বুধবার, ০৭ মে ২০২৫, ২৪ বৈশাখ ১৪৩২

দেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব

বেকারত্ব সমস্যা সমাধানে কারিগরি শিক্ষা হতে পারে কার্যকর মাধ্যম। সাধারণ শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পরও অনেকেই চাকরি পান না। অথচ কারিগরি দক্ষতা থাকলে তারা বিভিন্ন পেশায় সহজেই কাজের সুযোগ পেতে পারেন। এছাড়া, কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি সম্ভব।
মো. সাইদুর রহমান
  ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
দেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব
দেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব

২৬ লাখ ৬০ হাজার বেকার জনগোষ্ঠীর মুক্তির উপায় কী? এই সংখ্যা কি দিন দিন এমন চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পেতেই থাকবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে বারবার শিক্ষা ব্যবস্থার কথা চলে আসে। গতানুগতিক শিক্ষাই কি বেকারত্বের মূল কারণ! বিশ্ব এখন এমন এক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য কেবল ডিগ্রির মাধ্যমে সনদ অর্জন নয়, বরং বাস্তব জীবনের চাহিদা মেটাতে দক্ষতা অর্জন। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষার প্রচলিত ধারা অনেকটা ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বাস্তবমুখী পরিবর্তন আনতে হবে। আর এই পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হতে পারে কারিগরি শিক্ষা। কারিগরি শিক্ষা এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা- যা শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে কাজ শেখানোর মাধ্যমে ব্যবহারিক দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জনের সুযোগ করে দেয়।

বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব এখন সময়ের দাবি। অথচ পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মাত্র ১৭ থেকে ১৮ শতাংশ শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষায় যুক্ত। এছাড়া বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশেরও কম মানুষ এ ধরনের শিক্ষায় দক্ষ। এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীনের দিকে তাকালেই বোঝা যায় কারিগরি শিক্ষার প্রভাব। তারা এক সময় ১২ বছর ধরে সাধারণ শিক্ষা বন্ধ রেখে প্রতিটি নাগরিককে আধুনিক কারিগরি প্রশিক্ষণ ও কর্মমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছিল। এর ফলস্বরূপ আজ চীন বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

চীনা পণ্য এখন বিশ্ববাজারে দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করছে- যা তাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সঠিক দিক-নির্দেশনার ফল। সত্তরের দশকে বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতি ছিল, যখন মালয়েশিয়ার শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তি শিক্ষার জন্য ঢাকার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ভর্তি হতেন। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আজ আমাদেরই মালয়েশিয়ায় গিয়ে তাদের উন্নত প্রযুক্তি শেখার প্রয়োজন হচ্ছে। এর মূল কারণ হলো, আমরা কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্বের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করিনি। দেশের এই বিশাল বেকারত্ব স্পষ্ট করে যে, সাধারণ শিক্ষার আধিক্য ও কারিগরি শিক্ষার ঘাটতি আমাদের অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সুতরাং, বাংলাদেশকে শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে। কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষা শুধু বেকারত্ব দূর করতে নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্যও অপরিহার্য। এখন সময় এসেছে এই পরিবর্তনের পথে এগিয়ে যাওয়ার।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়, তারা কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দিয়েই দ্রম্নত উন্নয়ন অর্জন করেছে। জার্মানি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর এবং ফিনল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তোলার জন্য কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ কারণেই তারা বিশ্ব প্রতিযোগিতায় এগিয়ে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই শিক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব আরও বেশি। যেখানে আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীকে একটি সমস্যা হিসেবে দেখা হয়, সেখানে কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী মানবসম্পদে পরিণত করে দেশের জন্য আশীর্বাদ বয়ে আনা যায়। উদাহরণস্বরূপ, গার্মেন্টস শিল্প, আইটি খাত, নির্মাণ খাত এবং ইলেকট্রনিক্স শিল্পে দক্ষ কর্মীর চাহিদা রয়েছে- যা কারিগরি শিক্ষা দিয়ে সহজেই পূরণ করা যায়।

বেকারত্ব সমস্যা সমাধানে কারিগরি শিক্ষা হতে পারে কার্যকর মাধ্যম। সাধারণ শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের পরও অনেকেই চাকরি পান না। অথচ কারিগরি দক্ষতা থাকলে তারা বিভিন্ন পেশায় সহজেই কাজের সুযোগ পেতে পারেন। এছাড়া, কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি সম্ভব। তরুণ প্রজন্মকে কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ করে গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করা সম্ভব। শুধু চাকরি নয়, এ শিক্ষা উদ্যোক্তা তৈরি করে- যা স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।

একটি জাতির উন্নতি নির্ভর করে তার শ্রমশক্তির দক্ষতার ওপর। কারিগরি শিক্ষা সেই দক্ষতা গড়ে তুলতে সহায়তা করে। এটি শুধু ব্যক্তিগত ও পারিবারিক উন্নয়নেই সীমাবদ্ধ নয় বরং দেশের সার্বিক উন্নয়নেও অবদান রাখে। তাই, এখনই সময় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানোর। এটি কেবল একটি চাহিদার বিষয় নয় বরং দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। পরিকল্পিত কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে আমরা আমাদের বিশাল জনসংখ্যাকে সম্পদে রূপান্তর করতে পারি। সঠিক দিকনির্দেশনার মাধ্যমে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে জাতীয় উন্নয়নের অগ্রদূত হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। দেশের অগ্রগতির চাবিকাঠি কারিগরি শিক্ষা। এটি বাস্তবায়নে সর্বস্তরের সমন্বিত উদ্যোগ এবং পরিকল্পিত বিনিয়োগ প্রয়োজন। এ উদ্যোগই বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে একটি দক্ষ ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্বে পরিচিত করতে সক্ষম হবে।

মো. সাইদুর রহমান : শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে