মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার চাই

ওসমান গনি ঢাকা
  ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার চাই

বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষার মাধ্যমেই আমরা বাঙালিরা একে অপরের সঙ্গে মনের ভাব প্রকাশ করে থাকি। এই ভাষায় কথা বলতে পেরে আমরা আত্মতৃপ্তি পাই। আমরা বাঙালিরা যেভাবে বাংলা ভাষায় কথা বলে বা লিখে আমরা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি, তা অন্য ভাষায় প্রকাশ করা আমাদের জন্য বেশ কষ্টকর। তাই পৃথিবীতে যত ভাষা রয়েছে, সব ভাষার চেয়ে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আমাদের কাছে সবার চেয়ে ঊর্ধ্বে। এতে কারও কোনো সন্দেহ থাকার কথা না। বর্তমানে আমাদের এই বাংলা ভাষা হাঁটি হাঁটি পা পা করে আজ আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা লাভ করছে। যেটা আমাদের বাঙালির কাছে সবচেয়ে বড় সম্মানের বিষয়। কিন্তু আমাদের এই ভাষা আমরা কোন ব্যক্তি বা জাতির করুণায় পাইনি। এই ভাষার জন্য আমাদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। এই ভাষা আদায় করার জন্য বাঙালি জাতি তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়েছে। শহীদ হয়েছে এ দেশের লাখ লাখ মানুষ। বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের এই প্রিয় বাংলা ভাষাকে চিনিয়ে আনতে হয়েছে। যাদের বুকের তাজা রক্তের বিনিময় আমরা আমাদের বাংলা ভাষাকে পেয়েছি, আজ আমরা তাদের কাছে চিরঋণী। কিন্তু যারা আমাদের ভাষার জন্য সংগ্রাম করে আমাদের কে বাংলা ভাষা এনে দিয়ে গেল আমরা আজ তাদের জন্য কি করতে পেরেছি? আর এই বাংলা ভাষার প্রচলনটাই বা কতটুকু ধরে রাখতে পেরেছি। যারা ভাষার জন্য নিজেদের জীবন বাজি রেখে ভাষা আনল, তারা কি আজ তাদের যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছে। আমরা প্রায় সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখি, ভাষা শহীদদের স্মৃতিগুলো অযত্ম আর অবহেলায় পড়ে থাকে। এগুলোর যথাযথ কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। প্রতিবছর ফেব্রম্নয়ারি মাস এলে আমরা আমাদের ভাষার জন্য পাগল হয়ে যাই। বছরের অন্যদিনগুলোতে এর কোনো খবর থাকে না। এমন টা হওয়া আমাদের জন্য মোটেও ঠিক না। যে ভাষার জন্য লাখ লোক শহীদ হয়ে ভাষা আনল, সেই ভাষার প্রতি আমাদের সবসময় সচেতন থাকতে হবে। ভাষার কোনো বিকৃত হয় কিনা, সে ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। দেশের সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলন হয় কিনা, সেটাও দেখতে হবে। আমাদের দেশের সর্বত্র যদি বাংলা ভাষার প্রচলন চালু রাখতে পারি, তাহলে আমাদের ভাষার জন্য সংগ্রাম স্বার্থক ও সফল হবে। এখনো আমাদের দেশের অনেক জায়গায় ভিন দেশের ভাষার প্রচলন দেখা যায়। যেটা আমাদের জন্য মোটেও কাম্য না। হঁ্যা ভিন দেশের ভাষারও প্রয়োজন আছে। দেশের কিছু আন্তর্জাতিক ব্যাপার রয়েছে, যেগুলোতে ভিনদেশি ভাষা ইংরেজির দরকার হয় বা হবে। সে ক্ষেত্রে আমরা আমাদের ভাষার স্থান দিতে হবে সবার ঊর্ধ্বে। প্রয়োজনে বাংলা ভাষার নিচে ছোট করে ভিনদেশি ভাষা ব্যবহারের নিয়ম করা যেতে পারে। নিজ দেশের ভাষাকে বিসর্জন দিয়ে অন্য দেশের ভাষাকে উপরে স্থান দিতে হবে, তা মানা যায় না। যদি দেওয়া হয়, তাহলে ভাষার জন্য বাঙালির সংগ্রাম ও রক্ত বৃথা যাবে। এটা হবে আমাদের বাঙালির জন্য হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। যেটা এদেশের কোনো শিক্ষিত বা অশিক্ষিত কোনো লোকই মেনে নেবে না। বাংলা ভাষা অতি সহজ ও মধুর ভাষা হওয়ার কারণে বিশ্বের অনেক দেশের লোকেরা এখন আস্তে আস্তে বাংলা ভাষা শিখতে শুরু করছে। তাদের এই ভাষা শেখানোর জন্য প্রশংসার দাবিদার আমাদের দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। যারা কর্মের তাগিদে বিভিন্ন দেশে গিয়ে কর্মের স্বার্থে নিজ দেশের ভাষা বিদেশিদের শেখান। অনেক ভিনদেশি লোক আমাদের দেশে আসেন আমাদের দেশের লোকজনের সঙ্গে। তারা আস্তে আস্তে বাংলা ভাষায় কথা বলেন। আবার অনেক ভিনদেশি লোক পুরোপুরি বাংলা ভাষায় কথা বলতে শিখেছেন। এটা আমাদের বাঙালিদের গৌরব। কারণ আমাদের মাতৃভাষায় ভিনদেশি লোকেরা কথা বলে। বাংলা ভাষার প্রসার ঘটাতে যদি আমাদের দেশের নিরীহ লোকেরা এতটুকু দায়িত্ব পালন করে থাকেন, তাহলে আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষিত লোকেরা কি করেন? তারা ব্যস্ত থাকেন তাদের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি শেখাতে। তারা মনে করেন, ছেলেমেয়েরা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হলে তাদের গৌরব। যেটা মোটেও ঠিক না। হঁ্যা ইংরেজি শিখবে, তবে আগে নিজ মাতৃভাষা বাংলা শেখার পর। তাহলেই তাদের গৌরব করা সাজে। নিজের মাতৃভাষা পদদলিত করে অন্য দেশের ভাষা ছেলেমেয়েদের শিখানো সেটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। ইংরেজি যেমন বর্তমানে সারা বিশ্বের ভাষা, পর্যায়ক্রমে বাংলাও হবে একদিন সারা বিশ্বের ভাষা। হয়ত সেদিন আর বেশি দূরে নয়। বর্তমানে আমাদের দেশে লাখ লাখ নতুন লেখক সৃষ্টি হয়েছে।যারা সারা বছর বিভিন্ন গল্প ও উপন্যাসের বই লিখেন একুশের বইমেলায় প্রকাশের জন্য।আর এ বইগুলো এত পাঞ্জল ভাষায় লিখেন যেগুলো মানুষ শুধু পড়তেই চায়। এতে করে মানুষের বই পড়ারও একটা অভ্যাস হচ্ছে। তবে বই লেখার ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে যাতে ভাষার বানান ও রুপ সঠিক থাকে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যেমন আমরা জীবন দিয়েছি, এই ভাষার প্রসার ঘটাতে ও আমরা জোর চেষ্টা চালিয়ে যাব। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট দাবি দুটির একটি ছিল- রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, অপরটি সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন চাই। পেছনে ফিরে তাকালে প্রশ্ন উঠতে পারে যে, দুটি দাবি কেন তোলা হলো, একটিই তো যথেষ্ট হওয়ার কথা। রাষ্ট্রভাষা যদি বাংলা হয়, তাহলেও সর্বস্তরে এর যে প্রচলন ঘটবে কি, ঘটবে না সে-বিষয়ে কোনো সংশয় ছিল কি? জবাব হচ্ছে, হঁ্যা, ছিল। প্রথমত পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা যে বাংলা হবে- এমন দাবি পূর্ববঙ্গের মানুষ তোলেনি, তারা চেয়েছে বাংলা হবে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা, অর্থাৎ দুটির একটি; তাই বাংলাকে যদি রাষ্ট্রের ভাষা হিসেবে মেনে নেওয়াও হয়, তাহলেই যে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত হয়ে যাবে, এমন ভরসা কোথায়? ভরসা নেই বলেই বোধ হয় রাষ্ট্রভাষা দাবি সঙ্গে বাংলা প্রচলনের দাবিটাও উঠেছিল।

বিশ্বে এখন বাংলাভাষীর সংখ্যা প্রচুর, ত্রিশ কোটিরও বেশি হবে; সংখ্যাবিচারে বাংলাভাষী মানুষের স্থান পঞ্চম। কিন্তু বাংলা ভাষার মর্যাদা খুবই কম। কারণ কী? কারণ হচ্ছে, আমরা সংখ্যায় অনেক ঠিকই, কিন্তু ক্ষমতায় সামান্য। অনেকটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মতোই; পরিমাণে শিক্ষিতদের সংখ্যা অনেক, কিন্তু গুণগতমান নিম্নগামী।

ক্ষমতাহীনতার একাধিক কারণ রয়েছে। প্রধান ও প্রাথমিক কারণটা হলো- জ্ঞানচর্চার অপ্রতুলতা। জ্ঞানচর্চা ঠিক মতো হচ্ছে না। আর এর কারণ হলো- চর্চা যেটুকু যা হচ্ছে, তা বাংলাভাষার মাধ্যমে ঘটছে না। জ্ঞানই যে শক্তি, এই সত্যে কোনো ভেজাল নেই; জ্ঞানের চর্চায় আমরা উঁচুতে উঠতে পারছি না; মেধা ও মনন অবিকশিত রয়ে যাচ্ছে। ফলে ক্ষমতা বাড়ছে না। আমরা তরল হচ্ছি, ঘন হতে ব্যর্থ হয়ে। বিশ্বে তাই বাঙালির কোনো সম্মান নেই। ওদিকে সব বাঙালি বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে, কেননা বাংলাদেশেই হচ্ছে বাংলাভাষা চর্চার কেন্দ্রভূমি এবং ভরসাস্থল। আবারও ওই শাসক শ্রেণির জনশত্রম্নতার বিষয়টির কাছেই যেতে হয়। রাষ্ট্র অনেক কিছুই করতে পারেনি; রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা বাংলা ভাষার চর্চার ক্ষেত্রেই ঘটেছে। ওই ব্যর্থতা অনেক ব্যর্থতার প্রতিপালক। ব্যর্থতার কারণ হলো- রাষ্ট্র ভেঙেছে ঠিকই, কিন্তু বদলায়নি। ভেতরে সে আগের মতোই রয়ে গেছে। বদলাবার কথা ছিল, কেননা এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ফলশ্রম্নতিতে। মুক্তির ওই সংগ্রামেরই অংশ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, এরই পরিণতিতে মুক্তিযুদ্ধ এবং এর ভেতর দিয়েই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। মুক্তির জন্য প্রয়োজন ছিল বাংলাভাষা চর্চার স্বাধীনতা। সেটা সম্ভব হতো রাষ্ট্রের চরিত্রে, অর্থাৎ রাষ্ট্রের ভেতর শাসক ও শাসিতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে যদি মৌলিক পরিবর্তন ঘটত তবেই। সেটা ঘটেনি। শাসক বদল হয়েছে, শাসক-শাসিতের সম্পর্কে বদল হয়নি। মুক্তির সংগ্রামে চালিকাশক্তি ছিল সাধারণ মানুষ। সেই সাধারণ মানুষের মুক্তি আসেনি। তাই তাদের মাতৃভাষাও মুক্তি পায়নি; আগের মতোই শাসকদের অবহেলা ও উৎপীড়নের শিকার হচ্ছে।

কিন্তু হতাশ হওয়ার কারণ নেই। জনগণ আছে এবং তাদের ভাষাও থাকবে। কেবল বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়ে যে বাঙালিরা রয়েছে, তাদের ভাষা অবশ্যই নিজের জন্য মর্যাদার স্থান খুঁজে নেবে। কিন্তু দায়িত্বটা বাংলাদেশের মানুষেরই, নেতৃত্ব তাদেরই দিতে হবে। বাংলাভাষার উৎকর্ষ ও প্রয়োগ বৃদ্ধির জন্য আমরা বিভিন্ন কাজের সুপারিশ করতে পারি। যেমন পাঠাগার গড়ে তোলা; সংস্কৃতিচর্চার গুণ ও ব্যাপকতা বৃদ্ধি। বলতে পারি, ব্যক্তিগত উদ্যোগ গ্রহণের আবশ্যকতার কথা। সাহিত্যচর্চার অপরিহার্যতার বিষয় তুলে ধরতে পারি। উচ্চ আদালতের সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের অনুরোধ জানাতে পারি বাংলা ব্যবহারের। কিন্তু মূল ব্যাধিটাকে যেন না ভুলি। সেটা হলো- বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চরিত্র। ওই চরিত্রে বদল ঘটিয়ে, রাষ্ট্রকে জনগণের অধীনে নিয়ে আসতে হবে। সেটা ঘটলে রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিজীবনের সর্বত্র জনগণের ভাষা অব্যাহতরূপে ব্যবহৃত হবে, এর উন্নতির পথে অন্তরায় থাকবে না।

বাংলাভাষার প্রয়োজনে আমরা রাষ্ট্র ভেঙেছি, ওই একই প্রয়োজনে শাসক-শাসিতের সম্পর্কের ভেতর পরিবর্তন আনা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। বাংলা ভাষার মর্যাদা আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। দেশের সর্বত্রই বাংলা ভাষার প্রচলনের ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সন্তানদের বাংলা ভাষা শেখার ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে