বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

বন্যপ্রাণী রক্ষায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে হবে

পাখিরা না থাকলে প্রাণ হারাবে প্রকৃতি। প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য না বাঁচলে মানুষের বেঁচে থাকার সুযোগ নেই। তাই আমাদের বেঁচে থাকতে হলে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাই আসুন, পরিবেশ, প্রতিবেশ, বন, বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করি, রক্ষা হবে দেশ, রক্ষা হবে মানুষ।
শফিকুল ইসলাম খোকন
  ০৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
বন্যপ্রাণী রক্ষায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে হবে

বন আর প্রাণী- এ দু'টি শব্দের সঙ্গে আমরা অতি পরিচিত আর এ দু'টির সঙ্গেও সম্পর্কটাও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বনের সঙ্গে প্রাণীর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। একটির সঙ্গে অপরটির মিল থাকায় একে অন্যের ছাড়া চলতে পারে না। প্রাণিকুল টিকে থাকতে হলে বনের প্রয়োজন। বন বন্যপ্রাণী বা জীববৈচিত্র্য ছাড়া মানুষও বাঁচতে পারে না। তাই বন, বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় স্থানীয় জনগোষ্ঠী সম্পৃক্তের বিকল্প নেই।

১৯৭৩ সালের ৩ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে ২১টি দেশের অনুমোদনের মধ্য দিয়ে গৃহীত হয় 'বিপন্ন বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদ প্রজাতির আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কিত সম্মেলন ১৯৭৩ (সাইটেস) সনদ'। এই সনদের প্রধান উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদকুলের অতিমাত্রায় ব্যবহার রোধ করা। বাংলাদেশ ১৯৮১ সালের ২০ নভেম্বর এই সনদে সই করে এবং ১৯৮২ সালের ১৮ ফেব্রম্নয়ারি থেকে সনদটি বাংলাদেশের জন্য কার্যকর হয়। ৩ মার্চ 'সাইটেস সনদ' সই হয়েছিল বলে জাতিসংঘের ৫৮তম সাধারণ সভায় ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর দিনটিকে 'বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস' হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

আমরা কিছু কিছু বিষয়ে শুধু দিবসকেন্দ্রিক মনে রাখি। দিবস আসলেই আমরা আবেগে আবেগাপস্নুত হয়ে যাই। দিবস শেষে আর ওই দিবসের বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবছি না বা ভাবার সময়ও খুঁজি না। অনেক দিবস আছে যা শুধু দিবসের দিনই মনে রাখার বিষয় নয়, সারাবছরই লালন করতে হয়। ঠিক এমন একটি দিবস বন্যপ্রাণী দিবস। আগেই বলেছি, বন ছাড়া তেমন বন্যপ্রাণী বাঁচে না, তেমনি বন, বন্যপ্রাণী জীববৈচিত্র্য ছাড়া মানুষেরও বাঁচার সুযোগ নেই। এজন্যই প্রতিদিন দিবস হওয়া উচিত। বন, প্রকৃতি আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। অথচ আমরা সেই বনকে যেমন ধ্বংস করি তেমনি বন্যপ্রাণী হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠি।

একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বিশ্বে গত ৫০ বছরের মধ্যে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা ৭০ ভাগ কমে গেছে। এর প্রভাবে বিশ্ব এক বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে এমন তথ্য দিয়েছেন ওয়াল্ডওয়াইড ফান্ড ফর নেচার নামে একটি প্রতিষ্ঠান। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমছে এবং বিশ্বের জীববৈচিত্র্য এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে আছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

এদিকে বন অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সংরক্ষিত বন জবর দখল হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৬১৩ একর, আর আইনি পদক্ষেপসহ উদ্ধারের জন্য উদ্যোগ রয়েছে মাত্র ১২ হাজার ২১৪ একর বনভূমির। এ বনভূমি কবে উদ্ধার হবে ও কবে তাতে বনের প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার হবে, পাঠক সহজেই অনুমান করতে পারবেন। বন্যপ্রাণী বা প্রতিবেশ রক্ষায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এসব কাজে মানুষকে বিরত রাখার সুযোগ নেই। বন আইনকে জনবান্ধব করতে হবে, জনগণের অংশগ্রহণের উপযোগী করতে হবে। বন ও প্রতিবেশের দায়িত্ব শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের নয়, এই বোধ সবার মধ্যে জাগ্রত করা দরকার।

বন্যপ্রাণী সুরক্ষা করলে জাতিসংঘের টেকসই লক্ষ্যমাত্রাগুলোও (এসডিজি) পূরণ হবে। বিশেষ করে ১, ২, ১২, ১৩, ১৪ এবং ১৫ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বন্যপ্রাণী সুরক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সুরক্ষা ও বন্যপ্রাণীর জীবন নিরাপদ করার ভেতর দিয়ে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে এখনো কোনো দৃশ্যমান তৎপরতা শুরু করেনি। 'বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সুরক্ষা ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২' থাকলেও দেশে সাফারি পার্ক, প্রাকৃতিক বন, উপকূলের রক্ষাকবজ বনাঞ্চল, গ্রামীণ বন বা জলাভূমি, কোথাও বন্যপ্রাণী নিরাপদ নয়।

জলবায়ুর প্রভাবে ও শিকারিদের দৌরাত্ম্যে ভালো নেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দেশের প্রাণিসম্পদ। ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে প্রায় তিনশ' প্রজাতির বন্যপ্রাণী। বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে আরও শ'খানেক। প্রকৃতির প্রতি মানুষের নৃশংসতা, পরিবেশদূষণ ও পরিবর্তিত জলবায়ুর কারণে এই অবস্থার সৃষ্টির মন্তব্য প্রাণিবিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, সময়ের সঙ্গে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা আরও জোরালো হচ্ছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে আরও ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ প্রাণী বিলুপ্ত হতে পারে। ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট বাংলাদেশ (ডবিস্নউটিবি) ও দ্য ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন ইউনিয়ন (আইইউসিএন) বাংলাদেশ শাখার এক জরিপে দেখা গেছে, ইতোমধ্যে দেশের প্রায় দেড়শ' প্রজাতির বন্যপ্রাণী, মেরুদন্ডী প্রাণীর ১৩টি, ৪৭ প্রজাতির দেশি পাখি, ৮ প্রজাতির উভচর ও ৬৩ প্রজাতির সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী প্রাণীর ১০টি মিলিয়ে প্রায় তিনশ' প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এ ছাড়া বিপন্ন ৪৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। একইভাবে বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে ১০৬ প্রজাতির নলবাহী উদ্ভিদ। বাড়তে থাকা জনসংখ্যার চাপ, ব্যাপকহারে বন উজাড়, বন্যপ্রাণী শিকার, নদীর নাব্যতা হ্রাস, ভারসাম্যহীন পরিবেশ, অবহেলা ও অযত্নের কারণেই বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে নানা প্রজাতির এসব প্রাণী। এ অবস্থা চলতে থাকলে একটা সময় জীববৈচিত্র্য শূন্য হয়ে পড়বে দেশ। এতে দেখা দিতে পারে বিশাল প্রাকৃতিক শূন্যতা। আইইউসিএনের বন্যপ্রাণিবিদ ও গবেষকদের মতে, সংরক্ষণ ও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে মোট বন্যপ্রজাতির ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ আগামী কয়েক বছরে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। তাদের মতে, বিদ্যমান পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে যে হাজারখানেক প্রজাতির বন্যপ্রাণী টিকে আছে তারা পরিবর্তিত পরিবেশে বিপন্ন। অর্ধেক প্রজাতিই এখন কোনো না কোনো ধরনের হুমকির সম্মুখীন।

বন্যপ্রাণী নিয়ে এত সভা, সমাবেশ ইত্যাদি হয়; এছাড়া এত আইন, বিধি থাকতেও কোনো কার্যকর দেখা যাচ্ছে না বন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বা রক্ষার্থে। আইন যতই থাকুক না অপরাধীরা আইনের চেয়েও শক্তিশালী মনে হচ্ছে। যদি তাই না হয় তাহলে কেন বন, বনভূমি, বন্যপ্রাণী ধংস হচ্ছে? এমন প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক নয় কি; সবার আগে আমাদের দেশের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি আন্তরিক হতে হবে, ভালোবাসতে হবে। এখানে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি স্থানীয় সরকার তথা ইউনিয়ন পরিষদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদ? অথচ ইউনিয়ন পরিষদ আইনে দেখভাল করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ আইনের ৪৫ (১) ধারায় ১৩ স্থায়ী কমিটি রয়েছে। ওই কমিটিতে (ট) 'পরিবেশ উন্নয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণ' কথা রয়েছে। কিন্তু ওই কমিটির দায়িত্ব কতটুকু বাস্তবে আমরা দেখছে?

একটি কথা উলেস্নখ না করলেই নয়, আমরা দীর্ঘকাল ধরে দেখে আসছি, কারোর বাড়িতে আগুন লাগলে প্রথমে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন আগুন নেভানোর জন্য। অসুখ-বিসুখসহ নানা ধরনের বিপদে-আপদে একে অপরের সাহায্য করে থাকে এবং তাদের মধ্যে আন্তরিকতার কোনো অভাবে থাকে না। সেখানে থাকে না কোনো ভেদাভেদ, থাকে না কোনো দ্বন্দ্ব, থাকে না হিংসা। তাছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে কোনো বিরোধ হলে স্থানীয়ভাবেই সমাধান হয়ে থাকে অর্থাৎ স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠান তথা ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা। ঠিক এমনই প্রকৃতি, বন, বন্যপ্রাণী, বনজসম্পদ সংরক্ষণ, রক্ষা এবং টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা অপরিহার্য। স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। এজন্য স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত সহ-ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলোর (সিএমসি) টেকসই আর্থিক সক্ষমতা, স্থায়ী কমিটির নিয়মিত সভা এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করাও জরুরি। পাশাপাশি এসব সম্পদ রক্ষার্থে স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতামূলক উঠান বৈঠক, প্রচার-প্রচারণা, লিফলেট বিতরণ করা, ইউনিয়ন পরিষদের স্থায়ী কমিটির নিয়মিত সভা করে ত্রম্নটিগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া, স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সচেতন করে বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় ওয়ার্ডভিত্তিক কমিটি করার পাশাপাশি সময়োপযোগী আইন সংশোধন করে বন, পরিবেশ, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে বনবিভাগকে আধুনিকায়ন, লোকবল বৃদ্ধিসহ একটি নতুন বিশেষ বাহিনী গঠনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যার নাম হতে পারে 'সবুজ বাহিনী, বন বাহিনী'। যে নামেই হোক না কেন এখন বন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে বিশেষ বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। সুন্দরবনসহ উপকূলীয় যে বনসম্পদ রয়েছে তা রক্ষা করার জন্য বনবিভাগের মতো মান্ধাতা আমলের আইন আর বাহিনী দ্বারা সম্ভব নয়। বিশেষ করে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ, ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) পাথরঘাটা উপকূল সুরক্ষা আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ, জলবায়ু, জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করছে। সম্প্রতি ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) এবং ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ বন ও পরিবেশ রক্ষায় বিশেষ বাহিনীর গঠনের প্রস্তাব দেন।

পরিশেষে বলতে চাই, পাখিরা না থাকলে প্রাণ হারাবে প্রকৃতি। প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য না বাঁচলে মানুষের বেঁচে থাকার সুযোগ নেই। তাই আমাদের বেঁচে থাকতে হলে প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তাই আসুন, পরিবেশ, প্রতিবেশ, বন, বন্যপ্রাণী, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করি, রক্ষা হবে দেশ, রক্ষা হবে মানুষ।

শফিকুল ইসলাম খোকন : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে