সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক তার আর আমার পরিচয় কবিতায় যথার্থই বলেছেন, 'পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার ইতিহাস আছে গর্বের/কখনোই ভয় করি নাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।' আমার পরিচয় কবিতায় কবি বাংলাদেশের যেসব ইতিহাস আর ঐতিহ্য আছে তাই স্মরণ করেছেন প্রতিটি চরণে এবং শেষে বলেছেন, 'তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি/চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।' কবি বলেছেন, ইতিহাসের প্রেরণায় তিনি পথ চলেন। তাই তিনি কোনো ভয় করেন না। কবিতায় কবি যেভাবে তরুণ প্রজন্মকে ইতিহাস জানাতে চেয়েছেন, সেরকম ইতিহাস জানাতে চাইলে স্বদেশি ইতিহাসনির্ভর পর্যটনের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ইতিহাস সচেতেন নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে না পারলে তাদের দেশ প্রেমের শিক্ষা শুধু বইপত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে। তা আলোর মুখ দেখবে না। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে ইতিহাস সচেতন করে গড়ে তুলতে হবে।
পর্যটন শব্দের সরল অর্থ এক ধরনের বিনোদন, অবসর অথবা ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে এক স্থান থেকে অন্য স্থান কিংবা এক দেশ থেকে অন্য দেশে ভ্রমণ করা। ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পর্যটন শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এছাড়াও, বিশ্বব্যাপী অবসরকালীন কর্মকান্ডের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
পৃথিবীব্যাপী অর্থনীতির সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে বিবেচনা করা হয় পর্যটন শিল্পকে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও নতুন নতুন স্থান পর্যটনের আওতায় আনা এবং পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করছে সরকার। পর্যটনকেন্দ্র ঘিরে গড়ে ওঠে ব্যবসা-বাণিজ্য। এর ফলে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। পর্যটন শিল্প ঘিরে বহুমুখী সম্ভাবনা রয়েছে। ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও আমরা এখনো সেভাবে এই খাতে অগ্রসর হতে পারিনি।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পর্যটনের জন্য বিশেষ বিশেষ দিককে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এর মধ্যে বিশ্বের সর্বাধিক ভ্রমণকৃত দেশের তালিকার শীর্ষে রয়েছে ফ্রান্স। প্যারিস শহরের আইফেল টাওয়ার, লু্যভর মিউজিয়াম, নরম্যান্ডির দ্বীপ মন্ট সেন্ট মিশেল, ভার্সাই শহরের ভার্সাই প্যালেস স্থানগুলো পর্যটকদের ফ্রান্সে ভ্রমণের জন্য আকৃষ্ট করে। ইতালি তাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস, শৈল্পিক সম্পত্তি, বিশ্বমানের খাবারের ওপর ভিত্তি করে তাদের পর্যটন শিল্পকে সাজিয়েছে। রোমে অবস্থিত ছাদবিহীন অ্যাম্ফিথিয়েটার কলোসিয়াম, পিসার হেলানো টাওয়ার, সেন্ট পিটার্স বাসিলিকা গির্জা, ভেনিসের খাল, সেন্ট মার্কস বাসিলিকা গির্জা, রোমান ক্যাথলিক গির্জা ফ্লোরেন্স ক্যাথেড্রাল, শিল্প জাদুঘর উফিজি গ্যালারি ইত্যাদি ইতালির সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান। থাইল্যান্ড তাদের সুন্দর সমুদ্রসৈকত, সুখী মানুষজন, স্বল্প খরচে জীবনযাত্রা থাইল্যান্ডকে অন্যতম দর্শনীয় দেশ করে তোলে।
পর্যটনকেন্দ্র ও এর আশপাশের পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি এবং নিরাপত্তা এ সবকিছুই একটি দর্শনীয় স্থান পর্যটনকেন্দ্র হতে সাহায্য করে। কোনো স্থাপনা, পাহাড়, বন, সমুদ্রসৈকত, দ্বীপ, ঝরনা ইত্যাদি পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এসব সম্ভাবনাময় স্থান রয়েছে। যেখানে পরিকল্পিত উপায়ে গড়ে তুলতে সক্ষম হলে দক্ষিণ এশিয়ায় পর্যটনে আমরাও এগিয়ে থাকবো। কারণ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ পর্যটনশিল্পে সবচেয়ে পিছিয়ে। জিডিপিতে পর্যটনশিল্পের প্রত্যক্ষ অবদান রাখা ১৭৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪২তম। পর্যটন খাত থেকে বর্তমানে বাংলাদেশের বার্ষিক আয় মাত্র ৭৬.১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যেখানে সার্কভুক্ত অন্যান্য দেশ ভারত, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ও পাকিস্তানের পর্যটন খাত থেকে আয় আমাদের দেশের চেয়ে বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার একটি চমৎকার দেশ হলো বাংলাদেশ। যেখানে পর্যটন শিল্পের রয়েছে প্রচুর সম্ভাবনা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) এক জরিপ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৪১ শতাংশ বা প্রায় সাড়ে ৮ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে পর্যটন খাতে। এ শিল্পের মাধ্যমে দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ বা মূল্য সংযোজন হচ্ছে ১৬ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। বিশেষ করে অন্যান্য দেশের মতো বিশেষ একটি দিক যদি বাংলাদেশ উন্নত করতে পারে তাতেই বাংলাদেশের পর্যটন খাত অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে সন্দেহ নেই। বিশেষ করে ইতিহাসনির্ভর পর্যটনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। পত্রিকার একটি খবরে জানা যায়, সৌদি আরবের পর্যটন ও ন্যাশনাল হেরিটেজ (এসসিটিএইচ) কমিশনের ঘোষণায় জানা যায়, নতুন বছরে পর্যটকদের জন্য স্থাপনা ও জাদুঘর, ঐতিহ্য প্রকল্পে সরকারের খরচ হবে প্রায় ১২শ' কোটি টাকা। বাংলাদেশেরও রয়েছে অসংখ্য ইতিহাস, ঐতিহ্যময়, স্থাপনা ও স্থান। এসব স্থাপনার ইতিহাসনির্ভরতা এবং পর্যটনের গুরুত্ব যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারলেই আগামী দিনে পর্যটকের অভাব হবে না। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আমাদের তরুণ প্রজন্মের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে পাঠে অনীহা থেকে মুক্তি। আমাদের তরুণ প্রজন্ম যতটা না আমাদের দেশকে জানার আগ্রহ প্রকাশ করে তার চেয়ে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে বাইরে দেশ সম্পর্কে জানার ব্যাপারে। দেশকে জানার ব্যাপারে আগ্রহ তৈরিতে ব্যর্থ হচ্ছি আমরা। নিজ দেশের ইতিহাস ঐতিহ্য না জানলে দেশপ্রেম কীভাবে তৈরি হবে তরুণ প্রজন্মের মাঝে?
রাজধানীতে শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে জড়িত থাকায় এটা খুব ভালো করেই জানি যে, ঢাকার অনেক শিক্ষার্থীকে রেসকোর্স ময়দান কিংবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে বেশির ভাগ স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা চিনেন না। আবার অনেকে হয়তো নাম শুনেছেন কিন্ত দেখেননি। এমনিভাবে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য এমনকি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত স্থানগুলোর সঙ্গে তারা পরিচিত নন। বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ঐতিহাসিক স্থানগুলো সম্পর্কে স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জ্ঞান প্রায় শূন্যের কোঠায়। এসব শিক্ষার্থী যখন কলেজ শেষ করে বিদেশে পড়াশুনার জন্য যায়, তখন দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে কিছুই বহির্বিশ্বকে জানাতে পারেন না। অথচ, এ দেশের আছে গর্বের ইতিহাস।
রাজধানী ঢাকাতেই রয়েছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যনির্ভর পর্যটনের সম্ভাবনাময় অনেক স্থান ও স্থাপনা। মহান মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। যেখান থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন 'এবারের সংগ্রাম মুক্তি সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' এছাড়াও রয়েছে আহসান মঞ্জিল, লালবাগ কেলস্না, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, স্বাধীনতা স্তম্ভ, রমনা পার্ক, বাহাদুর শাহ পার্ক, ঢাকা গেট, কার্জন হল, ওসমানী উদ্যান ও বিবি মরিয়ম কামান, তিন নেতার মাজার, মুসা খান মসজিদ, সাত গম্বুজ মসজিদ, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন, গুরুদুয়ারা নানক শাহী, জাতীয় কবির সমাধি, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ, ধানমন্ডি শাহী ঈদগাহ, ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, রোজ গার্ডেন, শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থান, রায়ের বাজার বধ্যভূমি, জিনজিরা প্রাসাদ, পানাম নগর, সোনারগাঁও লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর, কদম রসুল, সোনাকান্দা দুর্গ, উয়ারি-বটেশ্বর, ইদ্রাকপুর দুর্গ, অতীশ দীপাঙ্কর ভিটা, কবি চন্দ্রবতীর মঠ প্রভৃতি।
ঢাকা শহরসহ অন্যান্য শহরের স্কুল ও কলেজের বার্ষিক শিক্ষা সফরে নিয়ে যাওয়া হয় বিভিন্ন পার্ক, রিসোর্ট কিংবা কৃত্রিম কোনো স্থানে। সেখানে শিক্ষার্থীরা হয়তো আনন্দ পান। কিন্তু তারা বঞ্চিত হয় শিক্ষা সফরের আসল উদ্দেশ্য থেকে। এসব স্থানের পরিবর্তে যদি তাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজরিত কোনো স্থানে কিংবা আমাদের ঐতিহ্যের ধারক বাহক কেন স্থানে নিয়ে যাওয়া হতো তাহলে তারা জানতে পারত বাংলাদেশের গৌরবময় সোনালি ইতিহাস ও ঐতিহ্য। বাংলাদেশ সরকার নানা সময়ে স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য পাঠের ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। বিশেষ করে মহান মুক্তিযুদের ইতিহাস শিক্ষা থেকে কোনোভাবেই বঞ্চিত না হয় সেজন্য নেয়া হয়েছে বিশেষ উদ্যোগ।
আমরা মনে করি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য পাঠের সঙ্গে সঙ্গে ওইসব স্থানের পর্যটন এবং শিক্ষার্থীদের ওইসব স্থানে স্কুল ও কলেজের পক্ষ থেকে ভ্রমণের নির্দেশনা থাকলে শিক্ষার্থীরা পাঠের পাশাপাশি দেখার সুযোগও পাবে। ফলে, তাদের মাঝে ইতিহাস সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরি হবে।
জাহিদুল ইসলাম : শিক্ষক, বাংলাদেশে স্টাডিজ অ্যান্ড জিওগ্রাফি বিভাগ, মানারাত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ
মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান : সিনিয়র লেকচারার ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, বাংলাদেশে স্টাডিজ অ্যান্ড জিওগ্রাফি বিভাগ, মানারাত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজ