আওরঙ্গজেব আস-সুলতান আল-আজম ওয়াল খাকান আল-মুকাররম আবুল মুজাফফর মুহি উদ-দিন মুহাম্মাদ আওরঙ্গজেব, বাহাদুর আলমগীর, বাদশাহ গাজী, আলমগীর নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি ১৬১৮সালের
৩ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শাহজাহান এবং মুমতাজ মহলের তৃতীয় সন্তান। ১৬২৬ সালে তার পিতার এক ব্যর্থ বিদ্রোহের পর আওরঙ্গজেব এবং তার ভাই দারাশুকোকে লাহোরের দরবারে জিম্মি হিসেবে তাদের পিতামহের কাছে রাখা হয়। ১৬২৮ সালের ২৮ ফেব্রম্নয়ারি শাহজাহান নিজেকে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করার পর তিনি আগ্রার দুর্গে বসবাস শুরু করেন। সেখানে আরবি এবং ফারসি ভাষায় তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন। তার দৈনিক ভাতা হিসেবে পাঁচশত রুপি নির্ধারণ করা হয়, যেটা তিনি ধর্ম ও ইতিহাস শিক্ষার পেছনে খরচ করেন। ১৬৩৩ সালের ২৮ মে আওরঙ্গজেব অল্পের জন্য হাতির পায়ের নিচে পদদলিত হয়ে মৃতু্যর হাত থেকে বেঁচে যান। তিনি অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে উন্মত্ত হাতিটির মোকাবিলা করেছিলেন। তার এই সাহসিকতায় সম্রাট অত্যন্ত খুশি হয়ে তাকে বাহাদুর খেতাবে ভূষিত করে দুই লাখ রুপি পুরস্কার প্রদান করেছিলেন।
আওরঙ্গজেব (১৬৫৮-১৭০৭) উত্তরাধিকার যুদ্ধে জয়লাভের পর 'আলমগীর পাদশাহ গাজী' উপাধি গ্রহণ করে দিলিস্নর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তার রাজত্বকালে উত্তর-পূর্ব, উত্তর-পশ্চিম এবং দক্ষিণে মুঘল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটে।
১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে মৃতু্যর আগ পর্যন্ত ৪৯ বছর মুঘল সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি প্রায় সম্পূর্ণ ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছিলেন তার ফতোয়া-ই-আলমগীরীর শরিয়াহ আইন এবং ইসলামি অর্থনীতির মাধ্যমে। তিনি ছিলেন বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর এবং শাহ জাহানের পর ষষ্ঠ মুঘল সম্রাট। তিনি সম্রাট শাহজাহানের পুত্র। তিনি একজন দক্ষ সামরিক নেতা ছিলেন। যার শাসন প্রশংসার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও তাকে ভারতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত শাসক হিসেবেও বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি ইংরেজদের পরাজিত করেছিলেন ইঙ্গ-মুঘল যুদ্ধে।
আওরঙ্গজেব কোরআনের একজন হাফেজ ছিলেন। সম্রাট হওয়া সত্ত্বেও তিনি সাধারণভাবে জীবনযাপন করেছেন। তিনি টুপি এবং নিজের হাতের লিখা কোরআন বিক্রি করতেন আর রাজ্যের সম্পদ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন না।
মুঘল সম্রাট হিসেবে আওরঙ্গজেবের শাসনকালে বিভিন্ন যুদ্ধের মাধ্যমে সাম্রাজ্যের সীমানা বহুদূর বিস্তৃত হয়। তার আমলে দক্ষিণাঞ্চলে ৪০ লাখ বর্গ কিলোমিটার ভূখন্ড মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৫ কোটি ৮৯ লাখ প্রজা তার শাসনাধীন ছিল। তার সময় মুঘল সাম্রাজ্যের বাৎসরিক করের পরিমাণ ছিল ৪৫০ মিলিয়ন ডলার, যা তার সমসাময়িক চতুর্দশ লুইয়ের আমলে ফ্রান্সের বাৎসরিক কর এর চেয়ে ১০ গুণ বেশি ছিল। তার শাসনামলে ভারত চীনকে ছাড়িয়ে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে গড়ে উঠেছিল। যার পরিমাণ ছিল ৯০ বিলিয়ন ডলার, ১৭০০ সালে সমগ্র পৃথিবীর মাথাপিছু আয়ের এক চতুর্থাংশ।
আওরঙ্গজেব শাসক হিসেবে বিতর্কিত এবং সমালোচিত ছিলেন। তার পূর্বসূরিদের ধর্মীয়সহিষ্ণুতার নীতি উপেক্ষা করে তিনি ভারতে জিজিয়া করের প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি মারাঠা সাম্রাজ্যের শাসক সম্ভাজিকে মৃতু্যদন্ড প্রদান করেন। তিনি নবম শিখ গুরু তেগ বাহাদুরকে মৃতু্যদন্ডে দন্ডিত করেন।
সিংহাসনে আরোহণ করার পরপরই ১৬৫৭ সালে আওরঙ্গজেব বিজয়পুরের অবাধ্য সুলতানদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করেন। এই যুদ্ধে মুঘলরা রকেট ব্যবহার করেছিল। দুর্গের প্রাচীর বেয়ে ওঠার সময় মুঘল সৈন্যরা গ্রেনেড এবং রকেট ছুড়েছিল। একটি রকেট গোলাবারুদের স্তূপে আঘাত করলে ব্যাপক বিস্ফোরণ হয় এবং সিডি মারজান নিজে মারাত্মকভাবে আহত হন। ২৭ দিন ধরে চলা তুমুল যুদ্ধের পর মুঘল বাহিনীর কাছে বিদার এর পতন হয়।
১৬৬৩ সালে আওরঙ্গজেবের লাদাখ ভ্রমণের সময় এই অঞ্চলে মুঘলরা সরাসরি কর্তৃত্ব স্থাপন করে। দেলদান নামগয়ালের মতো শাসকরা মুঘলদের বশ্যতা স্বীকার করে নেয় এবং উপঢৌকন প্রেরণ করে। লেহতে দেলদান নামগয়াল একটি গ্র্যান্ড মসজিদ মুঘলদের উৎসর্গ করেছিলেন।
১৬৮৫ সালে আওরঙ্গজেব তার পুত্র মোহাম্মদ আজম শাহকে বিজাপুরের দুর্গ দখল করতে পাঠান। তার সঙ্গে ছিল ৫০ হাজার মুঘল। সিকান্দার আদিল শাহ ছিলেন বিজাপুরের শাসনকর্তা। তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে সামন্ত হিসেবে দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানান। মুঘলরা বিজাপুরের দুর্গের দিকে অগ্রসর হতে পারেনি। এর কারণ উভয় দলই ভারী কামান দ্বারা সুসজ্জিত ছিল। ১৬৮৬ সালের ৪ সেপ্টেম্বর আওরঙ্গজেব নিজে বিজাপুরের যুদ্ধে যোগদান করেন। অষ্টম দিনের মাথায় তার নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী জয়লাভ লাভ করে।
কুতুব শাহী বংশের শাসক আবুল হাসান কুতুব শাহ আওরঙ্গজেবের কাছে আত্মসমর্পণ করতে অস্বীকার করেছিল। কুতুব শাহ এবং তার লোকজন গোলকুন্ডা দুর্গের অবস্থান গ্রহণ করে এবং বিখ্যাত হীরার খনি কলেস্নাড় খনির নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। সম্ভবত তখনকার সময় এই খনিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি হীরা উৎপাদিত হতো। বলাবাহুল্য, ১৬৮৭ সালে এই খনি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থনৈতিক সম্পদ। আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে কুতুবশাহী শাসকের বিরুদ্ধে গোলকুন্ড দুর্গ অবরোধ করে ছিলেন। কুতুবশাহী শাসকরা বংশ-পরম্পরা ধরে সেখানে অত্যন্ত সুরক্ষিত একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিল। দুর্গটি মাটি থেকে ৪০০ ফিট উঁচুতে অবস্থিত ছিল এবং একটি আট মাইল লম্বা গ্রানাইট পাথরের প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। অত্যন্ত মজবুত প্রধান ফটকটি যেকোনো সামরিক হাতির আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম ছিল। অত্যন্ত সুরক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও আওরঙ্গজেবের বাহিনী এক রাতে উঁচু মাচান বানিয়ে এই দুর্ভেদ্য প্রাচীর টপকে দুর্গের ভেতর প্রবেশ করে। দীর্ঘ আট মাসের অবরোধ যুদ্ধে মুঘলরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল তাদের সেনাপতি কিলিচ খান বাহাদুরের মৃতু্য। এরপর আওরঙ্গজেব বাহিনী দুর্গের একটি প্রধান ফটক দখল করে নেয়, যার ফলশ্রম্নতিতে আবুল হাসান কুতুব শাহ শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করেন। ১৬৮৯ সালের মধ্যে সমগ্র দক্ষিণ ভারত মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। বিশেষ করে গোলকুন্ডা বিজয়ের পর মুঘল সাম্রাজ্যের আয়তন ৪ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটারে উন্নীত হয়। এর জনসংখ্যা ছিল ১৫৮ মিলিয়ন। কিন্তু এই আধিপত্য ক্ষণস্থায়ী ছিল। আওরঙ্গজেব তার পূর্বসূরিদের মতো রাষ্ট্রীয় কোষাগারকে নিজের সম্পত্তি মনে না করে জনগণের আমানত হিসেবে মনে করতেন।
১৭০৭ সালের ৩ মার্চ তার মৃতু্যর পর ভারতের মধ্যযুগীয় যুগ শেষ হয় এবং ইউরোপীয় আক্রমণ শুরু হয়। আওরঙ্গজেবকে প্রায়ই আমিরুল মুমিনিন (বিশ্বাসীদের নেতা) ডাকা হয় এবং উমর ইবনুল খাত্তাব ও সালাহউদ্দিন ইউসুফ ইবনে আইয়ুবের মতো বিশিষ্ট খলিফাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়।