ভিন্ন ধারার গানের জন্য প্রখ্যাত দুই বাংলার জনপ্রিয় শিল্পী কবীর সুমন। বাংলা গানে আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছিলেন। তার এক একটি নতুন গান মানে নতুন গল্প শোনানো। যে গানের গল্প শুনে শ্রোতা মুগ্ধ হন গভীর আপস্নুত হয়ে।
বাংলাদেশ নিয়ে বরাবরই একটা নিখাদ ভালোবাসা আছে কবীর সুমনের। শুধু তাই নয়, তিনি একবার তার জীবনের শেষ দিনগুলো বাংলাদেশেই কাটাতে চেয়েছেন। 'আশ্রয়' চেয়ে নিজের ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। চেয়েছেন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে থাকতে। বাংলাদেশের প্রতি কতটা ভালোবাসা থাকলেই তার নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করেন এভাবে। জন্ম ভারতের ওড়িশায়, বেড়ে ওঠা কলকাতাতে হলেও বাংলাদেশের প্রতিও বেশ টান রয়েছে এই গীতিকারের। সুযোগ পেলেই ঢাকায় এসে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন তিনি।
তারই ধারাবাহিকতায় সেই পোস্টে এই গায়ক জানিয়েছিলেন, নিজের শেষ জীবনটা বাংলাদেশেই কাটাতে চান। কবীর সুমনের ইচ্ছা, তিনি মারা গেলে যেন তার মরদেহ বাংলাদেশেরই কোনো হাসপাতালে কাজে লাগানো হয়।
ধর্মান্তরিত হয়েছেন বলে শুধু কলকাতায়ই নয়, বাংলাদেশেও খারাপ পরিস্থিতি যাচ্ছিল বিগত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের আমলে। তাকে এখানে গান করতে দেওয়া হতো না। একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন গান করতে। কিন্তু নির্দিষ্ট ভেনু্যতে গান করতে দেওয়া হয়নি তাকে। ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে কবীর সুমনের গান করার কথা ছিল শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে। কিন্তু অনুষ্ঠান করতে সরকার বাধা দেওয়ায় পরে তার বদলে ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউটে করা হয়। 'সুমন চট্টোপাধ্যায়' হলে গান শোনা যাবে, 'কবীর সুমন' হলে যাবে না এমন অজুহাতে। কবীর সুমনের বক্তব্য 'আমার ক্ষেত্রে মজা হলো- আমি তো নিজের নাম পাল্টেছি, অন্য কারুর না। তাতেও কত লোকের আপত্তি।' এমন কিংবদন্তি শিল্পীর সঙ্গে এমন আচরণ করেছে বিগত সরকারের সময়ে কিছু অতি প্রগতিশীল পরিচয়ধারী মহল।
এর আগেও ২০০৯ সালের অক্টোবরে তিনি যখন এসেছিলেন, সে সময় তার গানের প্রোগ্রাম ছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে। কিন্তু সেখানে গান গাইতে গেলে স্বৈরাচার হাসিনার সরকার তাকে বাধা দেয়। বাধ্য হয়ে অনুষ্ঠান না করেই কবীর সুমন ফিরে যান কলকাতায়। বলা চলে হাসিনা সরকারের আমল ছিল কবীর সুমনের জন্য প্রচন্ড তিক্ততার আমল। অভিমানে এরপর বাংলাদেশে আসা বাদ রাখেন অনেকদিন। সেই অভিমান চেপে রেখেই এক যুগের বেশি সময় কবীর সুমন ঢাকায় আসেননি বলে গুঞ্জন। শুধু তাই নয়, তাকে আমন্ত্রণও জানানো হতো না তখন। ২০০৯ সালের মতো তেমনিভাবে ২০২২ সালেও সেই একই আচরণ করে স্বৈরাচার হাসিনা সরকার।
অথচ বাংলাদেশের দুঃখে-কষ্টে, বিপদে-আপদে এই ক্ষণজন্মা শিল্পীর মনও আঁৎকে ওঠে। সম্প্রতি বাংলাদেশের ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘূর্ণিঝড়ের মতো, টর্নেডো, জীনন্ত আগ্নেয়গিরির লাভাশ্রোতের মতো বল্কিয়ে ওঠে। এতে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ গোটা দেশে আন্দোলনকারীদের হটাতে ব্যাপক লাঠি, গুলি, কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করছে পুলিশ। সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন অসংখ্য অরাজনৈতিক ছাত্র ও অরাজনৈতিক জনতা। দেশের ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। হাসিনা সরকারের পাষন্ডের মতো নির্বিচারে ছাত্র-জনতা হত্যা করা হলেও কবীর সুমন বিচলিত হয়ে ওঠেন।
আজকাল ডট ইনকে তিনি বললেন, 'আমি ভারতের নাগরিক এবং বাংলাদেশ আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র। বাংলাদেশ আমার কাছে একটি বিশেষ আবেগের জায়গা যেই জায়গায় ভারতবর্ষ কিন্তু নেই! ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার ২২ বছর বয়স। সেই সময়ে থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে আমি একাত্ম। এতটাই যে ওই সময়ে আমি এবং আমার দাদা আনন্দরূপ পরিকল্পনা করেছিলাম বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চাইব, কারণ সেই দেশের ভাষা আমার মাতৃভাষা। অনেকেই জানেন না ১৯৯৬ সালে আমি প্রথম সে দেশে যাই বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘর কর্তৃপক্ষের আমন্ত্রণে। পাঁচটি সঙ্গীত অনুষ্ঠান করেছিলাম বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা জাদুঘরের তহবিলের জন্য টাকা তুলতে। ১৯৯৮ সালে আরও একটি সফর। সেটির কারণও এক। এত কথা বললাম এটা বোঝাতে, এতটাই আমার কাছের পদ্মাপারের দেশ। এবারে আসি আন্দোলনের প্রসঙ্গে। দেখুন, বাংলাদেশের সরকার কেমন সে বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই। কিন্তু সংরক্ষণ নিয়ে যে বিরোধিতা করছেন ছাত্রছাত্রীরা, তাদের সঙ্গে একবার আলোচনায় বসা উচিত ছিল শেখ হাসিনার সরকারের। কিন্তু তারা বসলেন না। আমার মনে হয়, এটা ঠিক হলো না। আন্দোলনরত যুবক-যুবতীরা ঠিক, বেঠিক...তাদের কথায় যুক্তি থাকুক কিংবা না থাকুক, তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসা উচিত ছিল সরকারের'।
সেই আন্দোলনের ভাবাবেগের জায়গা থেকে এবার বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নিয়ে নতুন গান বেঁধেছেন কবির সুমন। নতুন গানটি ফেসবুকে শেয়ার করেছেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এই শিল্পী। গানটির সঙ্গে অনুরাগীদের পরিচয় করিয়ে দিতে ক্যাপশনে তিনি জানিয়েছেন, মুক্তির এই আলো, বাংলাদেশ জ্বালালো, এ-লড়াই মুক্তির গান।
সুমনের গানের কথাগুলো এমন কতদিন কাঁদিনি/কতদিন ভাবিনি/কতদিন জাগিনি এভাবে, ঐ তো বাংলাদেশ/ স্বৈরাচারের শেষ/এ আগুন কেই-বা নেভাবে, আবার বাঁচতে চাই/মৃতু্যর মুখে ছাই, বাংলা ভাষাই হলো প্রাণ, মুক্তির এই আলো/বাংলাদেশ জ্বালালো/এ লড়াই মুক্তির গান।
বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নিয়ে এ পর্যন্ত সরব হতে দেখা গেছে কলকাতার অনেককেই। সেই দলে আছেন কবির সুমন, অভিনেত্রী স্বস্তিকা, নির্মাতা সৃজিত প্রমুখ। এছাড়া বলিউডের অনেকেই বাংলাদেশের এ আন্দোলন নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, করেছেন প্রার্থনা। কণ্ঠশিল্পী কবির সুমন একাধারে দুই বাংলাতেই ভীষণ জনপ্রিয়। বিভিন্ন সময় ভক্ত-অনুরাগীদের গান শোনাতে বাংলাদেশেও এসেছেন তিনি। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, এদেশের মানুষের সঙ্গে তার আত্মার টান রয়েছে। ফলে এখানকার নানা ঘটনায় সরব হয়ে উঠতে দেখা যায় শিল্পীকে।
বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে সুমন ফেসবুকে লিখেছিলেন, 'করজোরে সব পক্ষকে মিনতি করছি, অনুগ্রহ করে হিংসা-হানাহানি বন্ধ করুন। ঢাকা সরকারকে অনুরোধ করছি, বাংলা ভাষার কসম, শান্তি রক্ষার চেষ্টা অব্যাহত রাখুন। আপনাদের ছাত্রবাহিনী যেন হিংসার আশ্রয় না নেন।' পাশাপাশি তিনি এও লিখেছেন, 'ছবি দেখছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। একটু আগেই দেখলাম। মিছিল করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। নেপথ্যে শোনা যাচ্ছে কাজী নজরুল ইসলামের "কারার ঐ লৌহকপাট/ভেঙে ফেল্ কর রে লোপাট"! মনে হচ্ছে গানটি এডিট করে বসানো হয়েছে ভিডিওর সঙ্গে। ঠিক কাজই করা হয়েছে। কত সময়ে দেখেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আমার গানের লাইন লিখে দিয়েছেন দেওয়ালে। পশ্চিমবঙ্গে সে তুলনায় কিছুই দেখিনি। বলতে দ্বিধা নেই, মনে মনে আমি বাংলাদেশেরও নাগরিক।'