শনিবার, ১৭ মে ২০২৫, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

২৫ বছর ধরে নতুন গল্পের অপেক্ষায় শবনম

শবনমের আসল নাম ঝর্ণা বসাক। ঢাকায় অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের এক জমিদার বংশে জন্ম নেন তিনি। তার পরিবারের কেউ চলচ্চিত্রের মানুষ ছিলেন না। তার বাবা ননী বসাক ছিলেন একজন ক্রীড়াবিদ এবং জনপ্রিয় ফুটবল রেফারি। এই পরিবারের কেউ সিনেমার নায়িকা হবেন সেটা ছিল অকল্পনীয়। ঝর্ণা ছোটবেলায় ছিলেন দুরন্ত, নাচের প্রতি ভীষণ টান ছিল তার। মেয়ের শিল্পের প্রতি ঝোঁক তেমন পছন্দ করতেন না মা। তবে বাবার অনুপ্রেরণা ছিল সব সময়।
বিনোদন রিপোর্ট
  ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
২৫ বছর ধরে নতুন গল্পের অপেক্ষায় শবনম
শবনম

দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে একটি নতুন সিনেমায় অভিনয়ের অপেক্ষায় আছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেত্রী শবনম। ১৯৯৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত কাজী হায়াৎ পরিচালিত 'আম্মাজান' সিনেমায় সর্বশেষ নাম-ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। এরপর তাকে আর কোনো সিনেমায় অভিনয়ে দেখা যায়নি বিগত ২৫ বছরে।

এটা সত্যিই অবাক করার মতো বিষয়ই বটে। কিন্তু এটাই সত্যি যে দীর্ঘ ২৫ বছর তার কাছে এমন কোনো মৌলিক গল্পের সিনেমাতে অভিনয়ের প্রস্তাব যায়নি যাতে তিনি মুগ্ধ হয়ে অভিনয় করবেন।

1

একটা সময় ছিল যখন শবনমকে বাংলাদেশের দর্শক 'হারানো দিন', 'চান্দা', 'তালাশ', 'নাচের পুতুল'-এর নায়িকা হিসেবেই বেশি চিনতেন। তারপর অবশ্য তিনি বাংলাদেশের 'সন্ধি', 'শর্ত', 'সহধর্মিণী', 'যোগাযোগ', 'জুলি',' বশিরা', 'দিল'সহ আরও অনেক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। পরবর্তী সময় অর্থাৎ ১৯৯৯ সালের ২৫ জুন কাজী হায়াৎ পরিচালিত 'আম্মাজান' সিনেমাটি মুক্তির পর থেকে আজ অবধি দর্শক তাকে 'আম্মাজান' হিসেবেই চেনেন। দীর্ঘদিন তিনি পাকিস্তানের সিনেমাতে অভিনয় করেছেন বলে অনেকেই মনে করতেন তিনি পাকিস্তানের নায়িকা। কিন্তু এই ধারণাও ভুল।

শবনমের আসল নাম ঝর্ণা বসাক। ঢাকায় অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের এক জমিদার বংশে জন্ম নেন তিনি। তার পরিবারের কেউ চলচ্চিত্রের মানুষ ছিলেন না। তার বাবা ননী বসাক ছিলেন একজন ক্রীড়াবিদ এবং জনপ্রিয় ফুটবল রেফারি। এই পরিবারের কেউ সিনেমার নায়িকা হবেন সেটা ছিল অকল্পনীয়। ঝর্ণা ছোটবেলায় ছিলেন ভীষণ দুরন্ত, নাচের প্রতি ভীষণ টান ছিল তার। মেয়ের শিল্পের প্রতি ঝোঁক তেমন পছন্দ করতেন না মা। তবে বাবার অনুপ্রেরণা ছিল সব সময়।

'আম্মাজান'-এর পর আর কোনো সিনেমায় অভিনয়ে দেখা যায়নি শবনমকে। এরই মধ্যে বেশ কয়েক বছর আগে তিনি হারিয়েছেন স্বামী বরেণ্য সঙ্গীত পরিচালক রবিন ঘোষকে। একমাত্র ছেলে রনিকে নিয়েই তিনি রাজধানীর একটি অভিজাত এলাকায় বসবাস করছেন। শবনম বলেন, 'আর কোনোদিন সিনেমায় অভিনয় করব কি না জানি না। তবে ইচ্ছে তো আছেই, গল্প মৌলিক হলে ভেবে দেখব। দেখতে দেখতে ৭৭টি বছর পার করে দিলাম। অথচ এখনো মনে হয় এইতো সেদিনের কথা, বাবা-মায়ের সঙ্গে সময় কাটছে, স্কুলে যাচ্ছি, ফিল্ম করছি। আর এখন ভাবলে মনে হয় কত সময় চলে গেছে জীবন থেকে। জীবনের কত রূপ দেখেছি, নানান বয়সে জীবনের সৌন্দর্যকে উপভোগ করেছি। কত মানুষের সঙ্গে পরিচয়, কত কিছু শিখেছি এক জীবনে, কত কোটি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। আবার হারিয়েছিও অনেক প্রিয়জনকে। সত্যি বলতে কী মৃতু্য পর্যন্ত জীবন সুখ-দুঃখের খেলা। এখনো সুস্থ আছি, ভালো আছি-এটাই কম কিসের। বয়স তো আর কম হলো না। সবার দোয়া ও ভালোবাসা চাই।'

চলচ্চিত্রে আসার অনেক আগে থেকেই শবনম নাচের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে নাচ শিখতেন। এহতেশাম পরিচালিত 'এদেশ তোমার আমার' সিনেমাতে তখন একটি গানে বেশ কয়েকজন নাচের মেয়ের দরকার হয়ে পড়ে। তখন বুলবুল ললিতকলা একাডেমি থেকেই কয়েকজনকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই দলে শবনমও ছিলেন। এরপর 'রাজধানীর বুকে' সিনেমাতে তিনি একটি একক নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন। তার পরপরই এহতেশাম তাকে ও রহমানকে নিয়ে শুরু করেন 'হারানো দিন' সিনেমাটি। এরপর একে একে অনেক সিনেমাতে অভিনয় করেন শবনম।

ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে শবনম পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন। সেখানে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত একচ্ছত্র বিস্তার করেছিলেন তিনি। হয়তো বিশ্বে তিনিই একমাত্র অভিনেত্রী, যিনি ১৯৬০ থেকে ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত তিন দশক ধারাবাহিকভাবে একটি ইন্ডাস্ট্রিতে সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিলেন।

এ সময়কালে পাকিস্তানে শবনম-ওয়াহিদ মুরাদ, শবনম-নাদিম জুটি জনপ্রিয় ছিল। পরবর্তীকালে পাকিস্তানে বসবাস শুরু করায় পাঞ্জাবি সিনেমাতেও অভিনয় করেন এ অভিনেত্রী। ষাটের দশকে তার অভিনীত 'তালাশ' সিনেমা পাকিস্তানে মুক্তি পেলে ওই সময়ের সর্বাপেক্ষা ব্যবসা সফল সিনেমার মর্যাদা লাভ করে। এছাড়া তার অভিনীত 'আয়না' সিনেমা পাকিস্তানের সিনেমা হলগুলোতে দীর্ঘদিন চলার রেকর্ড করে।

শবনম অভিনীত উর্দু সিনেমাগুলো হচ্ছে- 'আখেরি স্টেশন', 'আসরা', 'আনমল মোহাব্বত', 'আনারি', 'আনোখি', 'আয়না', 'আবশার', 'আখো আখো মে', 'ইন্তিখাব', 'কারাবান', 'ক্যয়সে কাহু', 'কসম আজ ওয়াক্ত কি', 'কাভি আলভিদা না ক্যাহনা', 'চান্দা', 'চালো মান গায়ে', 'জাঞ্জির', 'জাগির', 'তালাশ', 'তুম মেরে', 'দোস্তি', 'দিলস্নাগি', 'দিল নাশিন', 'নয়া আন্দাজ', 'নারাজ', 'প্রীত না জানে রীত', 'পেহচান', 'বেগানা', 'বিন্দাস', 'রিশতা', 'হাম দোনো', 'শরিক-ই-হায়াত', 'শরাফত', 'সাগর' ও 'সমন্দার'।

পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পে অসামান্য অবদান রাখায় শবনম সম্মানসূচক পুরস্কার হিসেবে মোট ১২ বার নিগার পুরস্কার লাভ করেন। ২০১২ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির অংশগ্রহণে শবনমের হাতে আজীবন কৃতিত্বের (লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট) পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। ২০১৯ সালের লাক্স স্টাইল অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে তাকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়। এখনো পাকিস্তানের মিডিয়া ও সাধারণ দর্শক মনে রেখেছেন তাকে। তাইতো সে দেশের 'সিতারা-ই-ইমতিয়াজ' এ সর্বোচ্চ পদকটি পেলেন শবনম। ২০২৪ সালের ২৩ মার্চ এ সম্মাননা তুলে দেওয়া হয় তার হাতে। বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে পাকিস্তান গিয়ে পুরস্কারটি নিয়ে আসেন তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে