহ রোধেও বেগম রোকেয়ার ভাবনা ছিল অতুলনীয়। তৎকালীন সমাজে পুরুষের সুযোগ-সুবিধা ছিল অবধারিত ও শৃঙ্খলহীন শাসকের ভূমিকায়। অপরদিকে নারীদের জীবন ছিল কঠোর বিধি নিষেধের নিগূঢ়ে বাঁধা বন্দি অবস্থায় শাসিতরূপে। নারীর ইচ্ছ-অনিচ্ছার কোনো মূল্য নেই। ফলে বাল্যবিয়ে এবং পুরুষের বহুবিয়ের প্রচলন ছিল খুবই স্বাভাবিক। বেগম রোকেয়া মৃতু্যর পূর্বরাতে 'নারীর অধিকার' নিয়ে তার শেষ ও অসমাপ্ত নিবন্ধে উলেস্নখ করেছিলেন। রোকেয়া আক্ষেপ করে বলেছিলেন, 'আমরা ভূমিষ্ট হইয়া শুনিয়াছি যে, আমরা জান্মিয়াছি দাসী, চিরকাল দাসী, থাকিব দাসী'।

শরীর চর্চার বিষয়েও ছিল তার অন্যতম দর্শন। তিনি বলেন, 'শিক্ষা মানসিক ও শারীরিক উভয়বিধ হওয়া চাই।' তার মতে, মনে স্ফুর্তি আনার জন্য দেহে স্ফুর্তি আনা প্রয়োজন। আর শরীরে স্ফুর্তি আনতে হলে হাত পা খাটানো অর্থাৎ শারীরিক পরিশ্রম করা দরকার। রোকেয়া বলেন, 'শুধু ঘুরাফেরা করলেই ব্যায়াম হবে না। প্রতিদিন অন্তত আধ ঘণ্টা দৌড়াদৌড়ি করা দরকার।'

বেগম রোকেয়ার ভাবনা, বক্তব্য ও কর্মকান্ড পর্যালোচনা করলে খুব সহজেই বুঝা যায় যে, তিনি মানুষের মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়ে বেশ সচেতন ছিলেন। তিনি পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি প্রায়োগিক ও মানসিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছিলেন। রোকেয়ার জীবনাবসানের প্রায় শত বছর পরে বর্তমান বিশ্ব প্রায়োগিক শিক্ষা ও মানসিক শিক্ষার দিকেই এগিয়ে চলেছে। আমরা বলতেই পারি, সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক ও সমাজসেবীর পাশাপাশি রোকেয়া ছিলেন একজন বাস্তববাদী, সত্যদ্রষ্টা, মননশীল ও প্রগতিশীল মানসিকতাসম্পন্ন শিক্ষাদার্শনিক।

এই শিক্ষাদার্শনিকের নামে তারই জন্মস্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে উচ্চ শিক্ষার অনন্য প্রতিষ্ঠান বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার ১৫ বছর অতিক্রম করে নারী জাগরণের পথিকৃত রোকেয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নে উলেস্নখযোগ্য ভূমিকা রাখছে এই প্রতিষ্ঠানটি। দেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের অনুপাতে ছাত্রীরা অনেক বেশি এগিয়ে। বিভিন্ন বিভাগে ছাত্রীরাই একাডেমিক ফলাফলে এগিয়ে রয়েছে। এই বছর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন কর্তৃক প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণ পদকপ্রাপ্ত ছয়জনই ছাত্রী। গত বছর একটি রচনা প্রতিযোগিতায় পুরস্কারপ্রাপ্ত ২২ জনের মধ্যে ১৩ জনই ছিল ছাত্রী। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রিড়াঙ্গণেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অধ্যাপক একজন নারী, যিনি এখন উপ-উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছেন। প্রক্টর, প্রভোস্টসহ বিভিন্ন একাডেমিক ও প্রশাসনিক পদেও সফলতার সঙ্গে নারী শিক্ষকরা দায়িত্ব পালন করছেন। বেগম রোকেয়ার আদর্শ ও চেতনাকে লালন করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মুক্ত বুদ্ধিচর্চা ও শিক্ষা বিস্তারে অনন্য ভূমিকা রাখবে, রোকেয়া দিবসে এমনটিই প্রত্যাশা।

মোহাম্মদ আলী :উপ-পরিচালক (জনসংযোগ), বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে