গ্রামীণ মানুষের জীবন সরলতা মিশ্রিত। এই সরল মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির থাকে অটুট বন্ধন। তাদের হৃদয় ও প্রকৃতির স্নিগ্ধতা যেন একে অপরের পরিপূরক। কৃষকদের ধান কাটতে কাটতে বা মাঝিদের আঁকাবাকা নদীতে নৌকা বাইতে বাইতে সারি গান গাওয়া ও পাখির কলকাকলি যেন তারই প্রতিচ্ছবি। গ্রামের রাস্তায় ও মাঠের জমির আইলের ঘাসে জমে থাকা শিশির যেন মুক্তদানার মতোই সৌন্দর্যের প্রতীক। মেঠোপথে হাঁটতে হাঁটতে যেমন চোখে পড়ে শত-শত প্রজাতির রঙবেরঙের পাখি, তেমনি চোখ শীতল হয়ে যায় দিগন্তের সঙ্গে নীল আকাশের নরম ছোঁয়ার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য।
গ্রীষ্মকালে ফলের সুগন্ধে গ্রামের শিশুদের মাঝে অদ্ভুত চঞ্চলতা দেখা যায়। টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দের মাধুর্যতা কোনো সুরেলা গানের চেয়ে কম নয়। শরতে কানায় কানায় পূর্ণ নদী ও দীঘিতে শাপলা ফুল ফোটে- যা বাংলার প্রকৃতির রূপের ঐতিহ্য বহন করে। অগ্রহায়ণে মাঝেমধ্যেই চোখে পড়ে ধীরে চলা গরুর গাড়িতে কৃষক ধান নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। কৃষকের ঘরে ফসল উঠানোর সময় তাদের চোখেমুখে যে খুশি দেখা যায় তা কোটি টাকার চেয়েও মূল্যবান। শীতের শেষভাগে ও বসন্তের শুরুতে শত-সহস্র ফুলের মেলায় প্রকৃতি অপরূপ সাজে নিজেকে সাজায়। এখনো গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে গৃহপালিত পশুপাখির দেখা মেলে। কৃষকরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে মাঠে খেজুর গাছের রস পাড়তে যায়। অতঃপর গৃহিণীরা সেই রস ও রসের গুড়ের হরেক রকমের পিঠা বানান; শীতকালে গ্রামীণ গৃহস্থের বাড়িতে এভাবেই চলে পিঠা উৎসব। গ্রামীণ মাঠে যতদূর চোখ যায় শুধুই সোনার ফসল দেখা যায়। গ্রামের মানুষ যেমন কঠোর পরিশ্রমী তেমনি নরম মনের অধিকারী। তারা একজনের দুঃখে অন্যজন পাশে থাকে। যেন সম্পূর্ণ গ্রামই একটা পরিবার। গ্রামের গৃহিণীদের হাতে যেন জাদু আছে; তারা নানারকম হস্তশিল্প ও বুননশিল্প থেকে শুরু করে সব ধরনের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন ও আধুনিক খাবার তথা পিঠা বানাতে পটু। গ্রামে সন্ধ্যা হলেই কৃষক জেলে কামার কুমোর একত্রে টং দোকানে গালগল্প করে; বাংলার পুরাতন সিনেমা দেখে ও চা খায়, তাদের দেখে মনে হয় তারাই দুনিয়ায় সবচেয়ে সুখী ও দুশ্চিন্তামুক্ত প্রাণবন্ত মানুষ। মাঝে মাঝেই রাত পর্যন্ত গ্রামের পুরুষরা জারিগান, পালাগান, ভাটিয়ালি, গম্ভীরা, বাউলগানসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী গান করে। আগেকার দিনে গ্রামের মানুষ নিয়ম ও রীতিনীতি মানার ক্ষেত্রে রক্ষণশীল হলেও বর্তমানে পরিবর্তনশীল সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেকটা উদার মনোভাবাপন্ন হয়েছে। বর্তমানে গ্রাম আধুনিকতার সংস্পর্শে এসেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, যথাযথ পরিকল্পনা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অভাবে গ্রামীণ পরিবেশের ভারসাম্য দিন দিন নষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে, এখানে প্রচুর পরিমাণে ইটের ভাটাও গড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। ফলে, গ্রামীণ ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশসহ প্রাণিকূল আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। কাজেই কর্তৃপক্ষের নিকট বিনীত নিবেদন, উন্নয়ন ও আধুনিকতার নামে যেন পলস্নীর চিরচেনা রূপ কোনোভাবে বিলীন না হয়ে যায়, সে দিকে নজরদারি বৃদ্ধির করুন।
সোহাগ হোসেন
শিক্ষার্থী, আইন ও ভূমি প্রশাসন বিভাগ
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়