বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত ইসু্য

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে ভারত যেভাবে খাদ্যপণ্য, আশ্রয়, চিকিৎসা ও মানবিক সাহায্যে নিয়ে এগিয়ে আসছিল। সেটি ভুলে যাওয়ার বিষয় নয়। ইতিহাস তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
মাহমুদুল হক অনসারী
  ০৮ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত ইসু্য

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতীয় ইসু্য একটি বিষয়। এ দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে কমবেশি ভারতবিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়। ভারতের বিরুদ্ধে দু'একটি কথা বক্তৃতায় না রাখতে পারলে সেই সভা সমাবেশ সফল হয় বলে সেই দলের নেতানেত্রীরা মনে করেন না। একদিকে ভারতের নানা কর্মকান্ডের বিরোধিতা, অপরদিকে ভারতীয় অ্যাম্বাসিতে গিয়ে তাদের সঙ্গে সখ্যতা বৃদ্ধিতে নিয়েমিত যোগাযোগ। জনমাঠে এসে ওইসব রাজনৈতিক নেতারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের দাবি করেন সভা-সমাবেশে।

বাংলাদেশের বিশেষ দিবস, বিশেষ দিন ও সময়কে সামনে রেখে এসব বক্তব্য রাখতে দেখা যায় কতিপয় রাজনৈতিক নেতাদের। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সমাপ্ত হয়েছে। সরকার গঠন হয়েছে, বর্তমান সরকার জনগণের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা মৌলিক অধিকার পূরণে সচেষ্ট আছে। সেই সময়ে পরাজিত ও ক্ষমতার বাইরে থাকা কতিপয় দল ও রাজনৈতিক নেতারা এসব বক্তব্যে জনগণের মধ্যে কিছুটা হলেও বিভ্রান্ত ছড়াচ্ছে। ভারত বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের পাশে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বাক্ষর রেখেছে, ইতিহাস তার সাক্ষী।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে ভারত যেভাবে খাদ্যপণ্য, আশ্রয়, চিকিৎসা ও মানবিক সাহায্যে নিয়ে এগিয়ে আসছিল। সেটি ভুলে যাওয়ার বিষয় নয়। ইতিহাস তার জ্বলন্ত প্রমাণ। বাংলাদেশের চতুর্দিকে ভারত আর বার্মায় ঘেরা। বার্মার রাজনৈতিক পরিস্থিতি সাম্প্রতিক সময়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। জাতিগত দাঙ্গা পুরো বার্মাকে গ্রাস করে ফেলছে। ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নাগরিক উদ্বাস্তু হিসেবে বাংলাদেশের জন্য ক্যানসার হিসেবে দেখা দিয়েছে। ভারতে রোহিঙ্গাসহ যেসব অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নাগরিক, সেই দেশে আশ্রয় নিয়েছিল তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে ভারত সরকার। বাংলাদেশের অব্যাহত প্রচেষ্টা কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার হলেও বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে সফলতার মুখ দেখছে না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন কর্মসূচিতে আন্তর্জাতিক সমর্থন ছাড়া বাংলাদেশের সফল হওয়া খুবই কঠিন। আন্তর্জাতিক যেসব দেশ ও সংস্থা রোহিঙ্গাদের নিয়ে ক্যাম্পে কাজ করছে, তাদের গভীর ষড়যন্ত্র লক্ষ্য করা যায়। ক্যাম্পে সন্ত্রাস, জঙ্গি নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এসব আন্তর্জাতিক নানা ষড়যন্ত্রের অংশ। এসব ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশের পাশে বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী ভারতসহ অন্য দেশকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিবেশী ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা ছিল, আছে ও থাকবে। মনে রাখতে হবে, প্রতিবেশী পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে হলেও সুসম্পর্ক রাখতে হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে যে কোনো কর্মকান্ডে ভারতের একটি ভূমিকা থাকে। এই দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি সরকার সবকিছুর মধ্যেই ভারতের ভূমিকা প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আছে। এই অঞ্চলের শান্তিশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য অস্থিতিশীল পরিবেশ কোনোভাবেই কারো জন্য মঙ্গলজনক নয়। স্থিতিশীল নাগরিক জীবন রক্ষার জন্য বাংলাদেশকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। পণ্য আসবে-যাবে, আমার কাছে যা নেই, তা অন্য দেশ থেকে আমদানি করতে হবে। জনগণের খাদ্যপ্রাপ্তি, অন্ন, চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে যে দেশ থেকে আমদানি করা দরকার সেখান থেকেই সরকারকে আনতে হবে। ভারতসহ কতিপয় দেশ নানাভাবে বিভিন্ন সেক্টরে তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো নানা জাতের ভোগ্যপণ্যের মধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। সেই ক্ষেত্রে আদা, রসুন, পেঁয়াজ, মরিচ, মসলা থেকে চিকিৎসাসেবা পর্যন্ত প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের স্মরণাপন্ন হতে হয় বাংলাদেশের জনগণকে। চিকিৎসার জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার দুরারোগ্য রোগী ভারতের হাইকমিশন অফিসে পাড়ি জমান।

অল্প খরচে ভারতে গিয়ে বাংলাদেশের জনগণ স্বাচ্ছন্দ্যে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছে। এইভাবে বাংলাদেশের নিত্যপণ্যের বাজারে ভারতীয় পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মরিচ, মসলা আমদানি না হলে কি যে অবস্থা নাগরিক জীবনে তৈরি হতো সেটি নিশ্চয় আমাদের রাজনীতিবিদরা ভালোভাবেই বুঝেন। তাই তারা চায় ভারতীয় খাদ্যপণ্য বাংলাদেশে না ঢুকুক। জনগণ অভাব-অনটনে খাদ্যপণ্যের অভাবে জীবনযাপন করুক। তাহলে রাজনীতিবিদদের জন্য মজা হবে, ইসু্য তৈরি হবে। রাজনীতির মাঠ গরম করতে পারে। গরুর মাংস বাংলাদেশের বাজারে ৮ শত টাকা থেকে কোনো কোনো স্থানে ১০০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশের যেই পরিমাণ জনসংখ্যা বিশেষ করে মুসলিম জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তাই এই দেশে গরুর মাংসের চাহিদাটা সারা বছরই থাকে। এই মাংস যদি গরু অথবা গরুর মাংস হিসেবে ভারত থেকে আমদানি না হতো, তাহলে কি পরিস্থিতি বাংলাদেশের সমাজে দেখা দিত সেই কথাটি একবারও ভারতবিরোধী রাজনৈতিক বক্তারা চিন্তা করে দেখছে। তারা রাজনীতি, ক্ষমতা আর জনগণকে বিভ্রান্ত করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই খোঁজে পায় না। জনগণ শান্তি-স্বস্তি খাদ্য প্রাপ্তি নাগরিক অধিকার চায় সরকারের কাছে। সরকার যেখান থেকে সুবিধা সেখান থেকে দেশবাসীর জন্য পণ্যসামগ্রী আমদানি করবেন, সেটিই প্রত্যাশা।

আমরা স্বস্তির মধ্যে থাকতে চাই। নিত্যপণ্য সঠিকভাবে উৎপাদন আমদানি সামঞ্জস্য রেখে নাগরিক জীবনকে ভোগান্তিহীন রাখতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতি যেভাবে রাখলে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিরাপদ থাকবে, সেইভাবেই দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশের জনগণ রাজনীতির কথা, সরকার সবকিছু বুঝতে সক্ষম। ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করে জনগণকে অস্বস্তিতে ফেলার রাজনীতির সুযোগ হয়তো ফিরে নাও আসতে পারে। ভালো-মন্দ বুঝে-শুনে দেশপ্রেমিক ও জনচিন্তা মাথায় রেখে রাজনৈতিক কথাবার্তা বলা উচিত। যারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের বক্তব্যের রাজনীতি করছে, তারা সারাক্ষণ ভারতীয় পণ্য ব্যবহার করে যাচ্ছে। আর জনগণকে বলছে, ভারতীয় পণ্য বর্জন করার কথা, যা কোনো দিনও বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং, যা সম্ভব নয়, অসম্ভব বিষয় সেসব বক্তব্য বিবৃতি এবং স্যোশাল মিডিয়ায় না আনাই ভালো। আসুন আমরা চিন্তাচেতনা বাস্তবতায় দেশপ্রেমিক হই।

মাহমুদুল হক আনসারী :কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে