শুক্রবার, ০২ মে ২০২৫, ১৮ বৈশাখ ১৪৩২

মুমিনের জীবনযাপন

একজন মুমিনের নৈতিক চরিত্র তার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল
  ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
মুমিনের জীবনযাপন

একজন প্রকৃত মুমিনের জীবন ব্যবস্থা কেমন হবে- তার সুসংগঠিত ও পরিপূর্ণ বিধান উলেস্নখ করা আছে কোরআন ও হাদিসে- যা জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রকে সঠিক ও সুনিয়ন্ত্রিতভাবে পথ প্রদর্শন করে। মুমিনের জীবন শুধু ধর্মীয় ইবাদত বন্দেগিতেই সীমাবদ্ধ নয়; পাশাপাশি পারিবারিক, সামাজিক এবং মানবিক প্রতিটি ক্ষেত্রে আলস্নাহর নির্দেশনার ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। একজন প্রকৃত মুমিন তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আলস্নাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সচেষ্ট থাকে এবং এই দুনিয়াকে আখিরাতের সাফল্যের একটি শস্যক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করে। এই আদর্শ জীবনযাপন কেমন হওয়া উচিত, তা কোরআন ও হাদিসের আলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো।

মুমিনের জীবনের ভিত্তি হলো ইমান। ইমান এমন এক দৃঢ় বিশ্বাস- যা তার হৃদয়ে প্রোথিত থাকে এবং তার চিন্তা, কর্ম ও আচরণকে প্রভাবিত করে। ইমানের মূল ভিত্তি হলো তাওহিদ বা আলস্নাহর একত্ববাদে বিশ্বাস। আলস্নাহ তাআলা বলেন, 'আলস্নাহর সঙ্গে কোনো কিছুর শরিক করো না।' (সূরা লুকমান, ৩১:১৩)। তাওহিদ মুমিনের জীবনের কেন্দ্রে থাকে এবং তার প্রতিটি কাজেই এই বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটে। রাসূলুলস্নাহ (সা.) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি আন্তরিকতার সঙ্গে বলে, 'লা ইলাহা ইলস্নালস্নাহ,' সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।' (সহীহ বুখারি, হাদিস : ১২৮)। প্রকৃত মুমিনের ইমান তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে এবং তার জীবনকে আলস্নাহর নির্দেশ অনুসারে পরিচালিত করে। মুমিনের ইমান তত্ত্বকথা নয়; এটি তার কর্মের মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। সে শুধু আলস্নাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করেই ক্ষান্ত হয় না; বরং আলস্নাহর আদেশ নিষেধ পালনে সর্বদা সচেষ্ট থাকে।

মুমিনের অন্যতম প্রধান গুণ হলো ইবাদতে গভীর মনোযোগ ও আন্তরিকতা। ইবাদত বলতে কেবল সালাত, রোজা, হজ ও যাকাত আদায়কেই বোঝায় না; বরং এটি এমন একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা- যার প্রতিটি কাজ আলস্নাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য করা হয়। আলস্নাহ তাআলা বলেন, 'আমি মানুষ এবং জিন জাতিকে কেবল আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।' (সূরা আয-জারিয়াত, ৫১:৫৬)। মুমিনের ইবাদতের প্রতিটি দিক আলস্নাহর প্রতি গভীর আনুগত্য ও প্রেমের প্রতিফলন। সালাত মুমিনের ইবাদতের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। এটি আলস্নাহর প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ এবং আত্মার প্রশান্তির মাধ্যম। আলস্নাহ বলেন, 'সালাত কায়েম করো এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকো।' (সূরা আনকাবুত, ২৯:৪৫)। রাসূলুলস্নাহ (সা.) বলেছেন, 'সালাত ধর্মের স্তম্ভ। যে এটি প্রতিষ্ঠা করল, সে ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করল।' (তিরমিজি, হাদিস: ২৬১৬)। সালাত একজন মুমিনকে শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে এবং তাকে পাপাচার ও অকল্যাণমূলক কার্যকলাপ থেকে দূরে রাখে। রোজা মুমিনের আত্মশুদ্ধির একটি মাধ্যম। এটি শুধু খাদ্য গ্রহণ ও পানীয় পান থেকে বিরত থাকা নয়; বরং চিন্তা ও আচরণেও পবিত্রতা বজায় রাখার একটি কঠিন অনুশীলন। আলস্নাহ বলেন, 'হে ইমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।' (সূরা বাকারা, ২:১৮৩)। রোজা একজন মুমিনকে তার ইচ্ছাশক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে শেখায় এবং আলস্নাহর কাছে আরো নিকটবর্তী করে তোলে। যাকাত মুমিনের দায়িত্বশীলতার প্রতীক। এটি শুধু অর্থনৈতিক ইবাদত নয়; বরং এটি একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা। আলস্নাহ বলেন, 'তোমরা যাকাত দাও এবং সালাতে অটল থাকো।' (সূরা বাকারা, ২:৪৩)। যাকাতের মাধ্যমে মুমিনরা তাদের সম্পদের পবিত্রতা রক্ষা করে এবং দরিদ্রদের প্রতি হক পালন করে। হজ্ব মুমিনের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা উম্মাহর ঐক্য ও আলস্নাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের প্রতীক। এটি একজন মুমিনকে আলস্নাহর ঘরে হাজির হওয়ার সুযোগ দান এবং তাকে আত্মিকভাবে আরও পরিশুদ্ধ করে তোলে।

একজন মুমিনের নৈতিক চরিত্র তার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

\হরাসূলুলস্নাহ (সা.) বলেছেন, 'আমি সুন্দর চরিত্র পরিপূর্ণ করার জন্য প্রেরিত হয়েছি।' (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ৮৯৩)। কোরআন এবং হাদিসে মুমিনের চরিত্রের যে গুণাবলি বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো হলো সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা, ধৈর্য এবং কৃতজ্ঞতা। সত্যবাদিতা একজন মুমিনের আসল পরিচয়। মুমিন কখনো মিথ্যার আশ্রয় নেন না। রাসূলুলস্নাহ (সা.) বলেছেন, 'সত্য বলো, কারণ সত্য সৎকর্মের দিকে পরিচালিত করে, আর সৎকর্ম জান্নাতে নিয়ে যায়।' (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ২৬০৭)। একজন মুমিনের জীবনে সত্যবাদিতা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, এটি তার ইমানের মানদন্ড হিসেবে ধরা হয়। ধৈর্য মুমিনের প্রধান গুণ। জীবনের প্রতিকূল অবস্থায় ধৈর্য ধারণ একজন মুমিনের ইমানকে আরও মজবুত করে। আলস্নাহ বলেন, 'নিশ্চয়ই আলস্নাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।' (সূরা বাকারা, ২:১৫৩)। একইভাবে সুখ-সমৃদ্ধিতে কৃতজ্ঞ হওয়া মুমিনের জীবনের একটি অপরিহার্য দিক। রাসূলুলস্নাহ (সা.) বলেছেন, 'মুমিনের জীবন কত চমৎকার! সুখে কৃতজ্ঞ হয় এবং বিপদে ধৈর্য ধারণ করে।' (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ২৯৯৯)।

মুমিনের জীবনে পরিবার এবং সমাজ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে থাকে। পরিবার হলো ইসলামী সমাজের ভিত্তি। একজন মুমিন তার পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল এবং তাদের সঠিক পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করে। রাসূলুলস্নাহ (সা.) বলেছেন, 'তোমাদের প্রত্যেকে এক একজন রক্ষক, এবং প্রত্যেককে তার অধীনস্থদের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে।' (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৮৯৩)। মুমিন তার পরিবারের প্রতি যত্নশীল। সে তার সন্তানদের ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত করে এবং তাদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে তোলে। পরিবারের সদস্যদের প্রতি ভালোবাসা, সম্মান এবং তাদের অধিকার রক্ষা করা মুমিনের কর্তব্য। মুমিন সমাজের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। সে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আলস্নাহ বলেন, 'তোমরা সৎকর্ম এবং তাকওয়ায় পরস্পরকে সহযোগিতা করো।' (সূরা মায়িদা, ৫:২)। রাসূলুলস্নাহ (সা.) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি মানুষের উপকারে আসে, আলস্নাহ তাকে সাহায্য করেন।' (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৬৯৯)।

মুমিনের জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো আখিরাতে সফলতা অর্জন। এই পৃথিবীকে সে আখিরাতের শস্যক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করে। আলস্নাহ বলেন, 'যারা আখিরাতের জন্য কাজ করে, আলস্নাহ তাদের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন।' (সূরা ইসরা, ১৭:১৯)। মুমিন তার দুনিয়ার জীবনের প্রতিটি কাজ এমনভাবে সম্পন্ন করে- যা আখিরাতে তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে। সে দুনিয়াবি সফলতাকে কখনোই চূড়ান্ত মনে করে না; বরং সবকিছুকে আখিরাতে আলস্নাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম হিসেবে দেখে। রাসূলুলস্নাহ (সা.) বলেছেন, 'এই দুনিয়া হলো আখিরাতের শস্যক্ষেত্র।' (তিরমিজি, হাদিস: ২৩২৩)। প্রকৃত মুমিন তার প্রতিটি কাজের মধ্যে এই উপলব্ধি ধরে রাখে এবং আলস্নাহর আদেশের বাইরে যায় না। মুমিনের জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- দুনিয়া এবং আখিরাতের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা। আলস্নাহ তাআলা বলেন- 'যা কিছু আলস্নাহ তোমাকে দিয়েছেন, তা দিয়ে আখিরাতের বাড়ি অনুসন্ধান করো এবং এই পৃথিবী থেকে তোমার অংশও ভুলে যেও না।' (সূরা কাসাস, ২৮:৭৭)। মুমিন দুনিয়ার জীবনে কঠোর পরিশ্রম করবে, কিন্তু দুনিয়ার সফলতা তাকে আলস্নাহকে স্মরণ করা থেকে দূরে সরিয়ে দেবে না। সে জানে, এই জীবন অস্থায়ী এবং চূড়ান্ত গন্তব্য হলো আখিরাত। তাই সে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখে, যেখানে দুনিয়ার প্রয়োজনে সে তৎপর থাকে এবং আখিরাতের জন্য প্রস্তুতিও অব্যাহত রাখে।

প্রকৃত মুমিনের জীবনব্যবস্থা কোরআন এবং হাদিসের নির্দেশনার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন- যা ইমান, ইবাদত, নৈতিকতা, পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব এবং আখিরাতের প্রস্তুতির সমন্বয়ে গঠিত। মুমিনের জীবন কোনো নির্দিষ্ট দিকে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি এমন এক পূর্ণাঙ্গ জীবনযাপন- যা দুনিয়া এবং আখিরাত উভয় ক্ষেত্রে কল্যাণ নিশ্চিত করবে। কোরআন ও হাদিসের আলোকে জীবন পরিচালনার মাধ্যমে একজন মুমিন তার আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন করতে পারে এবং একই সঙ্গে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। আলস্নাহ তাআলা আমাদের সবাইকে প্রকৃত মুমিনের জীবন ব্যবস্থা পালন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

আবু হেনা মোস্তফা কামাল : চিকিৎসক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে