সোমবার, ১২ মে ২০২৫, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২

শিশুর মেধাবিকাশে সামাজিকীকরণের ভূমিকা

সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে শিশুর মেধাবিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং শিশুর চিন্তাশক্তি, সৃজনশীলতা ও মানসিক দক্ষতার উত্তরণ ঘটে। শিশুর মেধাবিকাশের প্রাথমিক ধাপ হলো ভাষা দক্ষতা। একটি শিশু যখন পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশীসহ চারপাশের মানুষের সঙ্গে মিশে যোগাযোগ স্থাপন করে, তখন ধীরে ধীরে তার ভাষার দক্ষতা অর্জিত হতে থাকে- যা তার চিন্তাভাবনা ও বোধশক্তি বিকাশে সহায়ক।
মাহতাব মুহাম্মদ
  ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
শিশুর মেধাবিকাশে সামাজিকীকরণের ভূমিকা
শিশুর মেধাবিকাশে সামাজিকীকরণের ভূমিকা

সামাজিকীকরণের (ঝড়পরধষরুধঃরড়হ) সংজ্ঞা দিতে গিয়ে করহমংষবু উধারং তার 'ঐঁসধহ ঝড়পরবঃু' বইয়ে লিখেছেন, 'যে পদ্ধতিতে মানবশিশু পূর্ণাঙ্গ সামাজিক মানুষে পরিণত হয়, তাই সামাজিকীকরণ'। তার মানে একটি শিশুর আত্মনির্ভরতা তথা মানসিক বিকাশ ও সামাজিক মূল্যবোধ আত্মীকরণের পদ্ধতিই সামাজিকীকরণ। যদিও এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া যা সারা জীবনব্যাপী চলতে থাকে, তবুও শিশুর মেধাবিকাশে সামাজিকীকরণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

একটি শিশুর সামাজিক মূল্যবোধ গঠন, নীতি-আদর্শ আত্মস্থকরণ, আচার-আচরণ ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ধারণ, দৃষ্টিভঙ্গিগত অবস্থানের পাশাপাশি মেধাবিকাশের অনেকাংশই নির্ভর করে শিশুটি কতখানি সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে গেছে তার ওপর। এটি পৃথিবীর নতুন পরিবেশের সঙ্গে শিশুকে যুক্ত করে মানসিক বিকাশে ইতিবাচক সাড়া ফেলে। মানুষের মেধা শুধু জন্মগত কিংবা ব্যক্তিগত গুণাবলির ওপর নির্ভর করে না, বরং পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, প্রযুক্তি, কর্মক্ষেত্র, সমাজের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক উপাদানসমূহ, বন্ধুবান্ধব, রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থাসহ ধর্মের ওপর নির্ভর করে যা সামাজিকীকরণের বাহন হিসেবে কাজ করে। সামাজিকীকরণে পিছিয়ে পড়া শিশু বিভিন্ন অপরাধকর্মে জড়িয়ে যেতে পারে, ছোটবেলা থেকেই হিংসাত্মক মনোভাব নিয়ে বেড়ে ওঠতে পারে- যার রেশ পরবর্তী পেশাগত জীবনেও থেকে যেতে পারে, যেমন- সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, সহকর্মীদের প্রকাশ্যে গালি-গালাজ করাসহ অসামাজিক আচরণে জড়িয়ে পড়া।

সামাজিকীকরণের মধ্য দিয়ে শিশুর মেধাবিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং শিশুর চিন্তাশক্তি, সৃজনশীলতা ও মানসিক দক্ষতার উত্তরণ ঘটে। শিশুর মেধাবিকাশের প্রাথমিক ধাপ হলো ভাষা দক্ষতা। একটি শিশু যখন পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশীসহ চারপাশের মানুষের সঙ্গে মিশে যোগাযোগ স্থাপন করে, তখন ধীরে ধীরে তার ভাষার দক্ষতা অর্জিত হতে থাকে- যা তার চিন্তাভাবনা ও বোধশক্তি বিকাশে সহায়ক। তাই ভাষাগত অর্জন নিশ্চিতকরণে শিশুদের চার দেওয়ালে বন্দি না রেখে চারপাশের মানুষের সঙ্গে মিশতে দিতে হবে যাতে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় শিশুর মেধাবিকাশ ত্বরান্বিত হয়।

দেখা যায়, যে সব শিশুর চারপাশের মানুষজনের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার অভাব রয়েছে, তাদের মেধাবিকাশ পিছিয়ে পড়ে ও ধীরে ধীরে অসামাজিক মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। তবে অবশ্যই অনিরাপদ মানুষের সান্নিধ্য থেকে শিশুদের দূরে রাখতে হবে। নইলে নেতিবাচক সামাজিকীকরণের সম্ভাবনা রয়ে যাবে। এক্ষেত্রে বাবা, মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একটি শিশুর সামাজিকীকরণের প্রাথমিক ধাপের সূচনাই হয় পরিবার থেকে। এটিকে সামাজিকীকরণের প্রথম বাহন হিসেবে ধরা হয়। তাই পারিবারিক পরিবেশে গলদ থাকলে তা শিশুর সামাজিকীকরণেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

একটি শিশু যখন তার অন্য বন্ধুদের সঙ্গে মেশে বা খেলাধুলা করে ও দলগত কাজ করে তখন তার মধ্যে মনোযোগ, শারীরিক ও মানসিক অঙ্গসংযোগ শক্তি বৃদ্ধি পায়; শিখন ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা সৃষ্টি হয়। সেইসঙ্গে দলগত কাজ করার কারণে তার মধ্যে তৈরি হয় নেতৃত্বগুণ ও পারস্পরিক সহযোগিতামূলক মনোভাব। বন্ধুদের সঙ্গে মেশার কারণে একটি শিশু তার মানসিক চাপ ভাগাভাগি করতে পারে- যা তার মানসিক স্থিরতা ও আবেগগত পরিপক্কতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। একটি শিশু যখন চারপাশের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় জড়ায়, তখন তাকে নতুন নতুন মানুষকে মোকাবিলা করতে হয়। এ সময় তার মধ্যে যোগাযোগ দক্ষতা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ত্বরান্বিত হয়; ভবিষ্যতে নতুন মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে যা কার্যকর ভূমিকা পালন করে। শিশুর ব্যক্তিত্ব গঠন হয় মূলত সামাজিকীকরণের মাধ্যমেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও সহপাঠীদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় তার মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব গড়ে ওঠে। বিশেষত শিক্ষকদের আচরণ, বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্ব শিশুদের ওপর বেশ প্রভাব ফেলে- যা তার নিজের ব্যক্তিত্ব গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। এজন্য শিশুদের মেধা ও ব্যক্তিত্ব বিকাশপর্বে শিক্ষকদের আচরণ হওয়া চাই পরিশীলিত। শিক্ষকরা শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার সময় কেবল পাঠ্যবইভিত্তিক জ্ঞানই দেন না, বরং সামাজিকতা, শিষ্টাচার, নীতি-নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ ও সহানুভূতির মতো গুণাবলির শিক্ষাও প্রদান করেন- যা শিশুকে নৈতিক গুণাবলি সম্পন্ন একজন পূর্ণাঙ্গ সামাজিক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। সামাজিকীকরণের আরেক বাহন সাংস্কৃতিক প্রভাবও শিশুর মেধাবিকাশকে প্রভাবিত করে থাকে।

ভাষা সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর শিশুরা সাধারণত তার সমাজের ভাষাই শেখে যা তাদের চিন্তাভাবনা ও আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কোনো একটি সমাজ, রাষ্ট্র বা ভৌগোলিক অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠার কারণে শিশুরা সামাজিকীকরণের মাধ্যমে ওই জায়গার খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, প্রথা, রীতি-নীতিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে- যা তাদের পরবর্তী বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ডেও বিশেষ স্থান দখল করে থাকে। তাছাড়া, শিশুর সামাজিকীকরণের আরেকটি প্রভাবশালী বাহন হলো ধর্ম। শিশুর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় ধর্ম একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ধর্ম সামাজিকীকরণের মাধ্যমে সত্য-মিথ্যা, ভালো-মন্দ ও নৈতিক-অনৈতিক কাজ নির্ধারণে শিশুর সম্মুখে একটি অবজেক্টিভ মোরাল স্ট্যান্ডার্ড (নৈতিকতার মানদন্ড) দিতে সক্ষম হয়। যার মাধ্যমে একটি শিশু সৎ, আত্মবিশ্বাসী, পরোপকারী, সহানুভূতিশীল ও সহিষ্ণু মনোভাবসম্পন্ন মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে। ধর্ম শিশুর কাছে জীবনকে অর্থবহ করে তোলে যা বস্তুবাদ পারে না। ধর্ম জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কিত প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবনার উদ্রেক সৃষ্টি করার মাধ্যমে শিশুর চিন্তাশীলতাকে উদ্দীপ্ত করে- যা মেধাবিকাশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। আদতে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় দ্বীন-ধর্ম শিশুকে খাঁটি মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। তথ্যপ্রযুক্তির এই আধুনিক বিশ্বে শিশুর মেধাবিকাশে তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকাও উলেস্নখযোগ্য। শিশুরা তথ্যপ্রযুক্তির সংস্পর্শে আসার ফলে প্রযুক্তিগত দক্ষতার উন্নয়ন ঘটে থাকে।

কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, গ্রাফিক ডিজাইন ও অন্যান্য ডিজিটাল দক্ষতা শেখার মাধ্যমে শিশুর সৃজনশীল মেধাবিকাশের দ্বার উন্মোচিত হয়। তবে তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে খারাপ সামাজিকীকরণের (ঘবমধঃরাব ঝড়পরধষরুধঃরড়হ) সম্ভাবনাও থাকে। এজন্য শিশুদের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে অভিভাবকদের সতর্ক থাকা উচিত। তথ্যপ্রযুক্তির পরিমিত ব্যবহারেই শিশুর প্রযুক্তিগত সুষ্ঠু মেধাবিকাশ সম্ভব। সর্বোপরি, সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়- মেধাবিকাশে সামাজিকীকরণ যে গুরুত্ব বহন করে তা অসামান্য।

মাহতাব মুহাম্মদ : কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে