বর্তমান শহরে তো বটেই গ্রামের মানুষের জন্যও পরিবেশ দূষণ একটি বড় ধরনের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার অন্যতম উপাদান হচ্ছে পলিথিন। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কারণে শহর ও গ্রামগুলোতে বিভিন্নভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। ফলে, জনজীবন ক্রমশ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। বেশ কয়েক বছর আগে সাধারণ জনমনে উচ্চস্বরে আলোচিত বিষয় ছিল পরিবেশ দূষণকারী পলিথিন ব্যাগ। সাধারণ মানুষের দাবির মুখে তার ব্যবহার বন্ধও হয়েছিল। এরপরও ওই ঘাতক পলিথিন আজ অনেকটা নীরবে আমার বাসায় প্রতিদিনই আত্মীয়তা গ্রহণ করে।
পরিবেশ দূষণকারী উপাদান বিশেষ করে পস্নাষ্টিক দ্রব্য পচে না বলে এটা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর যে প্রমাণিত হয়েছে তা সর্বজন স্বীকৃত। তাই জনগণের চাপে এবং পরিবেশের গুরুত্ব বিবেচনায় ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন, ব্যবহার, বিপণন ও বাজারজাত করণের ওপর আইন করে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ওই বছরের ১ জানুয়ারি ঢাকা ও ১ মার্চ সারাদেশে পলিথিনের তৈরি ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধিত)-২০০২ অনুযায়ী, এ আইন অমান্য করলে ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা এবং বাজারজাত করলে ৬ মাসের জেল ও ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান করা হয়েছিল। যা সারা দেশের জনগণ সানন্দে গ্রহণ করেছিল। পাশাপাশি এ আইন প্রণীত হওয়ায় পরিবেশের ওপর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। তবে বিগত সরকারের টানা দায়িত্ব পালনের মধ্যে বাজারগুলোতে প্রকাশ্যে পলিথিন ব্যবহার করা হলেও এ আইনের কোনো প্রয়োগ ছিল না। ছিল না কারো মাথাব্যাথা।
বর্তমানে নানা অজুহাতে পলিথিন বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় দিন দুপুরে অনেকের হাতেই এখন বাজারে উপাদান হিসেবে এ ব্যাগ দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন দোকানিরা বাজারের ব্যাগ হিসেবে এটাকে ব্যবহার করে আসছে। এতে সহসায় প্রশ্ন জাগে, এ ব্যাগ উৎপাদন নিষিদ্ধ হলেও তা আবারো আসছে কোথা থেকে? সরকার যদি এর বাজারজাত করা নিষিদ্ধ করে আইন করে থাকে তাহলে তার যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না কেন?
বাংলাদেশ পলিপ্রোপাইল পস্নাস্টিক রোল অ্যান্ড প্যাকেজিং ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ১ হাজারের বেশি পলিথিন ব্যাগ উৎপাদনকারী ছোট বড় অবৈধ কারখানা রয়েছে। হিসাব মতে, প্রতি মাসে ব্যবহার হচ্ছে ৪২ কোটি ব্যাগ পলিথিন। সারাদেশে যা ছড়িয়ে পড়ছে মহামারি আকারে। নিষিদ্ধ পলিথিনে আমাদের পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও আর্থিক-তিন দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। পলিথিন উৎপাদনকারী এবং ব্যবহারকারী উভয়ই স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থাকেন। বিশেষ করে যারা পলিথিন কারখানায় কাজ করে তাদের শরীরে ক্যানসারসহ বিভিন্ন চর্মরোগ এবং জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। পলিথিন দিয়ে মোড়ানো মাছ, মাংস, শাকসবজিসহ অন্য খাদ্যসামগ্রী খুব সহজেই 'অ্যানায়রোবিক' ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয়। যা মানুষের চর্মরোগ ও ক্যানসারের অন্যতম কারণ। বিশেষ করে পলিথিন তৈরিতে যে রং ব্যবহার করা হয় তাও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আর পরিত্যক্ত পলিথিনে জমে থাকা পানিতে জন্ম নেয়া মশা-মাছি ডেঙ্গুজ্বর, ফাইলেরিয়া ও ম্যালেরিয়া ছড়ানোর জন্য অন্যতম ভূমিকা পালন করে আসছে।
বিগত সরকারের দুর্বলতার কারণে পলিথিনের ব্যবহার দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন বাজারে গেলে দেখা যায় খাবার সামগ্রী, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এমনকি কাঁচাবাজার পর্যন্ত পলিথিনের সুদৃশ্য প্যাকেটে বাজারজাত করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি পলিথিনের বিকল্প হিসেবে ব্যাপক হারে পাট, কাপড়, কাগজ ও চটের ব্যাগ উৎপাদন ও সারাদেশে সব জায়গায় সহজ লভ্য করতে হবে। পলিথিন উৎপাদনের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ওপর আমদানি শুল্ক বাড়াতে হবে। শুধু তাই নয়, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসূচিতে পস্নাষ্টিক জিনিসপত্রের ব্যবহার বন্ধ করে দেশীয় মাটি, কাঁচ ও সিরামিকের জিনিসপত্র ব্যবহার ও উপহারসামগ্রী হিসেবে বিতরণের উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। যেহেতু দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে পরিবেশ রক্ষা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সেহেতু যে কোনো উন্নয়নে পদক্ষেপ নেয়ার সময় তা যাতে দীর্ঘস্থায়ী হয় সেই বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। কারণ সাময়িক সুখ লাভের জন্য আমরা আমাদের ভবিষ্যৎকে এক সীমাহীন অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারি না। ব্যক্তিগত লাভ লোকসানের বিষয়টিকে মুখ্য না করে ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে জাতীয় স্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
ছাত্র-জনতার জুলাই গণ-অভু্যত্থানের বিগত সরকারের পতন হওয়ার পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ বিষয়ে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিলেও বাস্তবতার কোনো ছবি প্রতিফলিত হচ্ছে না। বারবার বিষয়টি বিভিন্ন মহলে উত্থাপন হলেও কোনো কার্যকর প্রদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। সর্বশেষ চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি সচিবালয়ের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে পলিথিন শপিং ব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার নিয়ে পুলিশ,র্ যাব, সশস্ত্র বাহিনীসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনী প্রতিনিধিদের একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে পলিথিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার বন্ধে অভিযান জোরদার করা হবে জানানো হয়। পরিবেশ রক্ষায় জাতীয় স্বার্থে ঘাতক পলিথিনের অবাধ ব্যবহার বন্ধে সরকারসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষ করে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।
নাজমুল করিম ফারুক : সাংবাদিক