শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এটিএম কার্ড ক্লোন ঠেকাতে এবার কঠোর নজরদারি

গঠন করা হয়েছে বিশেষ টিম জারি করেছে বিশেষ নির্দেশনা
ম গাফফার খান চৌধুরী
  ২৯ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
আপডেট  : ২৯ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:০২

এটিএম কার্ড ক্লোন করে টাকা হাতিয়ে নেয়া ঠেকাতে প্রতিটি ব্যাংকের আইটি অডিট বাধ্যতামূলক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্র্রীয় ব্যাংকের তরফে একটি বিশেষ টিমও গঠন করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থা ছাড়াও টিমের সদস্য করা হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে। ইতোমধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তরফ থেকে বিশেষ নির্দেশনাও জারি করা হয়েছে। যা কঠোরভাবে পালন করতে বলা হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। বেশ কয়েকটি ব্যাংক এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করেনি। নির্দেশনা মানার ক্ষেত্রে গাফিলতি করা ব্যাংকগুলোর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংক তাদের এটিএম বুথে এন্টি স্কিমিং ডিভাইস স্থাপন করেনি। ফলে ওইসব ব্যাংকের এটিএম কার্ড ক্লোন করে বুথ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা বিভাগ সূত্রে আরও জানা গেছে, এটিএম কার্ড ক্লোন করে এটিএম বুথ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনাটি প্রথমে প্রকাশ পায় ২০১৬ সালে। এরপর বিভিন্ন সময় ব্যাংকগুলোকে নানা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আজও বেশ কয়েকটি ব্যাংক তা আমলে নেয়নি। নির্দেশনা না মানা কয়েকটি ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকেই টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনাগুলো ঘটেছে। চলতি বছর এসব ছাড়াও নানা বিষয় নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গর্ভনরসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়। সেই বৈঠকের পর একটি বিশেষ নির্দেশনা জারি করা হয়। সূত্রটি বলছে, নির্দেশনা মতে প্রতিটি ব্যাংক তাদের এটিএম বুথে এন্টি স্কিমিং ডিভাইস বসাতে বাধ্য। এমন কী ব্যাংকের এটিএম বুথে সর্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরা সচল রাখা, এটিএম বুথের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সিকিউরিটি গার্ডের পুলিশ ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে নিয়োগ করা বাধ্যতামূলক করা হয়। সিকিউরিটি গার্ডকে এটিএম বুথ ফেলে অন্যত্র না যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। মাস্ক, মুখোশ বা হেলমেট পরিহিত অবস্থায় কোনো ব্যক্তি যাতে এটিএম বুথে ঢুকতে না পারে এবং টাকা তুলতে না পারে সে বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতেও যখন কাজ হচ্ছিল না, তখন এটিএম বুথে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে তা ব্যাংকের কেন্দ্রীয় সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত করতে বলা হয়। যাতে এটিএম বুথে মুখ ঢেকে কেউ টাকা তুলতে না পারে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের মূখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, আমরা সম্মিলিতভাবে বিশেষ সার্কুলার জারি করেছি। যা মানতে বাধ্য প্রতিটি ব্যাংক। তবে অধিকাংশ ব্যাংকই তাদের এটিএম বুথে এন্টি স্কিমিং ডিভাইস বসিয়েছে। আবার কোনো কোনো ব্যাংক এখনো শতভাগ তাদের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেনি। যেসব ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করেনি, দেখা গেছে ওইসব ব্যাংকের এটিএম কার্ড ক্লোন করেই বুথ থেকে টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের কঠোর মনিটরিং আর প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা জোরদার করার কারণে সম্প্রতি এমন ঘটনা তুলনামূলক অনেক কমে এসেছে। কার্ড ক্লোন ঠেকাতে আমরা একটি শক্তিশালী কমিটিও গঠন করেছি। কমিটির সদস্য করা হয়েছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে। আমরা পুরো টিমকে মনিটরিং করি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে জোরালোভাবে কাজ করছে। আশা করছি ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ আরও কমে আসবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গঠিত টিমের সদস্য ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্র্যান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান যায়যায়দিনকে বলেন, এটিএম কার্ড ক্লোন করে টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনাটি ২০১৬ সালে প্রথমে নজরে আসে। ওই সময় তিনটি বেসরকারি ব্যাংকের তরফ থেকে এটিএম কার্ড ক্লোন করে বুথ থেকে টাকা তুলে নেয়ার অভিযোগে রাজধানীর বনানী ও পলস্নবী মোট তিনটি মামলা দায়ের করে তিনটি বেসরকারি ব্যাংক। এমন অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে জার্মানির নাগরিক পিওটর স্কেজেফান মাজুরেক, সিটি ব্যাংকের কর্মকর্তা মোকসেদ আলী মাকসুদ, রেজাউল করিম শাহীন ও রেফাত আহমেদ রনিকে গ্রেপ্তার করা হয়। সবশেষ গত ১৮ জানুয়ারি গ্রেপ্তার হয় তুরস্কের নাগরিক হাকান জানবারকান ও তার বাংলাদেশি সহযোগী মফিউল ইসলামকে। গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে যুগ্ম কমিশনার আসাদুজ্জামান বলেন, এটিএম কার্ড ক্লোন করে বুথ থেকে টাকা হাতিয়ে নিতে গড়ে ওঠেছে একটি আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্র। চক্রের সদস্যদের মধ্যে রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, ইউক্রেনসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিক আছেন। এটিএম কার্ড ক্লোন করে বুথ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়া প্রতারক চক্রের ব্যাপারে আমরা সতর্ক আছি। কোনো ব্যাংক মামলা করলে আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করি। ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের উপকমিশনার আ ফ ম আল কিবরিয়া যায়যায়দিনকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মোতাবেক প্রতিটি ব্যাংক তাদের সকল সেক্টরে আইটি অডিট করার কথা। কিন্তু সেটি পুরোপুরি হয় না। যে কারণে এটিএম কার্ড ক্লোন করে বুথ থেকে টাকা তুলে নেয় প্রতারকরা। অনেক ব্যাংকের এটিএম কার্ড ক্লোন করে বুথ থেকে টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটলেও, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গ্রাহকের একাউন্টে টাকা দিয়ে দেয়। ব্যাংকের ইমেজ নষ্ট হওয়ার ভয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মামলা করে না। এমনকি তারা বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেও অভিযোগ করে না। কারণ তাতে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি জরিমানা করার ভয় আছে। এমন ঘটনা তুলনামুলক অনেক বেশি। এ ব্যাপারের্ যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যায়যায়দিনকে বলেন, ইতোপূর্বে এটিএম কার্ড ক্লোনকারী ১১ জনকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। আমাদের সাইবার বিভাগ বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। পাশাপাশি গোয়েন্দা তৎপরতাও বাড়ানো হয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মিডিয়া বিভাগের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ বিভিন্ন চেইন শপগুলোতে থাকা পজ মেশিনের মাধ্যমে কার্ড দিয়ে কেনাকাটা করার তথ্য হাতঘড়িতে চুরি হয় বলে প্রথম শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। হাতে পরে থাকা হাতঘড়ি ইচ্ছাকৃতভাবেই পজ মেশিনের কাছে থাকা দোকান কর্মচারী কাজের ছলে পজ মেশিনের সঙ্গে ঠেকায়। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পজ মেশিনে ঢুকানো ওই এটিএম কার্ডের তথ্য চলে যায় হাতঘড়িতে থাকা ডিভাইসে। এরপর সেই তথ্য দিয়ে ক্লোন এট্‌িএম কার্ড তৈরি করে বুথ থেকে টাকা তুলে নিত প্রতারক চক্র। এ ঘটনায় গুলশানের একটি চেইন শপ থেকে মূল মাস্টার মাইন্ডকে গ্রেপ্তার করা হয়। এমন ঘটনার পর প্রতিটি চেইন শপে ব্যবহৃত পজ মেশিন সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে সাবধানতা অবলম্বন করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। কারণ পজ মেশিনগুলো বিভিন্ন ব্যাংকের তরফ থেকে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো সূত্রে জানা গেছে, গত সাত বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে দেশি বিদেশি মিলিয়ে এটিএম কার্ড ক্লোন করে বুথ থেকে টাকা তুলে নেয়ার ঘটনায় অন্তত ৫৫ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। জব্দ হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৪শ' ক্লোন করা এটিএম কার্ড, ম্যাগনেটিক স্ট্রিপ কার্ড রিডার, রাউটার, পজ মেশিন, তথ্য চুরির কাজে ব্যবহৃত ডিজিটাল হাতঘড়ি, মিনি কার্ড রিডার ডিভাইস, পরচুলাসহ নানা সরঞ্জাম।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে