আজ তোমাদের জন্য রচনা নিয়ে আলোচনা করা হলো
রূপসী বাংলা/ বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য/
আমাদের চারপাশের প্রকৃতি
পলিস্নপ্রকৃতি : গ্রামের দেশ বাংলাদেশ। এখানে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। প্রকৃতির অপরূপ রূপ-বৈচিত্র্য গ্রামবাংলাকে ঋদ্ধ করেছে। গ্রামের সৌন্দর্য অকৃত্রিম। যতদূর দৃষ্টি যায় সবুজ মাঠ আর সোনালি শস্যের সমারোহ। মেঠো পথ বেয়ে গাছপালায় ঘেরা ছোট ছোট ঘরগুলো যেন এক একটি শান্তির নীড়। পুকুর, নালা বা বিলের কাকচক্ষু জলে ফুটে থাকা শাপলা কিংবা পদ্মের সৌন্দর্য মানুষকে মুগ্ধ করে। ক্লান্ত রাখালের অপূর্ব বাঁশির সুর দশদিক আলোড়িত করে।
চিরন্তন গ্রামবাংলার এ নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে মুগ্ধ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গেয়ে উঠেছেন-
'অবারিত মাঠ, গগন ললাট, চুমে তব পদধূলি
ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড়, ছোট ছোট গ্রামগুলি।'
বন-বনানী : আমাদের চারপাশে সবুজের সমারোহ। যেদিকে তাকাই, সেদিকেই ঘন সবুজ। আম, জাম, কাঁঠাল, তাল, নারিকেল, বট, শাল, সেগুন, মেহগনি, কড়ইসহ আরও কত গাছ। এসব গাছ-গাছালি মিলে চারপাশে একটা বনের মতো সৃষ্টি হয়েছে। পলিস্নকবি জসীমউদ্দীনের ভাষায়:
'বনের পরে বন চলেছে বনের নাহি শেষ,
ফুলের ফলের সুবাস ভরা এ কোন পরীর দেশ।'
সংস্কৃতি : বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির রূপমাধুর্যে যেন একটি স্বতন্ত্র মাত্রা যোগ করেছে। বাংলা বর্ষবরণ বা বসন্ত বরণের মতো অনুষ্ঠানগুলো আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। এগুলো রং, রূপ ও বৈচিত্র্যে সমকালীন প্রকৃতির অনুরূপ। ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশে এগুলো ভিন্ন ও রোমাঞ্চকর আমেজ সৃষ্টি করে। আনুষ্ঠানিকতা, গুরুত্ব ও রূপমাধুর্যের বিচারে এগুলোকে ব্রাজিলের রিও ডি কার্নিভাল বা হংকংয়ের ড্রাগন বোট ফ্যাস্টিভালের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এছাড়া দেশের পাহাড়িয়া অঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের অনেক স্থানে বসবাসকারী বিভিন্ন উপজাতীয় গোষ্ঠীর নিজস্ব বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি এদেশের রূপমাধুর্যকে সমৃদ্ধতর করেছে।
ঋতু-বৈচিত্র্য : পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে চারটি ঋতু পরিলক্ষিত হয়। এগুলো গ্রীষ্ম, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত।
কিন্তু বাংলাদেশে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঋতু হিসেবে বর্ষা ও শরৎসহ মোট ছয়টি ঋতুর আবির্ভাব ঘটে। আর প্রতিটি ঋতু প্রকৃতিতে বিচিত্র রূপমাধুর্যের সৃষ্টি করে। বছরের শুরুতে নতুনের বার্তা নিয়ে আগমন ঘটে গ্রীষ্মের। আর প্রতিটি ঋতুপ্রকৃতিতে বিচিত্র রূপমাধুর্যের সৃষ্টি করে। বছরের শুরুতে নতুনের বার্তা নিয়ে আগমন ঘটে গ্রীষ্মের। এর আগমনে বাংলার প্রকৃতির রুক্ষ, বিবর্ণ ও বিশুষ্ক হয়ে ওঠে। হারিয়ে যায় সবুজ প্রকৃতির শ্যামল শোভা। ভয়াল রুদ্র রূপ নিয়ে ধুলোর ঝড় তুলো আসে কালবৈশাখী। প্রকৃতিকে নবরূপে সজ্জিত করার জন্যই বুঝিবা গ্রীষ্মের এ দুর্দান্ত আগমন। অতঃপর বজ্রের কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে, বিদু্যতের পতাকা উড়িয়ে বর্ষা আসে দিগ্বিজয়ী যোদ্ধার মতো। বর্ষা প্রকৃতির সমগ্র অবয়বে আনে এক সতেজ কোমলতা।
বৃষ্টির অঝোর ধারায় গাছে গাছে, পাতায় পাতায় লাগে শিহরণ, জাগে সজীবতা। আর এ সজীবতা দোলা দেয় মানব মনকেও।
\হকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়-
'এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।'
বর্ষা যখন অলস মন্থর, একঘেয়েমি আর বিষণ্ন বিধুর নিঃসঙ্গতায় রূপান্তরিত হয় ঠিক সেই মুহূর্তে মেঘ ও রৌদ্রের লুকোচুরি খেলতে খেলতে হালকা চপল ছন্দে শরৎ আসে। এ যেন একটু মেঘ, এক পশলা বৃষ্টি, এক ঝলক হাওয়া আর পরক্ষণেই সোনালি রোদ্দুর। এ সময় বাতাসে এক খুশির সুর বেজে ওঠে। কবির ভাষায়-
'শরৎ, তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে
বনের পথে লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।'
এরপর আসে হেমন্ত। ঢেঁকির তালে ধান ভানার গানে গানে গ্রামগুলো নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠে। হেমন্তে সাঁঝের পর হালকা কুয়াশায় জোনাকিরা জ্বলে, নেভে। এ আলো-আঁধারি কুয়াশা গায়ে মেখেই বড় কুণ্ঠিত পদক্ষেপে সমৃদ্ধি নিয়ে কৃষকের দুয়ারে আবির্ভূত হয় হেমন্ত। হেমন্তের উৎসবমুখর গ্রামবাংলার হিমেল পরশ বুলিয়ে একদিন শীত আসে। প্রকৃতি এ সময় সমস্ত সাজ-সজ্জা ফেলে দিয়ে রিক্ত বৈরাগীর রূপ পরিগ্রহ করে। অন্যদিকে বিচিত্র বর্ণ ও গন্ধের ফুলে ফুলে প্রকৃতির আঁচল ভরে ওঠে। অবশেষে মাঘের তুহিন শীতল বন্ধন ছিন্ন করে প্রাচীমূলে বেরিয়ে আসে পুনঃসুসজ্জিতা ফাগুন, আসে বসন্ত তার রাজসিক রূপমাধুর্য নিয়ে। সবুজ কিশলয়ে বিকশিত হয় পত্রহীন শূন্য বৃক্ষশাখা। অশোক, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া আর শিমুলের বনে যেন আগুন লাগে লাল ফুলের। অতঃপর ঘুরে-ফিরে একসময় আবার আসে গ্রীষ্মের তাপদাহ, রুক্ষ, শুষ্ক কঠোর দিন।
এভাবে ছয়টি ঋতুর ধারাবাহিক আবর্তনে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে যে অপরূপ রূপমাধুর্যের সৃষ্টি হয় তা পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না।