বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫, ১৯ আষাঢ় ১৪৩২

বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করাও ইবাদত

সাখাওয়াত হোসেন
  ০৫ মে ২০২১, ০০:০০
বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করাও ইবাদত

প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ যে কোনো বিপর্যয়ে মানুষ যখন বিপদাপন্ন এ সময় তাদেরকে আর্থিক সহায়তা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন ও চিকিৎসাসেবা দানসহ যে কোনো ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করাও আলস্নাহর ইবাদত। ইসলাম মানবিক কারণে সামান্য পরিমাণ সহায়তাকেও খাটো করে দেখে না। সে জন্য অতিশয় নগণ্য পরিমাণ দানকেও উৎসাহিত করা হয়েছে।

রাসুলুলস্নাহ (সা.) বলেছেন, 'যে ব্যক্তি দান-সাদকা দেয়, তা একটি খেজুর পরিমাণও হোক না কেন, আলস্নাহ তা নিজ হাতে গ্রহণ করেন। তবে শর্ত এই যে, তা বৈধ পথে উপার্জিত হতে হবে। কেননা, আলস্নাহ এই বস্তুকেই পছন্দ করেন এবং তা বৃদ্ধি করে নেন আর তা এতটাই যে, এই খেজুর এক পাহাড় পরিমাণ হয়ে যায়।' (বুখারি ও মুসলিম)

এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, 'হে মুমিনগণ! আমি তোমাদের যে জীবনের উপকরণ দিয়েছি, তা থেকে তোমরা ব্যয় করো সেদিন আসার পূর্বেই, যেদিন কোনো বেচাকেনা, বন্ধুত্ব এবং সুপারিশ থাকবে না।' (সুরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫৪)

সাহায্যকারীর দান কখনো বৃথা যায় না (যদি-না তা লোক দেখানো হয়ে

থাকে) উলেস্নখ করে নবী করিম (সা.) ঘোষণা করেন, 'একটি রুটি দানের কারণে তিন ব্যক্তিকে জান্নাতে পাঠানো হবে। ১. আদেশদাতা, ২. রন্ধনকর্তা, ৩. সেই পরিবেশনকর্তা যে রুটি নিয়ে গরিবকে পরিবেশন করেছে।' (হাকিম, তাবারানী)

হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, 'রোজ কিয়ামতের দিন মানুষ বর্ণনাতীত ক্ষুধা-পিপাসা নিয়ে উলঙ্গ অবস্থায় উত্থিত হবে। যে ব্যক্তি আলস্নাহর সন্তুষ্টির জন্য দুনিয়াতে মানুষকে খাদ্য দান করেছে, সেদিন তাকে খাদ্য দান করা হবে। যে আলস্নাহকে খুশি করার জন্য মানুষকে পানি পান করিয়েছে, তাকে সেদিন পানি পান করিয়ে তার পিপাসা দূর করা হবে। যে মানুষকে বস্ত্র দান করেছে, তাকে সেদিন বস্ত্র পরিধান করিয়ে তার লজ্জা নিবারণ করা হবে।' অন্য হাদিসে উলেস্নখ আছে, 'হাশরের ময়দানে বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত দানশীল লোকেরা তাদের দানের ছায়ার নিচে অবস্থান করবে।'

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সবসময় অন্যের বিপদ-আপদ ও দুঃখ-কষ্ট মাথায় রেখে উম্মতদের জীবন-যাপনের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি নিজেও বিপদে-আপদে রুগ্‌ণ মানুষের সেবা করেছেন, অন্যদের দান-সাদকা ও বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করার ব্যাপারে উৎসাহিত করে বলেছেন, 'তোমরা দান-সাদকা করো। এতে আলস্নাহ খুব খুশি হন ও দানকারীর সম্পদ বাড়িয়ে দেন।' যে ব্যক্তি শুধু প্রথাগত ইবাদত করে কিন্তু আলস্নাহর রাস্তায় বিপদগ্রস্ত ও আর্তমানবতার কল্যাণের জন্য দান-খয়রাত, জাকাত-সাদকা, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সাহায্য-সহযোগিতায় এগিয়ে আসে না, সমাজের অসহায়, দুর্গত, ক্ষতিগ্রস্ত গরিব-দুঃখী মানুষের অভাব দূরীকরণ, চরম ক্ষুধা নিবারণ ও দারিদ্র্য বিমোচনে দানের হাত সম্প্রসারণ করে তাদের পাশে দাঁড়ায় না, ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে অংশগ্রহণ করে না, সে আলস্নাহ ও তার রাসুল (সা.)-এর কাছে কখনোই প্রিয়ভাজন হতে পারবে না।

ইসলামের বিধান অনুযায়ী, বিপদাপন্ন মানুষকে সাহায্য করতে গিয়ে যদি নিজেদের অভ্যস্ত জীবনযাত্রায় সামান্য ব্যয় সংকোচনের প্রয়োজন হয়, এতে তাদের কুণ্ঠিত হওয়া উচিত নয়। তাই করোনাকালীন এই দুঃসময়ে অসহায় বিপদগ্রস্ত মানুষের দিকে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া প্রতিটি সামর্থ্যবান মানুষের জন্য অবশ্য করণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবাই বিপদগ্রস্তদের পাশে এগিয়ে এলে এ দুর্যোগময় পরিস্থিতি মোকাবিলা করা মোটেও কঠিন হবে না।

বিপদগ্রস্ত অভাবীদের সাহায্য সহযোগিতার গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে পবিত্র কোরআন এবং হাদিসে সুস্পষ্ট উলেস্নখ রয়েছে। মহান আলস্নাহতায়ালা বলেন, 'মুমিনগণ! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদের আলস্নাহর স্মরণ থেকে গাফেল না করে। যারা এ কারণে গাফেল হয়, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত। আমি তোমাদের যা দিয়েছি তা থেকে মৃতু্য আসার আগেই ব্যয় কর। অন্যথায় সে বলবে, হে আমার পালনকর্তা, আমাকে আরও কিছুকাল অবকাশ দিলেন না কেন? তাহলে আমি সদকা করতাম এবং সৎকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।' (সুরা মুনাফিকুন : ৯-১০)

সুরা বাকারাহর ১৯৫ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, 'আর ব্যয় কর আলস্নাহর পথে, তবে নিজের জীবনকে ধ্বংসের মুখোমুখি কর না। আর মানুষের প্রতি অনুগ্রহ কর। আলস্নাহ অনুগ্রহকারীদের ভালোবাসেন।'

'আর আলস্নাহ যাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ থেকে যা দান করেছেন তা নিয়ে যারা কৃপণতা করে তারা যেন ধারণা না করে যে, তা তাদের জন্য কল্যাণকর। বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর। যা নিয়ে তারা কৃপণতা করেছিল, কিয়ামত দিবসে তা দিয়ে তাদের বেড়ি পরানো হবে। আর আসমানসমূহ ও জমিনের উত্তরাধিকার আলস্নাহরই জন্য। আর তোমরা যা আমল কর সে ব্যাপারে আলস্নাহ সম্যক জ্ঞাত।' (সুরা আল-ই ইমরান: ১৮০)

'যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-খয়রাত কর, তবে তা কতই না উত্তম। আর যদি দান গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্তদের দিয়ে দাও, তবে তা তোমাদের জন্য আরও উত্তম। আলস্নাহতায়ালা তোমাদের কিছু গুনাহ দূর করে দেবেন। আলস্নাহ তোমাদের কাজকর্মের সব খবর রাখেন।' (সুরা বাকারাহ : ২৭১)

দান সদকার গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে রসুল (সা.) বলেছেন, 'খেজুরের একটি টুকরা দান করে হলেও তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার চেষ্টা কর।' (বোখারি ও মুসলিম)

মহাগ্রন্থ আল কোরআনে দানের কথাটি সালাত বা নামাজের মতোই বিরাশিবার উলেস্নখ হয়েছে। 'জাকাত' শব্দটি পবিত্র কোরআনে আছে বত্রিশবার, নামাজের সঙ্গে কোরআন মাজিদে আছে ছাব্বিশবার; স্বতন্ত্রভাবে কোরআন কারিমে আছে চারবার; পবিত্রতা অর্থে রয়েছে দুবার। জাকাত কখনো 'সদাকাহ' এবং কখনো 'ইনফাক' শব্দ দ্বারা বোঝানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইনফাক শব্দটি ব্যাপক, সদাকাহ শব্দটি সাধারণ ও জাকাত শব্দটি বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো কখনো এর ব্যতিক্রমও হয়েছে, অর্থাৎ এ তিনটি শব্দ একে অন্যের স্থলে ব্যবহার হয়েছে।

দানের প্রাথমিক সুনির্দিষ্ট খাতগুলো কোরআন কারিমে উলেস্নখ হয়েছে এভাবে, 'মূলত সদাকাত হলো ফকির, মিসকিন, জাকাতকর্মী ১ (খলিফা কর্তৃক নিযুক্ত জাকাত ব্যবস্থাপনায় কর্মরত ব্যক্তির মজুরি), অনুরক্ত ব্যক্তি, ক্রীতদাস, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আলস্নাহর পথে জিহাদ (মানবতা, মানবাধিকার ও মানবসভ্যতার সুরক্ষার জন্য) ও বিপদগ্রস্ত বিদেশি মুসাফিরের জন্য। এটি আলস্নাহ কর্তৃক নির্ধারিত। আর আলস্নাহ সর্বজ্ঞানী ও পরম কৌশলী।' (সুরা-৯ তাওবা, আয়াত: ৬০)।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে