বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বিএনপির সঙ্গে কি জনগণ আছে?

সরকারবিরোধী আন্দোলন করা কিংবা ক্ষমতায় থেকে বিরোধী দলের আন্দোলন দমনে বারবার আওয়ামী লীগের কাছে 'ধরাশায়ী' হয়েছে বিএনপি। সাংগঠনিক দুর্বলতা, দলের শীর্ষপর্যায়ের নেতৃত্বে আমলা, ব্যবসায়ী, সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের প্রতি অতি নির্ভরশীলতা ও তৃণমূল নেতাদের উপেক্ষিত হওয়ায় বিএনপির আজ এই অবস্থা বলে মনে হয়। আন্দোলন করার জন্য পরিস্থিতি এবং পরিবেশ সব সময় এক থাকে না। বিশেষ করে রাজপথের আন্দোলন করতে হলে একটি দলের বা সংগঠনের একটি মজবুত সাংগঠনিক অবস্থা থাকতে হয়। সাংগঠনিকভাবে তাদের জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হয়। কিন্তু বিএনপি তা করেনি কিংবা করতে পারেনি।
ড. সুলতান মাহমুদ রানা
  ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বিএনপির সঙ্গে কি জনগণ আছে?

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী দল। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বর্তমানে রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগের শক্তি বাড়ছে আর বিএনপির কমছে। গত ৭ জানুয়ারি পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিএনপি এখন অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বলা যায়, আওয়ামী লীগ খেলছে ফাঁকা মাঠে আর বিএনপি মোটেই মাঠে নেই। মাঠ এখন পুরোটাই আওয়ামী লীগ তথা সরকারের দখলে। আর এই দখলস্বত্বের পেছনের অন্যতম কারণ বিএনপির লক্ষ্যহীন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এখন যে কোনো সময়ের তুলনায় সরকারের অবস্থান যথেষ্ট সুবিধাজনক। বিরোধীদের রাজনৈতিক বিরোধিতার ইসু্য নেই বললেই চলে। বরং মার্কিন প্রেসিডেন্টের চিঠির পর বর্তমান সরকারের আত্মবিশ্বাসের স্তরটি অনেকটা পোক্ত হয়েছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রকে নির্ভর করে বিএনপির রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার যে আত্মতৃপ্তি ছিল সেটি এখন বিপরীতমুখীতে রূপ নিয়েছে।

এই মুহূর্তে সরকারের যে উন্নয়নযাত্রা চলছে, সেদিকে আরো ভালোভাবে নজর দেওয়া উচিত। আগামী দিনের বাংলাদেশ হোক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির সেটা আমরা সবাই চাই। দেশের পরিস্থিতি যথাযথ উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালনা করতে এবং দেশকে শান্ত ও স্বাভাবিক রাখতে অনিয়ম, অন্যায় ও দুর্নীতির প্রশ্রয় না দিয়ে এর বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানে থাকার নীতিটিই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।

আমরা প্রায়ই লক্ষ্য করি যে, সরকারের কয়েকটি সহযোগী সংগঠনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, কোন্দলসহ টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। সেদিকটা বিশেষভাবে নজর দিয়ে সরকারেরে কার্যক্রম পরিচালনা করা যুক্তিসঙ্গত হবে।

বিএনপি-জামায়াতের অঙ্গ সংগঠনগুলো অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। শুধু হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি থাকলে তাদের বিচ্ছিন্ন মিছিল-মিটিংয়ের খবর পাওয়া যায়। আবার বিভিন্ন সময়ে লক্ষ্য করা যায় যে, মন্ত্রী-এমপিদের তত্ত্বাবধানে বিএনপি এমনকি চিহ্নিত জামায়াত কর্মীরাও আওয়ামী লীগে ভিড়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। মূলত তারা নিজেদের সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে এমন ধরনের কৌশলী অবস্থান নিতে সচেষ্ট রয়েছে। কারণ অনেকেই মামলা এবং অভিযোগে জর্জরিত হয়ে ভবিষ্যতে নিজেদের অস্তিত্ব ফিরে পাওয়া না পওয়ার আশঙ্কা থেকে সরকারি দলে যোগ দেওয়ার সুযোগ হাতিয়ে নিতে চায়। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের এ বিষয়ে সজাগ ভূমিকা রাখতে হবে যাতে এসব অনুপ্রবেশকারী রাজনীতিবিদরা নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করতেই ব্যস্ত না হয়ে পড়ে।

আগামীর দিনগুলো বিএনপির জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ- তা বুঝতে কারো বাকি নেই। বিএনপি ইতোমধ্যেই বুঝতে পেরেছে যে, রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করে নিজেদের অবস্থান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দেখতে পাওয়া অত সহজ নয়। এই পরিস্থিতি কল্পনা করে বিএনপিকে ঠিক করতে হবে যে তারা কীভাবে রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে। বিএনপির অনেক নেতাকর্মী জানতো এবং বুঝতো যে, নির্বাচনে না গেলে দলের অস্তিত্ব আরও দুর্বল হয়ে যাবে। নির্বাচন নিয়ে বিএনপির উভয় সংকট- তাদের নিজেদের জন্যই বুমেরাং হয়ে গেল। মূল বিএনপির লন্ডন বার্তা তাদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়েছে।

কাজেই আগামীর রাজনীতি নিয়ে বিএনপি কী ভাবছে- এখন এটাই বিএনপির ইসু্য। কারণ যে কোনো সময়ই সরকার নির্বাচনের আয়োজন করলে বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ দেখা দেবে। বিএনপিকে অপ্রস্তুত রেখে সরকার সামনের দিকে এগিয়ে যাবে এটি রাজনীতির সাধারণ সূত্র। এ জন্য বিএনপির রাজনীতির যথাযথ প্রস্তুত না থাকা অর্থ হচ্ছে নিজেদের পরাজয় মেনে নেওয়া। কাজেই এখনই সময় বিএনপিকে যথাযথ সাংগঠনিক শক্ত ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া।

এই মুহূর্তে বিএনপিজোটের পক্ষে সাংগঠনিকভাবে একটা ফলপ্রসূ আন্দোলন গড়ে তোলা অসম্ভব। আর এ কারণেই অযথা বিএনপির বিরুদ্ধে নানাবিধ ভাষণে বা বিবৃতিতে ক্ষমতাসীনদের আস্ফালন নিঃসন্দেহে নিরর্থক ও অপ্রয়োজনীয়। অন্যদিকে, বিএনপির বর্তমান বেহাল অবস্থার অন্যতম কারণ তাদের নিজেদেরই বক্তব্য-বিবৃতি। বিএনপি নেতাদের বক্তব্য, বিবৃতি ও কর্মসূচির ঘোষণাকেও দায়ী করা যায়। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে দলটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে নানা নেতিবাচক শঙ্কা জাগিয়ে তুলেছে সাধারণ জনগণের মনে। এর মধ্যে প্রধান প্রশ্ন হলো- বিএনপি কী পথ হারিয়ে ফেলেছে?

সরকারবিরোধী আন্দোলন করা কিংবা ক্ষমতায় থেকে বিরোধী দলের আন্দোলন দমনে বারবার আওয়ামী লীগের কাছে 'ধরাশায়ী' হয়েছে বিএনপি। সাংগঠনিক দুর্বলতা, দলের শীর্ষপর্যায়ের নেতৃত্বে আমলা, ব্যবসায়ী, সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের প্রতি অতি নির্ভরশীলতা ও তৃণমূল নেতাদের উপেক্ষিত হওয়ায় বিএনপির আজ এই অবস্থা বলে মনে হয়। আন্দোলন করার জন্য পরিস্থিতি এবং পরিবেশ সব সময় এক থাকে না। বিশেষ করে রাজপথের আন্দোলন করতে হলে একটি দলের বা সংগঠনের একটি মজবুত সাংগঠনিক অবস্থা থাকতে হয়। সাংগঠনিকভাবে তাদের জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হয়। কিন্তু বিএনপি তা করেনি কিংবা করতে পারেনি।

এখনো সামনে অনেক সময় আছে, বিএনপি তাদের ভুল শোধরাতে পারে। সরকারের ব্যর্থতাগুলোকে জনগণের সামনে তুলে ধরে, সব নেতিবাচক কার্যক্রম পরিহার করে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে গেলে অনেক দূরে যাওয়া সম্ভব। এতে প্রয়োজনে জামায়াতের সঙ্গে স্থায়ী মৈত্রির সম্পর্ক ত্যাগ করে ইতিবাচক গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যাওয়া যেতে পারে। আর এক্ষেত্রে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সরকারের আন্তরিক সহযোগিতা ও গণতান্ত্রিক আচরণও দেশের ইতিবাচক রাজনৈতিক ধারা স্থায়ী হওয়ার সুযোগ তৈরি করতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর এখন মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত দেশে গণতন্ত্রের পাশাপাশি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠা করা। কারণ উন্নয়ন না থাকলে শুধু নির্বাচনী গণতন্ত্রের অর্থ নেই। নির্বাচিত সরকারকে উন্নয়নের ধারক হতে হবে। এই জন্য নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রীদেরও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ আর উন্নয়নের অংশীদার হওয়ায় রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় হওয়া দরকার। আর এ লক্ষ্যে যে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক দেশের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় প্রধান দলকেই সমান দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ গণতান্ত্রিকতার স্বার্থে সরকার পরিচালনা এবং আন্দোলন পরিচালনা কিংবা বিরোধী দলের অবস্থান উভয়টিরই প্রয়োজন রয়েছে। এটির যথার্থতা প্রমাণের জন্য অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করা প্রয়োজন।

ড. সুলতান মাহমুদ রানা : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে