শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ষাট পেরিয়ে কুমার বিশ্বজিৎ

মাতিয়ার রাফায়েল
  ০১ জুন ২০২৩, ০০:০০

জননন্দিত সঙ্গীতশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ। চিরসবুজখ্যাত এ শিল্পীর প্রকৃত বয়স কত আজও এক রহস্যের ধাঁধায় রয়ে গেছে। ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী দেখা যায় তার জন্ম ১৯৬৩ সালের ১ জুন। সে হিসেবে এ শিল্পী আজ ৬১ বছরে পড়লেন। কিন্তু তাকে দেখে কে বলবে তিনি ৬০ পেরিয়েছেন!

সবসময়েই হাস্যোজ্জ্বল এ শিল্পীর হাসিটিও যেন লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মোনালিসার অবিস্মরণীয় স্মিত হাসির মতোই রহস্যময়। সে হাসিরও কোনো বয়স হয় না। এমন নিষ্কলুষ হাসির বিশ্বজিৎ ইতোমধ্যে পেরিয়েছেন সঙ্গীত ক্যারিয়ারের ৪১ বছর। ১৯৭৭ সালে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে বেতারে গান গাওয়া শুরু করেন তিনি। পেশাগতভাবে গানে পা রাখেন ১৯৮২ সাল থেকে। ১৯৮৫ সালে আলাউদ্দিন আলীর সুর-সঙ্গীতে নূর হোসেন বলাইর 'আমরা দু'জন দুটি শান্ত ছেলে' গানে প্রথম পেস্ন-ব্যাক করেন তিনি। এরপর থেকে আর পিছনে ফিরে

তাকাতে হয়নি এ চিরসবুজকে। পেয়েছেন তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

চার দশক আগের তরুণ-তরুণীর মনে কাঁপন ধরানো গান 'তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে...' আজও ধরিয়ে যায় নতুন প্রজন্মের শ্রোতাদের মনে সেই কাঁপন। বিটিভিতে 'শিউলীমালা' অনুষ্ঠানে প্রথম প্রচারিত হয় গানটি। এরপর অডিওতে ছড়িয়ে দেওয়া সেই মন মোহনী গানের তরঙ্গ আজও সব বয়সের সঙ্গেই সমান মানানসই। সেই একই কণ্ঠের জাদুতে এখনো এ শিল্পী জয় করে চলেছেন কোটি মানুষের হৃদয়। এক গানেই রাতারাতি তারকাখ্যাতি পাওয়া বিশ্বজিতের আরেকটি শ্রোতাপ্রিয় গান- 'চতুর্দোলা তে চড়ে দেখো ঐ বধূ যায়...' দ্রম্নততম সময়ের মধ্যেই যশখ্যাতি পেয়ে যান কুমার বিশ্বজিৎ।

আবির্ভাবেই দুই বাংলাতেই সমান শ্রোতাপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন কুমার বিশ্বজিৎ। শুধু তাই নয়, এ দেশে অডিও পস্ন্যাটফর্মটিও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে তার গান শুনে শুনেই। বিটিভিতে প্রচারিত 'যেখানেই সীমান্ত তোমার'- গানটি সাড়া না পেলেও অডিওতে প্রচার হওয়া মাত্রই সেটা সীমানা পেরনো জনপ্রিয়তা পায়। তাতেই বোঝা যায়, এ দেশে গানকে জনপ্রিয় করে তোলায় অডিওর ভূমিকাও কী অপরিসীম।

সেই অডিও শিল্পটি হারিয়ে যাওয়ায় এ শিল্পীর মনেও যেন কী একটা আর্তনাদ দুলে ওঠে : আমরাই প্রথম নন-ফিল্মিক গানে একটা নতুন ক্রেজ এনেছিলাম। সিনেমায় তো দৃশ্যায়নের ব্যাপার থাকে, কাহিনীচিত্র, নায়ক-নায়িকা থাকে। সেগুলো এক ধরনের মিউজিক ভিডিওই। কিন্তু আমাদের নন-ফিল্মিক ক্যাসেটের গানে কিচ্ছুই ছিল না। গান শুনেই মানুষ দৃশ্যায়ন করত। যার যার কল্পনা শক্তিতে চলে যেত। এ জন্যই বলছি মানুষ এত রোবটিক হয়ে গেছে, তার জন্মগত হৃদয়বৃত্তিক যে বৈশিষ্ট্য ছিল সেগুলো থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এখন একান্নবর্তী পরিবার আছে? সিনেমা, নাটকেও নেই- কারণ বাস্তবেই নেই। এখন পিতা-পুত্র এবং মাতা। শাশুড়িকেও রাখে না মাকেও রাখে না। বলেন- 'মা' এবং 'তুমি রোজ বিকেলে'র মতো অবিস্মরণীয় গানের এ শিল্পী।

'পুতুলের মতো করে সাজিয়ে' গানটিতে আজকের স্বাধীনচেতা নারীদের কাছে কতটা আবেদন থাকতে পারে- এমন প্রশ্নে এ শিল্পী বলেন- 'তারপরও প্রেম কিন্তু চিরকালই এক। প্রেমের ভাষা, হৃদয়ের ভাষা চিরকালই এক থাকবে। 'তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে হৃদয়ের কুঠুরে রাখবো'- গানটির সুরে যে ব্যঞ্জনা ও আবেদন রয়েছে তা শাশ্বত, তা চিরকালীন। তবে বর্তমানে আধুনিকতার নামে নারীকে যেভাবে সাজানো হচ্ছে তাকে আমি আধুনিকতা মনে করি না। আধুনিকতার নামে আমার মা'কে এই সাজাতে সাজাতে কোথায় নিয়ে যাবেন? এরপর কি 'হাফপ্যান্টে' নামিয়ে আনবেন? তারপরে? এর নাম তো আধুনিকতা নয়। আধুনিকতা হচ্ছে চিত্তের পরিশুদ্ধি করা ও মানবিক হওয়া। এই আধুনিকতায় চিত্তের শুদ্ধি বা মানবিক হওয়া দূরের কথা বরং আমি দেখছি তা দূষিত আর অমানবিকই হচ্ছে। একসময় মানুষের মধ্যে হৃদয়ের যে শুদ্ধ জায়গাটা ছিল সেটা ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছে।'

যে অডিওতে তার গান প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, জনপ্রিয়তা পেয়েছে- সেই শ্রোতারা কি আছে এমন কথায় চিরসবুজ এ শিল্পী তার সমগ্র সময়কেই চিরসবুজময় দেখাতে গিয়ে বলেন, 'আমি তো এখনো সমকালীন। আমার আবার প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের শ্রোতা কি। ওই সময়ের শ্রোতা আর বর্তমানের শ্রোতায় কোনো ফারাক নেই। শ্রোতা বলতে তো তিনটা শ্রেণিই। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং যারা দিন আনে দিন খায়- সেই নিম্নবিত্ত। এই তিন শ্রেণির শ্রোতা আগেও ছিল বর্তমানেও আছে। তবে প্রযুক্তিতে একটা পরিবর্তন আসায় এখন শ্রোতা বলতে কিছু নেই। এখন গান হয়ে গেছে দেখার বিষয়। শোনার নয়। ফলে এখন আগের সেই শ্রোতাও নেই। এই যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, 'তুমি কেমন করে গান করো যে গুণী, অবাক হয়ে শুনি, কেবল শুনি'- গানের কল্পনায় ডুবে যাওয়া সেই শ্রোতা কি এখন আছে? যেকালে শ্রোতাদের হয়তো ইহজীবনেও গায়ককে দেখার সুযোগ হয়নি এই গানের কথা সেই সময়ের। এখন গানেই দেখানো হচ্ছে গায়কের সঙ্গে আপনিও তার গানের কথা ও সুরের সঙ্গে কখন কোন কাঞ্চন জঙ্ঘায় চলে যাচ্ছেন, কিংবা আরও দূরে কোন মেঘমালার ভেতরে... এমন সব ইমেজের কম্পোজিশন। এখন আপনাকে বাধ্য করছে এই কম্পোজিশনের মতো কল্পনা করতে। নিজের স্বাধীনমতো কল্পনা করবেন সেই সুযোগই নেই এখনকার ভিডিওতে। অথচ একসময় শ্রোতারা গায়কের আড়ালে থেকেও তার গানের ব্যঞ্জনার সঙ্গে নিজের কল্পনার স্বাধীনতা মেশাতো। এখন সেরকম স্বাধীনতা আছে? ইউটিউব আপনাকে বাধ্য করছে এমন কল্পনা করতে যার ইমাজিনারি তারাই তৈরি করছে। আর আপনাকেও সেভাবেই কল্পনা করতে হচ্ছে। সুতরাং এখন আগের সেই স্বাধীন শ্রোতা নেই!' এতটা বছর পার করেও কী করে তিনি আজও সেই অমলিন চিরসবুজ হয়ে আছেন এর রহস্য জানতে চাইলে সহাস্যে কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, 'মনকে সুন্দর রাখুন, মনে কোনো দাগ লাগানো থেকে বিরত থাকুন, চির সবুজ আপনিও থাকবেন।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে