বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বাংলাদেশে চা উৎপাদনে নতুন রেকর্ড

বিদেশে নতুন নতুন চায়ের বাজার খুঁজে বের করে সেখানে রপ্তানি শুরু এবং পুরনো বাজারগুলোতে রপ্তানির পরিমাণ বাড়াতে পারলে আমাদের অর্থনীতিতে বিশেষ করে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের ব্যাপারটি গতি পাবে।
রেজাউল করিম খোকন
  ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বাংলাদেশে চা উৎপাদনে নতুন রেকর্ড

সদ্য বিদায়ী ২০২৩ সালে বাংলাদেশে চা উৎপাদনে নতুন রেকর্ড হয়েছে। গত বছর দেশের ১৬৮টি বাগান ও ক্ষুদ্রায়তন চা-চাষিদের হাত ধরে ১০ কোটি ২৯ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামে প্রথম পরীক্ষামূলক চা চাষ শুরুর পর ১৮৪ বছরের ইতিহাসে গত বছর প্রথমবারের মতো চা উৎপাদন ১০ কোটি কেজি ছাড়িয়েছে। এর আগে সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছিল ২০২১ সালে। সে বছর দেশের সব বাগান মিলিয়ে ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছিল, এখন সেটি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ডে পরিণত হয়েছে। তৃতীয় সর্বোচ্চ চা উৎপাদনের রেকর্ড ২০১৯ সালে। ওই বছর চা উৎপাদিত হয়েছিল ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি। চায়ের ইতিহাসে উৎপাদনের সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে গত বছর। চা বোর্ড, বাগান মালিক, শ্রমিক, ক্ষুদ্র চাষি- সবার দলগত সাফল্যে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। দেশে চায়ের চাহিদা ৯ কোটি ২০ থেকে ৩০ লাখ কেজি। উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন বাড়তি চা রপ্তানিতে নজর দিতে হবে। গত বছর ১০ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা রপ্তানি হয়েছে। রপ্তানি বাড়াতে চায়ের গুণগতমান আরও বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে। তাহলে রপ্তানি বাজারও সম্প্রসারিত হবে। চা বোর্ডের পক্ষ থেকে গত বছর চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০ কোটি ২০ লাখ কেজি। সেই হিসাবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯ লাখ কেজি বেশি চা উৎপাদিত হয়েছে। তাতে আগের বছরের তুলনায় চায়ের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ। এমন সময়ে চায়ের উৎপাদনে রেকর্ড হয়েছে যখন দেশে চায়ের চাহিদা কমছে। বাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় নিলামে চায়ের বিক্রি কমেছে। একই সঙ্গে কমেছে নিলামে চায়ের গড় দামও। গত এপ্রিল থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রামে চায়ের ৩৭টি নিলামে ৭ কোটি ৩৯ লাখ কেজি চা বিক্রি হয়েছে- যা আগের মৌসুমের একই সময়ের তুলনায় ১ শতাংশ কম। আবার নিলামে কেজিপ্রতি চায়ের গড় দর গত মৌসুমের চেয়ে ১৭ টাকা কমে নেমেছে ১৮৪ টাকা ৫২ পয়সায়। দেশে চায়ের চাহিদা ৯ কোটি ২০ থেকে ৩০ লাখ কেজি। উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় এখন বাড়তি চা রপ্তানিতে নজর দিতে হবে। রপ্তানি বাড়াতে চায়ের গুণগতমান আরও বাড়ানোর প্রয়োজন। অনুকূল আবহাওয়া ও নিয়মিত সংস্কার কার্যক্রমের কারণে চা উৎপাদনে গত বছর রেকর্ড হয়েছে। তবে শুধু উৎপাদন দেখলে হবে না। উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় নিলামে চায়ের সরবরাহও বেড়েছে। তাতে প্রত্যাশা অনুযায়ী দাম পাওয়া যাচ্ছে না। নিলামে ভালো দাম না পেলে বহু চা বাগান টিকে থাকতে পারবে না। চাহিদার উদ্বৃত্ত চা রপ্তানি করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। চা রপ্তানি করতে হলে মান বাড়াতে হবে। চট্টগ্রাম ও সিলেটের চায়ের মান ভালো হলেও উত্তরাঞ্চলে ক্ষুদ্র চাষ থেকে যে চা আসছে, সেগুলো খুব নিম্নমানের। এই নিম্নমানের চা নিলাম বাজারে দামের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। চা বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী, চা বাগান ও ক্ষুদ্র চাষিদের উৎপাদিত চা নিলামে বিক্রি করতে হয়। বাগান মালিকরা সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ চা কর দিয়ে নিজেরা প্যাকেটজাত বা রপ্তানির জন্য সংগ্রহ করতে পারেন। নিলামে চায়ের গুণগতমান ও সরবরাহের ওপর দর হাঁকেন ক্রেতারা। বাংলাদেশে প্রথম চা চাষ শুরু হয়েছিল ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামের পাইওনিয়ার বাগানে। বর্তমানে চট্টগ্রাম ক্লাবের আশপাশের এলাকায় ছিল ওই বাগানে অবস্থান। সেই বাগানে প্রথম চা উৎপাদিত হয় ১৮৪৩ সালে। ১৮৭৫ সালে চট্টগ্রাম ক্লাব প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত এই বাগানে চা উৎপাদন হয়েছিল বলে ১৮৭৩ সালের চা-বিষয়ক কৃষি বিভাগের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। তবে ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চা চাষের জন্য বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত আসাম ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারস, সিলেট-এ বলা হয়, সিলেটের মালনীছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয় ১৮৫৭ সালে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, বিশ্বে ৪৭টি দেশে চা উৎপাদিত হয়। লন্ডনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটির সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, চা উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে অষ্টম। এক দশক আগে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দশম। চা পানে অভ্যস্ত মানুষ তখন তেমন ছিল না বললেই চলে। সে কারণে ব্রিটিশরা দেশের বিভিন্ন হাটে বাজারে প্রথমদিকে বিনামূল্যে চা পান করিয়েছে। চা শিল্পকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশ চা বোর্ডের প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি, বাংলাদেশ চা বোর্ডের তৃতীয় চেয়ারম্যান হিসেবে ৪ জুন ১৯৫৭ থেকে ২৩ অক্টোবর, ১৯৫৮ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। প্রথম বাঙালি চেয়ারম্যান হিসেবে চা বোর্ডে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগদানের তারিখ ৪ জুনকে চা দিবস হিসেবে পালন শুরু করেছে সরকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ববঙ্গের শিল্প উন্নয়নে উদার নীতিমালার অংশ হিসেবে চা-শিল্প ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়নে অল্প সময়ে ব্যাপক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিলেন। জাতীয়তাবাদী ও জনমুক্তির নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অন্তরের গহিনে অবহেলিত চা শ্রমিকদের দীর্ঘশ্বাসের স্পন্দন প্রতিধ্বনি হতে শোনা যায় নানাভাবে। ১৯৫৬ সালে চা-শ্রমিকদের হাত ধরে তিনি প্রথম বলেছিলেন, 'তোমাদের দুঃখের সব খবরই রাখি। এসব দুঃখ দূর করার জন্য আমরা খুবই চেষ্টা করব'। চা-শিল্প শ্রমিকদের সঙ্গে জাতীয় নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। তিনি অবহেলিত চা শিল্প শ্রমিকদের প্রতি যে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছিলেন- তা আজ জাতীয় ইতিহাসের গৌরবজনক অংশ। বাংলাদেশের চা-শিল্পের বিকাশে এবং চা-শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে তার অবদান কখনো বিস্মৃত হওয়ার নয়। স্বাধীনতার পর বিধ্বস্ত চা শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত ও পুনর্বাসিত করেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সরকার চা শিল্পকে সুদৃঢ় অবস্থানে আনয়নের লক্ষ্যে নগদ ভর্তুকি প্রদান করেন ও ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহ করেন। তিনি বিধ্বস্ত চা কারখানাগুলোর উন্নয়নে ভারতের অর্থ সহায়তায় ৩০ লাখ রুপির চা যন্ত্রপাতি আমদানি করেন। বঙ্গবন্ধু চা বাগান মালিকদের ১০০ বিঘা পর্যন্ত মালিকানা সংরক্ষণের অনুমতি দেন। এ দেশের চা চাষের উন্নয়নে চা গবেষণাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি জানতেন গবেষণা ছাড়া চায়ের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই তিনি আসামের টোকলাই চা গবেষণা কেন্দ্রের আদলে বাংলাদেশ চা গবেষণা কেন্দ্রের নাম পরিবর্তন করে একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা ইনস্টিটিউটে রূপান্তরিত করেন। তার এ দূরদর্শী সিদ্ধান্তে চা গবেষণা ইনস্টিটিউট আজ দেশের অন্যান্য জাতীয় গবেষণা ইনস্টিটিউটের ন্যায় একটি অন্যতম জাতীয় গবেষণা ইনস্টিটিউট। এছাড়া চা শ্রমিকদের জন্যও বঙ্গবন্ধু অবদান রেখেছেন। চা শ্রমিকদের ভোটাধিকার এবং নাগরিকত্ব প্রদানের ব্যবস্থা করেন। চা শ্রমিকদের পূর্ণাঙ্গ রেশন ব্যবস্থা চালু করেন। চা শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া সমাধানে চা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনে ভূমিকা রাখেন। শ্রমিক পোষ্যদের শিক্ষার আলো পৌঁছাতে বাগানে বাগানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা নেন। সারাবিশ্বে বহুল প্রচলিত একটি পানীয় চা। এক কাপ গরম চা শরীরকে যেমন চাঙা রাখে, তেমনিভাবে এর রয়েছে অনেক ভেষজ গুণ। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর যে ক'টি রপ্তানি পণ্য হতো, তার মধ্যে চা ছিল বিশেষ অবস্থানে। এ দেশ থেকে বিভিন্ন দেশে শুভেচ্ছা হিসেবে চা পাতা পাঠানোর নজির রয়েছে। চা উৎপাদন বাড়লেও রপ্তানি সে হারে বাড়ছে না। এর কারণ চায়ের গুণগত মান কিংবা আন্তর্জাতিক বাজার কমে যাওয়া নয়। বরং এ দেশের মানুষের বড় অংশ এখন চা পান করে। এটি মানুষের আয়বৃদ্ধি এবং আধুনিকতার প্রকাশ। দেশের আর্থিক উন্নতি হওয়ার কারণে মানুষের জীবনযাত্রায়ও উন্নয়ন ঘটছে। ফলে বাড়ছে চায়ের চাহিদা। ১৭ কোটি মানুষের এই দেশের নিজেরই ভোগ কম নয়। মানুষের খাদ্যাভাসের পরিবর্তন ঘটছে। চা ক্রমেই অপরিহার্য একটি পানীয় হিসেবে রূপ নিচ্ছে। বাসায় মেহমান এলে আপ্যায়নের ক্ষেত্রে প্রথমেই বিবেচিত হয় এক কাপ গরম চা। বাংলাদেশের হাতেগোনা কয়েকটি রপ্তানি পণ্যের তালিকায় একদা চায়ের অবস্থান ছিল বিশেষভাবে উলেস্নখযোগ্য। কিন্তু ৫০ বছরে চা বাগানের সংখ্যা দ্বিগুণ এবং উৎপাদন তিনগুণ হওয়া সত্ত্বেও রপ্তানি সেভাবে বাড়েনি। এর কারণ দেশেই বেড়েছে চায়ের ব্যবহার। চা পানে অনভ্যস্ত বাঙালির এখন যেন চা না হলে চলেই না। তাই রপ্তানি কমে যাওয়াকে নেতিবাচক হিসেবে দেখতে রাজি নন চায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। বরং তারা মনে করছেন, ১৭ কোটি মানুষের এই দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদাই চা শিল্পকে একটি শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। আর উৎপাদন বাড়লে রপ্তানি তো হবেই। চায়ের রাজধানী মনে করা হয় সিলেটকে। কিন্তু কালক্রমে সেই চা বাগান এখন আর সিলেটেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং পাহাড় ছেড়ে চা বাগান এখন নেমে আসছে সমতলে। বাংলাদেশের আবহাওয়া চা চাষের জন্য খুবই সহায়ক- যা এখন আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। এ দেশে উৎপাদিত চা গুণগত মানেও বিশ্বমানের। নতুন নতুন উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসায় চায়ের সম্ভাবনাও ক্রমেই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতরও হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা এক নীতিমালায় চা রপ্তানিতে উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারকদের প্রণোদনার সিদ্ধান্ত এসেছে। নিজস্ব বাগানে উৎপাদিত চা রপ্তানির ক্ষেত্রে মূল্যের ওপর ৪ শতাংশ হারে এই প্রণোদনা লাভ করবেন উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারকরা। এই সুবিধা চা উৎপাদন বৃদ্ধি এবং রপ্তানিকে উৎসাহিত করবে বলে মনে করছেন এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী দেশে এখন ১৬৭টি বাগানে চা উৎপাদিত হচ্ছে। বৃহত্তর সিলেটেই ১৩৫টি চা বাগান। এর মধ্যে মৌলভীবাজারে ৯১, হবিগঞ্জে ২৫ ও সিলেটে ১৯টি। এছাড়া চট্টগ্রামে ২২, পঞ্চগড় জেলায় ৭, রাঙ্গামাটিতে ২ এবং ঠাকুরগাঁওয়ে একটি চা বাগান রয়েছে। এর বাইরে অনেকগুলো চা বাগান এখন উৎপাদনে যাওয়ার প্রক্রিয়ায়। পাহাড় ছেড়ে সমতলেও নেমে আসছে চা বাগান। দেশের বড় বড় শিল্প গ্রম্নপগুলো চা বাগানের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতা পরে বার্ষিক চা উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ১০ লাখ কেজি। এখন তা বেড়ে প্রায় সাড়ে ১০ কেজিতে উন্নীত হয়েছে। গত ২০১৯ সালে চা উৎপাদন হয়েছে ৯ কোটি ৬০ লাখ কেজি, এখন যা আরও বেশি বৈ কম নয়। ২০২৫ সালে অন্তত সাড়ে ১২ কোটি কেজি চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা। কারণ এর মধ্যে বিদ্যমান চা বাগানে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি উৎপাদনে এসে পড়বে আরও কিছু চা বাগান। পুরনো চা বাগানগুলো সম্প্রসারণের পাশাপাশি নতুন চা বাগান গড়ে উঠছে। এখন উচ্চফলনশীল চা গাছ লাগানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে পাহাড়ে যে চারা লাগানো হচ্ছে সেগুলো হাইব্রিড ক্লোন চা এবং সমতলে বাইক্লোন চা। চাষাবাদের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ঘটেছে। বিশেষ করে পঞ্চগড় জেলায় সমতলে চা বাগান এই শিল্পে বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে। চা বাগানের জন্য বেশির উর্বর ভূমির প্রয়োজন হয় না। অনুর্বর পাথুরে ভূমি চা চাষের জন্য উপযোগী। সাধারণত এ ধরনের জমিতে অন্য ফসল হয় না। একটি চা গাছ ৬০ থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। তবে এর ভালো উৎপাদনশীলতা থাকে ৫০ থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত। এখন পুরনো চা বাগানে নতুন গাছ যেমন লাগানো হচ্ছে, তেমনিভাবে নতুন বাগানও গড়ে উঠছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামে বান্দরবানেও এখন চা বাগান গড়ে উঠছে। এক সময় যে পরিমাণ উৎপাদিত হতো, তার ৫০ ভাগই বিদেশে রপ্তানি করা যেত। কারণ তখন এতবেশি চা পান করিনি। কিন্তু এখন উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও রপ্তানি নেমে এসেছে মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশে। দুই দশক আগেও যেখানে ১ কোটি ৩০ লাখ কেজি চা রপ্তানি হতো, তা এখন নেমে এসেছে ১০ ভাগের এক ভাগে। এর কারণ সাধারণ মানুষের ধীরে ধীরে অভিজাত মানসিকতার হয়ে ওঠা। আন্তর্জাতিক বাজারে চায়ের চাহিদা ব্যাপক। কারণ এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি পানীয়। চায়ের বিশ্ববাজারে সেই আগের অবস্থান ফিরে পেতে হলে উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে। বাংলাদেশ হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ চা উৎপাদনকারী দেশ। এর চা শিল্প ব্রিটিশ শাসনামল থেকে চলে আসছে, যখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮৪০ সালে চট্টগ্রামে চা ব্যবসা শুরু করে। বর্তমানে, বাংলাদেশে ১৬৭টি বাণিজ্যিক চা এস্টেট রয়েছে, যার মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কর্মক্ষম চা বাগান। এখানকার এই শিল্প বিশ্বের ৩% চা উৎপাদন করে থাকে, এবং ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। এখানকার উত্তর এবং পূর্বাঞ্চলীয় জেলাসমূহে চা উৎপাদন হয়ে থাকে; উচ্চভূমি, উষ্ণ জলবায়ু, আর্দ্র এবং অতি বৃষ্টিপ্রবণ এলাকাসমূহ উন্নতমানের চা উৎপাদনের মোক্ষম পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়। এক সময়কার বিশ্বের প্রধান একটি চা রপ্তানিকারক দেশ, বাংলাদেশ এখন মাত্র সাধারণ এক রপ্তানিকারক দেশ। বাংলাদেশি মধ্যম শ্রেণির উত্থান এই শিল্পকে লাভজনক দেশীয় বাজারের দিকে আলোকপাত করে ব্যাপকভাবে চালিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশের চা বাগানে ৩,০০,০০০ অধিক বাগানি কর্মরত আছে। যার ৭৫% নারী। অনেক শ্রমিকই উপজাতি বাসিন্দা যাদের ব্রিটিশ শাসনামলে মধ্য ভারত থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল। প্রথম চা গাছ রোপণ থেকে ধরলে বাংলাদেশে চা শিল্পের বয়স ১৭৮ বছর। সুদীর্ঘ এ সময়ে দেশের মানচিত্র বদলেছে দু'বার। তবে চা শিল্পের অগ্রযাত্রা থামেনি। অমিত সম্ভাবনার অনুপাতে অনেকটা অর্জিত না হলেও এই শিল্পের অর্জনও কিন্তু কম নয়। চা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ক্রমাগত নগরায়ণের ফলে ও জনতার শহরমুখিতার কারণে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। এছাড়া সামজিক উন্নয়নের ফলেও চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়েছে। বিগত তিন দশক ধরে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ফলে চায়ের রপ্তানি হঠাৎ করেই কমে গেছে। তারপরও জাতীয় অর্থনীতিতে চা শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম এবং সুদূরপ্রসারী। জিডিপিতে চা খাতের অবদান ০ দশমিক ৮১ শতাংশ। কাজাখস্তান, উজবেকিস্তান, পাকিস্তান, ভারত, পোল্যান্ড, রাশিয়া, ইরান, যুক্তরাজ্য, আফগানিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, কুয়েত, ওমান, সুদান, সুইজারল্যান্ডসহ অনেক দেশে রপ্তানি হয় বাংলাদেশের চা। গত ১০ বছরে পৃথিবীতে চায়ের চাহিদা দ্বিগুণ বেড়েছে। এই চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় রেখে বাংলাদেশ, কেনিয়া ও শ্রীলঙ্কা পৃথিবীর প্রায় ৫২

ভাগ চায়ের চাহিদা পূরণ করছে।

চা শিল্প বিনিয়োগের অভাবে তীব্র আর্থিক সংকটের সম্মুখীন। বিদ্যমান ব্যাংক ঋণের সুদের হার এত বেশি যে বিনিয়োগের জন্য ঋণের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করা উৎপানদনকারীদের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চা চাষাধীন জমির মধ্যে প্রায় ১৬ শতাংশ অতিবয়স্ক, অলাভজনক চা এলাকা রয়েছে যার হেক্টর প্রতি বার্ষিক গড় উৎপাাদন মাত্র ৪৮২ কেজি। এই অতিবয়স্ক চা এলাকার কারণেই হেক্টর প্রতি জাতীয় গড় উৎপাদন বৃদ্ধি করা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। তাছাড়া চা বাগানের জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ, চা কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ ও নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে সমস্যা এ শিল্পের উন্নয়নের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে চা শিল্পকে প্রতি বছরই খরার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ফলে অসংখ্য গাছ মরে যাচ্ছে। এ কারণেও চায়ের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে । চা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য সরকারি হস্তক্ষেপ অপরিহার্য। চায়ের মাঠ ও কারখানা উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য নিম্ন সুদে, সহজ শর্তে পর্যাপ্ত তহবিল প্রয়োজন। চা সেক্টরে বিনিয়োগের ৫-৭ বছর পর থেকে কাক্সিক্ষত হারে উৎপাদন শুরু হয়। এ কারণে ঋণ প্রদানের বছর থেকেই সুদ আরোপ করা উচিত নয়। এছাড়া চা শিল্পকে রক্ষা করার জন্য বিদেশ থেকে চায়ের আমদানি যথাসম্ভব নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন। চা গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে চা উৎপাদন দ্বিগুণ করা সম্ভব। চা বাগানের নামে লিজ নেয়া জমির সঠিক ব্যবহার, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, সঠিক মনিটরিং, সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা, কমমূল্যে সার-কীটনাশক সরবরাহ ও ক্লোনিং চা গাছ রোপণ করলে উৎপাদন দ্বিগুণ করা সম্ভব। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি কমছে। চলতি ২০২৩ -২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধেও রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় ফেরেনি। এর ফলে সার্বিকভাবে পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধির গতি কমেছে। শুধু পোশাক রপ্তানি খাতের ওপর নির্ভরশীল না থেকে রপ্তানি খাতের বহুমুখীকরণের ওপর সব সময় জোর দিয়ে আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করার পর মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি এ বিষয়ে আবারো গুরুত্বারোপ করেছেন। মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করে যেসব রপ্তানি পণ্য তৈরি করতে হয় তার বদলে দেশীয় কাঁচামালে প্রস্তুত পণ্যসামগ্রী রপ্তানিতে জোর দিতে পরামর্শ দিয়েছেন। তার বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত ও নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশ আজ অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। শক্ত অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে আমাদের অর্থনীতির। তেমন প্রক্ষাপটে আমাদের চা শিল্পের প্রতি আরও মনোযোগী হওয়া একান্ত জরুরি হয়ে উঠেছে।

কারণ, বিদেশে নতুন নতুন চায়ের বাজার খুঁজে বের করে সেখানে রপ্তানি শুরু এবং পুরনো বাজারগুলোতে রপ্তানির পরিমাণ বাড়াতে পারলে আমাদের অর্থনীতিতে বিশেষ করে রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের ব্যাপারটি গতি পাবে।

রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত। ব্যাংকার, কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে