চলতি বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি কমবে। এর কারণ, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং বিনিয়োগ ও শিল্প খাতে ভাটার টান। বিপরীতে মূল্যস্ফীতি থাকবে চড়া। সরকারের মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্য পূরণ হবে না। বিশ্বব্যাংক 'ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক প্রসপেক্টস' (বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা) শীর্ষক প্রতিবেদনের জানুয়ারি, ২০২৫ সংস্করণে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর নিয়ে এসব পূর্বাভাস তুলে ধরা হয়েছে। তারা বলছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ১ শতাংশে নামতে পারে, যা গত জুনের পূর্বাভাসের চেয়ে ১ দশমিক ৬ শতাংশীয় বিন্দু কম। একটি দেশের ভেতরে যত পণ্য ও সেবা উৎপাদিত হয়, তা-ই জিডিপি। আগের বছরের চেয়ে জিডিপি বৃদ্ধির হারকে বলা হয় প্রবৃদ্ধি। জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার মানে হলো, অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে যাওয়া। এতে আগের চেয়ে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার কমে যায়। বেকার বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য দ্রম্নতগতিতে না বাড়লে, কারখানায় উৎপাদন না বাড়লে মানুষের আয় বৃদ্ধির সুযোগ কমে যায়। দেশে তিন বছর ধরে মানুষের প্রকৃত আয় কমছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে মানুষের আয় বেড়েছে ৮ শতাংশের কিছু বেশি। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি বেড়েছে প্রায় ১১ শতাংশ। বাংলাদেশে সাধারণত ৬ শতাংশের বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে হয়েছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা কমে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশে নামে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে প্রকাশিত শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, ক্ষমতাচু্যত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জিডিপি বাড়িয়ে দেখানো হতো। বিশ্বব্যাংক যেমন জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কথা বলেছে, তেমনি ২০২৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির পাঁচটি ঝুঁকির কথা বলেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডবিস্নউইএফ)। ১৫ জানুয়ারি প্রকাশিত তাদের বৈশ্বিক ঝুঁকি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তুলে ধরা ঝুঁঁকিগুলো হলো উচ্চ মূল্যস্ফীতি, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া (বন্যা, তাপপ্রবাহ), দূষণ (বায়ু, পানি, মাটি), বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক সুযোগের অভাব এবং অর্থনৈতিক নিম্নমুখিতা (মন্দা, স্থবিরতা)। এই ঝুঁকি তারা চিহ্নিত করেছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের ওপর জরিপ করে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ অংশে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের গতি কমিয়েছে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমেছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশে নামতে পারে, যা আগের পূর্বাভাসের চেয়ে শূন্য দশমিক ৬ শতাংশীয় বিন্দু কম। জ্বালানি সংকট ও আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন শিল্পে উৎপাদন কর্মকান্ডে প্রভাব ফেলেছে। ফলে পণ্যের দাম বেড়েছে। এটা আবার মানুষের প্রকৃত আয় কমিয়ে দিয়েছে। পাকিস্তান ও শ্রীলংকায় জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে গিয়েছিল। তবে দেশ দু'টি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে আড়াই শতাংশ। নেপালও ভালো করবে। ভারতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে (এপ্রিল-মার্চ) জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতে পারে সাড়ে ৬ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশ ছিল। প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে বিনিয়োগে মন্থরতা ও উৎপাদনশীল খাতে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায়। বাংলাদেশে চলতি বছর জিপিডির প্রবৃদ্ধি কমলেও আগামী অর্থবছরে (২০২৫-২৬) তা বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, আগামী অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হতে পারে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পরিস্থিতির আরও উন্নতির আশা আছে। সঙ্গে আর্থিক খাতে সংস্কার হতে পারে, ব্যবসার পরিবেশে উন্নতি হতে পারে এবং বাণিজ্য বাড়বে। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি কমবে, বিনিয়োগ বাড়বে। বিশ্বব্যাংক যেমন জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কথা বলেছে, তেমনি ২০২৫ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির পাঁচটি ঝুঁকির কথা বলেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডবিস্নউইএফ)। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস বলছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ভারতে ৬ দশমিক ৭, পাকিস্তানে ২ দশমিক ৮, শ্রীলংকায় (২০২৫) ৩ দশমিক ৫ এবং নেপালে ৫ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি করোনাকাল থেকেই মন্থর হয়ে গিয়েছিল। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরেকটু মন্থর করেছে। তবে আগামী দিনগুলোতে অর্থনীতি ভালো করবে। কারণ, সংস্কারের নানা উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে। স্থিতিশীলতা আসছে। এখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি দরকার, জ্বালানি ও বিদু্যতের দাম স্থিতিশীল রাখতে হবে এবং ব্যাংকঋণের সুদের হারে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। জাতীয় নির্বাচন ব্যবসা ও বিনিয়োগে আস্থা আরও বাড়াবে। সরকারের উচিত বেসরকারি খাতের সঙ্গে আরও আলোচনা করা। এর পাশাপাশি ব্যবসা-অর্থনৈতিক খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো এখন করে ফেলা। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় মূল্যস্ফীতি চূড়ায় উঠেছিল ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে। এর পর থেকে তা ধাপে ধাপে কমছে। ভারতে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে মূল্যস্ফীতি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রয়েছে (শুধু গত অক্টোবর ছাড়া)। নেপাল ও শ্রীলংকা মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে নামিয়ে আনতে পেরেছে। পাকিস্তানে গত আগস্টে মূল্যস্ফীতি ২০২১ সালের পর প্রথমবারের মতো এক অঙ্কে নেমে আসে। বিপরীতে বাংলাদেশেই মূল্যস্ফীতি এখনো চড়া। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ভারতে খাদ্যের দাম কমায় ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি নেমেছে ৫ দশমিক ২২ শতাংশে। শ্রীলংকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া প্রতিবেদন বলছে, ডিসেম্বরে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি হয়নি, বরং মূল্য সংকোচন হয়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যদিকে পাকিস্তানে ডিসেস্বরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ১ শতাংশ। বিবিএসের হিসাবে, বাংলাদেশে ডিসেম্বর শেষে দেশে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। অর্থাৎ হারটি এক অঙ্কে নামেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গত বছর ১৪ আগস্ট আশা প্রকাশ করেছিলেন, পাঁচ থেকে ছয় মাসে মূল্যস্ফীতি সহনীয় হবে। প্রতিবেশী দেশগুলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে তার সুফল পেয়েছে। বাংলাদেশ যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। নতুন সরকারকেও খুব ভিন্ন কিছু করতে দেখা যাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রা ও রাজস্ব নীতি এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত পদক্ষেপ দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাড়াচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমাতে। অন্যদিকে সরকার কর বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। এক মন্ত্রণালয় ডিম আমদানির অনুমতি দিচ্ছে, আরেক মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা তা আটকে দিচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমবে, সে আশা করা যায় না। কারণ, বাজারে চালের দাম বাড়ছে। সবজির দাম কমেছে। তবে তা স্থায়ী না-ও হতে পারে। বাংলাদেশ নিম্নমুখী জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির মতো দু'টি ক্ষতিকর দিকের মধ্যে পড়ে গেছে। একদিকে মানুষের কর্মসংস্থান ও আয়ের সুযোগ কম, অন্যদিকে ব্যয় বাড়ছেই।
উত্তরাধিকার সূত্রেই একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি পেয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। এই অর্থনীতি রাতারাতি ঠিক করা সহজ নয়। তবে অর্থনীতিকে সঠিক পথে নিতে সরকার কী করছে, সেই চিত্র জানাটা জরুরি। রাজস্ব আয় বাড়ানোর সহজ পথ আছে, কঠিন পথও আছে। সহজ পথ হলো আমদানি শুল্ক বা মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানো। আর কঠিন পথ আয়কর আদায়। সহজ পথেই গেছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। তবে প্রশ্ন হলো, অর্থবছরের মাঝপথে এসে শতাধিক পণ্যে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়াতে হলো কেন, সরকার সহজ পথেই-বা কেন গেল, বিকল্প কিছু ছিল কি না? আইএমএফের ঋণ ও ঋণের শর্ত উত্তরাধিকার হিসেবেই পেয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। পাশাপাশি সরকার আইএমএফের কাছ থেকে আরও ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যদি ভালো না হয়, মূল্যস্ফীতির চাপ না কমে, কর্মসংস্থান ও আয় না বাড়ে, তাহলে সংস্কার নিয়েও মানুষের আগ্রহ থাকবে না। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় সংকট শুরু হয়েছিল ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে ডলারের দাম, বৃদ্ধি পায় মূল্যস্ফীতির চাপ। এ রকম এক পরিস্থিতিতে ২০২২ সালের ৫ আগস্ট এক লাফে জ্বালানি তেলের দাম ৫১ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ায় সরকার। সেটাই ছিল উচ্চ মূল্যস্ফীতি ডেকে আনার প্রথম সরকারি পদক্ষেপ। সেই যে মূল্যস্ফীতির চাপ শুরু, তা এখনো রয়ে গেছে। সর্বশেষ সরকার এক অধ্যাদেশ জারি করে শতাধিক পণ্যের মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ওপরের ঘটনাগুলোর মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে? সেটাই দেখা যাক। ১৯৭৪ সালে তাজউদ্দীন আহমদের পদত্যাগের পর আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন ড. আজিজুর রহমান মলিস্নক। তার নেওয়া দুটো সিদ্ধান্তই ছিল মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তপূরণ। বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে প্রথম ঋণ পায় ১৯৭৪ সালের ১৪ জুন, দ্বিতীয় ঋণ ১৯৭৫ সালের ২৮ জুলাই। ১৯৭৫ সালে বিশ্বব্যাংক তাদের রিপোর্টে বলেছিল, 'অবমূল্যায়নের মাধ্যমে আইএমএফের যে কর্মসূচি শুরু হয়েছিল, নতুন সরকার তা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করেছে। সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকারগুলো হচ্ছে, ভর্তুকি কমানো, কৃষি খাতে কর আরোপ এবং আমদানি উদারীকরণ।' পরে দেখা গেছে, এসব শর্তপূরণও অব্যাহত ছিল।
২০০৫ সালে গণহারে আমদানি শুল্ক কমানোর পেছনে ছিল বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন সহায়তা ঋণের (ডিএসসি) ৩০ কোটি ডলার পাওয়ার শর্তপূরণ। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১০ সালেই আইএমএফ থেকে ঋণ পাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেই ঋণ পাওয়া যায় ২০১২ সালের ১১ এপ্রিল। বর্ধিত ঋণসুবিধা (ইসিএফ) নামের সেই ঋণের শর্তপূরণের অংশ হিসেবেই কিছুদিন পর পর জ্বালানি তেল, পানি ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। এমনকি ২০১৩ সালে বিশ্ববাজারে যে জ্বালানি তেলের দাম ছিল প্রতি ব্যারেল ১১০ ডলার, দুই বছরের মধ্যেই তা নেমে এসেছিল মাত্র ২৭ ডলারে। কিন্তু সরকার তেলের দাম কমায়নি। সাধারণ মানুষকে ভোটার হিসেবে গণ্য করেনি বলেই তাদের স্বস্তি দেওয়ার বিষয়ে তখন সরকারের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে ১২ বার ঋণ নিয়ে অসংখ্য শর্ত পূরণ করলেও কোনো অর্থমন্ত্রী বা সরকার কখনোই তা স্বীকার করেনি। এমনকি কোনো বাজেট বক্তৃতাতেও এর কোনো উলেস্নখ নেই।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়ে চিঠি দিয়েছিলেন ২০২২ সালের ২৪ জুলাই। আর এক লাফে ৫১ শতাংশ পর্যন্ত জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছিল পরের মাসেই, ৫ আগস্ট। পরপরই ৫ শতাংশ বাড়ানো হয় পানির দাম। আইএমএফ ঋণ কর্মসূচির নীতিগত অনুমোদন দেয় একই বছরের নভেম্বরে আর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয় পরের বছরের ৩০ জুন। এ ঋণেরই অন্যতম শর্ত ছিল নতুন ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আইন পাস ও কার্যকর করা। শর্তপূরণের অংশ হিসেবে ২০১২ সালের ২৭ নভেম্বর নতুন ভ্যাট আইন জাতীয় সংসদে পাস হলেও ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার আইনটি কার্যকর করা পিছিয়ে দেয়। এতে আইএমএফ ঋণের অর্থ আটকে দিলে সরকার জানিয়ে দেয় যে, আইনটি কার্যকর করা হবে ২০১৫ সালের ১ জুলাই থেকে, ২০১৪ সালের ভোটের পর। এই প্রতিশ্রম্নতি দেওয়ার পরই আইএমএফ ঋণের শেষ দুই কিস্তি একসঙ্গে ছাড় করেছিল। সেই আইন কার্যকর হয় ২০১৯ সালে। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদের নির্বাচনের পরে, অর্থাৎ ভোটের পরেই ভ্যাট আইন। নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করা হলেও সব মহলকে খুশি করতে মূল আইনের অনেক কিছুই বাদ দেওয়া হয়। মূল আইনে ভ্যাটের একক হার ছিল ১৫ শতাংশ, নতুন আইনে তা ভেঙে আটটি করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সে সময় নতুন আইনকে 'নতুন বোতলে পুরোনো মদ' বলেছিলেন। সেই ভ্যাট আইন দেশের রাজস্ব আয় বাড়াতে তেমন কোনো ভূমিকাও রাখেনি।
আইএমএফের ঋণ পেতে সেই ভ্যাট আইনকেই এক দফা সংশোধন করল বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকার। ৯ জানুয়ারি শতাধিক পণ্যের ওপর শুল্ক-কর বাড়ানো হয়েছে। এ সময় অনেকগুলো পণ্য ও সেবা খাতে একক ভ্যাট হার ও মূল্য আইন অনুযায়ী আবার ফিরিয়ে আনা হয়। এটা ঠিক যে, আইএমএফের ঋণ ও ঋণের শর্ত উত্তরাধিকার হিসেবেই পেয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। পাশাপাশি সরকার আইএমএফের কাছ থেকে আরও ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে। এ জন্য আইএমএফের এক প্রতিনিধি দল গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশে এসে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) দশমিক ৬ শতাংশ হারে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর শর্ত দেয়। সেই শর্তপূরণের অংশ হিসেবেই বাড়ানো হয়েছে শতাধিক পণ্যের শুল্ক-কর। যদিও সরকার এখন পর্যন্ত আইএমএফের শর্তের কথা স্বীকার করেনি। এমনকি এর ফলে বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়বে না, এমন কথাও নীতিনির্ধারকেরা বলছেন।
৫৪ বছর ধরেই কর-জিডিপি অনুপাতের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বনিম্ন দেশগুলোর একটি। সুতরাং রাজস্ব আয় বাড়াতেই হবে। একটা সময় ছিল, যখন আমদানি শুল্ক ছিল রাজস্ব আয়ের বড় উৎস। এখন সেই স্থান দখল করেছে ভ্যাট। ভ্যাট পরোক্ষ কর, এর দায় চাপে ভোক্তার ওপর। আর রাজস্ব বাড়ানোর জন্য আদর্শ পথ হচ্ছে প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর। বাংলাদেশের সমস্যা এখানেই। ক্ষমতাশালী ও বিত্তবানদের কাছ থেকে আয়কর আদায় করতে পারে না বলেই পরোক্ষ কর আদায়ের সহজ পথ বেছে নেয় সরকার। একই পথ অবলম্বন করল অন্তর্র্বর্তী সরকারও। রাজস্ব খাতসংক্রান্ত পরামর্শক কমিটি সরকারকে একটি বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছেন। আমাদের একটি সংস্কারের ধারায় যেতে হবে। এমন কোনো প্রস্তাব করা হবে না, যা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এটা ঠিক, বৈপস্নবিক কিছু করা যাবে না। আমাদের সমাজে সেই অবস্থা নেই। তবে তারা সবার সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কারের প্রস্তাবগুলো তৈরি করেছেন। সবার মধ্যে সংস্কার নিয়ে এক ধরনের চেতনা তৈরি হোক- আমরা এটাই চাই।
আগেই বলেছি, উত্তরাধিকারসূত্রেই একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি পেয়েছে সরকার। এই অর্থনীতি রাতারাতি ঠিক করা সহজ কাজ নয়। তবে অর্থনীতিকে সঠিক পথে নিতে সরকার কী করছে, সেই চিত্র জানাটা জরুরি। জানা প্রয়োজন সরকারের অগ্রাধিকারগুলো কী কী। এটা ঠিক যে গত পাঁচ মাসে সরকার অর্থনীতির ক্ষেত্রে অনেকগুলো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের ওপর যদি সাধারণ মানুষ ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা না থাকে, তাহলে কখনোই মূল্যস্ফীতি কমবে না, বিনিয়োগও বাড়বে না। এটা পরিষ্কার যে একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, অন্যদিকে ভ্যাট বাড়ানো- এ পথে অন্তত মানুষের আস্থা ফিরবে না। অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয় গত ৮ আগস্ট, চলতি অর্থবছর শুরুর মাত্র এক মাস ৭ দিন পর। সুতরাং চলতি অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের সময় প্রায় পুরোটাই পাচ্ছে সরকার। তবে যে অর্থনীতি সরকার পেয়েছে, তাতে এই বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন কাজ। সুতরাং অনেকেরই প্রত্যাশা ছিল, অর্থ মন্ত্রণালয় অন্তত ডিসেম্বর শেষে দেশের অর্থনীতির, বাজেট বাস্তবায়ন পরিস্থিতির একটি পর্যালোচনা করে তা জনগণকে জানাবে। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যও অর্থনীতির মধ্যমেয়াদি পর্যালোচনার সুপারিশ করেছেন। তাতে অন্তত জানা গেছে, অর্থনীতির বর্তমান চিত্রটা কেমন, কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এর প্রভাব কতটা পড়ছে এবং অর্থবছরের বাকি সময়ে কী করতে হবে। সাবেক স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল অর্থনীতির চরম অব্যবস্থাপনা এবং খেয়ালখুশিমতো অর্থনীতি পরিচালনা করা। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা বা পরামর্শের কোনো কাঠামোই ছিল না।
আশা করা হয়েছিল, অর্থনীতি নিয়ে বর্তমান সরকার অন্তত বিশেষজ্ঞ ও বিনিয়োগকারীদের নিয়ে একটি পরামর্শ গ্রম্নপ গঠন করবেন। যারা আগের সরকারের সময় এসব বিষয় নিয়ে সমালোচনা করতেন, তারাই তো এখন দায়িত্বে। সুতরাং রাজস্ব বাড়াতে ভ্যাট বাড়ানো সঠিক পথ নাকি অন্য কোনো উপায় আছে, মহার্ঘ ভাতার অর্থ কোথা থেকে আসবে। আইএমএফের সঙ্গে দর-কষাকষি করে ভ্যাট বাড়ানো ছয় মাস পিছিয়ে দেওয়া যায় কি না, সুদহার নীতি কেমন হওয়া উচিত, যারা কর্মসংস্থান হারাচ্ছেন, তাদের পুনর্বাসন কী হবে- এসব বিষয় আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হলেই বরং সরকারের কাজের স্বচ্ছতা বাড়ত। মানুষও জানতে পারত সরকারের লক্ষ্য কী। সবাই জানি স্বচ্ছতার সঙ্গেই আস্থার একটি গভীর সম্পর্ক আছে। নির্বাচনের রূপরেখা বা সংস্কারের রূপরেখা নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতির একটি রূপরেখা জানা জরুরি। অন্তত আগামী জুন পর্যন্ত সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কী, সেটা জানা দরকার। কেননা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যদি ভালো না হয়, মূল্যস্ফীতির চাপ না কমে, কর্মসংস্থান ও আয় না বাড়ে, তাহলে সংস্কার নিয়েও মানুষের আগ্রহ থাকবে না।
রেজাউল করিম খোকন : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক