শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১

ইতিহাস ও ঐতিহ্য

বাংলা একাডেমি
শিক্ষা জগৎ ডেস্ক
  ১০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
ইতিহাস ও ঐতিহ্য

বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষা সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ১৩৬২ বঙ্গাব্দের ১৭ অগ্রহায়ণ (৩ ডিসেম্বর ১৯৫৫) ঢাকার বর্ধমান হাউসে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলা একাডেমি হলো বাংলাদেশের ভাষা নিয়ন্ত্রক সংস্থা। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, গবেষণা ও প্রচারের লক্ষ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) এই একাডেমিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন বর্ধমান হাউসে এই একাডেমির সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। একাডেমির বর্ধমান হাউসে একটি 'ভাষা আন্দোলন জাদুঘর' আছে।

বিশ শতকের প্রথম দিকে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ সূচিত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তারা ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর। এ অবস্থা অতিক্রম করার প্রয়াসে লেখক-পন্ডিত-গবেষকদের দৃষ্টি পড়ে বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি। ১৯২৫ সালে কলকাতায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ্‌ বাংলা ভাষায় জ্ঞানসাধনা ও সাহিত্যচর্চার প্রস্তাব করেন। ১৯৪০ সালে এ কে ফজলুল হকের সভাপতিত্বে অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্সে তিনি বাংলা সরকারকে একটি অনুবাদ বিভাগ স্থাপনের অনুরোধ করেন। বিভাগোত্তরকালে ১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকায় পূর্ব-পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে মূল সভাপতির অভিভাষণে শহীদুলস্নাহ্‌ একটি একাডেমি গড়ার কথা বলেন। এর আগেই ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ও শিক্ষার ভাষা এবং উর্দুর পাশাপাশি পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের বিরোধিতার মুখে ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী ও জনগণের বিক্ষোভের চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটে এবং ঢাকায় একুশে ফেব্রম্নয়ারি পুলিশের গুলিতে কয়েকজন তরুণ শাহাদাত বরণ করেন। এ অবস্থায় বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির গবেষণা ও চর্চার কেন্দ্ররূপে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার দাবি আরও জোরাল হয়।

বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও সংগঠনের চিন্তা ড. মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ্‌ প্রথম করেন। ড. শহীদুলস্নাহ ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৪৮ এ পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে ভাষা সংক্রান্ত একটি একাডেমি প্রতিষ্ঠার দাবি করেন। এ ছাড়া দৈনিক আজাদ পত্রিকা বাংলা একাডেমি গঠনে জনমত সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। ১৯৫২ সালের ২৯ এপ্রিল পত্রিকাটি 'বাংলা একাডেমি' প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা জানিয়ে এ প্রসঙ্গে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সে সময় কিছু প্রচেষ্টা নেয়। ১৯৫৪ সালে এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবও গ্রহণ করা হয়। কিন্তু অর্থাভাবে প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হয়নি।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে শিক্ষামন্ত্রী সৈয়দ আজিজুল হক নির্দেশ দেন, প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের বদলে অপেক্ষাকৃত কম বিলাসের বাড়িতে বাসস্থান নির্দিষ্ট করবেন এবং বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাত্রাবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হবে।

অবশেষে ১৯৫৫ সালে ৩ ডিসেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার উদ্বোধন করেন 'বাংলা একাডেমি'। বাংলা একাডেমির প্রথম সচিব মুহম্মদ বরকতুলস্নাহ। তার পদবি ছিল 'স্পেশাল অফিসার'। ১৯৫৬ সালে একাডেমির প্রথম পরিচালক নিযুক্ত হন অধ্যাপক ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক। বাংলা একাডেমির প্রথম প্রকাশিত বই আহমদ শরিফ সম্পাদিত দৌলত উজির বাহরাম খান রচিত লায়লী-মজনু। স্বাধীনতার পর থেকে একাডেমি চত্বরে স্বল্পপরিসরে বইমেলা শুরু হয় এবং ১৯৭৪ সাল থেকে বড় আকার ধারণ করে। ২০০৯-২০১১ খ্রিষ্টাব্দে একাডেমির বর্ধমান হাউস ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয়তলায় ভাষা আন্দোলন জাদুঘর স্থাপিত হয়েছে।

প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই দেশবাসীর দৃষ্টিতে বাংলা একাডেমি একটি মার্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে। শুধু বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রামের আবেগময় ভাবাদর্শের প্রতীকরূপেই নয়, বিশ্বের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রসিদ্ধ কেন্দ্রগুলোর অন্যতম প্রতিষ্ঠানরূপেও এটি পরিগণিত হয়ে থাকে। একে এখন বাঙালির মননের প্রতীক বলে মনে করা হয়।

১৯৬০ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন শাখায় বছরে ৯ জনকে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বছরে ২ জনকে এই পুরস্কার প্রদানের নিয়ম করা হলেও, পরে ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে চারটি শাখায় পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে