শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাজার অস্থিতিশীলতায় নানা কারসাজি!

সাখাওয়াত হোসেন
  ২৮ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত থাকার ব্যাপারে রোজা শুরুর মাত্র ১১ দিন আগে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) জানায়, রমজান মাসের চাহিদা অনুযায়ী ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজসহ অন্য নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুত ও সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। অথচ রোজা শুরুর পর বাজারে পণ্যমূল্যের আগুনের আঁচ এতটুকুও কমেনি। বরং কোনো কোনো পণ্যে এ উত্তাপ আরও বেড়েছে। গোয়েন্দা অনুসন্ধানে এর নেপথ্যে সংঘবদ্ধ বাজার সিন্ডিকেটের নানামুখী কারসাজির প্রমাণ মিলেছে।

এ পরিস্থিতিতে সরকারকে দেওয়া গোপন প্রতিবেদনে বাজারে থাকা সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের ওপর কড়া নজর রেখে তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে গোয়েন্দারা সুপারিশ করেছে। প্রতিবেদনে বাজারের পরিস্থিতি, পণ্যের স্বাভাবিক সরবরাহ থাকার পরও সিন্ডিকেটের কারসাজিতে অকস্মাৎ নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া ও কৃত্রিম সংকটের বিষয়টিও স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া রমজানকেন্দ্রিক পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বৃদ্ধির অপকৌশল রুখতে কৌশলী পদক্ষেপ নেওয়ারও সুপারিশ রয়েছে।

অন্যদিকে সরকারের নির্দেশে পুলিশের বিশেষ শাখাসহ কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা রমজান শুরুর আগেই গোপন প্রতিবেদনের মাধ্যমে বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেছে। এসব প্রতিবেদনে বাজারে সিন্ডিকেটের ভয়াবহ বিস্তার, তাদের কারসাজির নানা কৌশল এবং এতে নিত্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়ে ওঠার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে ভোক্তার দুর্দশা ও হতাশা থেকে সৃষ্টি চাপা ক্ষোভের বিষয়েও সতর্ক করেছে গোয়েন্দারা। প্রতিবেদনে বাজার তদারকি বৃদ্ধি এবং নজরদারিরও সুপারিশ করা হয়েছে।

এতে বলা হয়, এবারের রমজান সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ রমজান। এ কারণে রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারে সরকারের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। তা না হলে সরকারবিরোধী

চক্র বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে সাধারণ জনগণকে ক্ষুব্ধ করে তুলতে পারে। যা ভোটের মাঠে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।

এদিকে নানা অজুহাতে ব্যবসায়ীরা দেশে উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লেও এর নেপথ্যে যে বাজার সিন্ডিকেটের ভয়ংকর কারসাজি রয়েছে তা ব্রয়লার মুরগির আকস্মিক দর পতনের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর 'বিগ ফোর' হিসেবে পরিচিত কাজী ফার্মস লিমিটেড, আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেড, সিপি বাংলাদেশ এবং প্যারাগন পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড নামের চার প্রতিষ্ঠানকে তলব করে বাজারে ব্রয়লার মুরগির 'অযৌক্তিক' মূল্যবৃদ্ধির কারণ জানতে চাওয়ার পর মাত্র ৪ দিনের ব্যবধানে কেজিতে ৪০ টাকা দাম কমেছে।

বাজার পর্যবেক্ষক ও গোয়েন্দারা মনে করছেন, এভাবে প্রতিটি খাতের ব্যবসার মূল নিয়ন্ত্রকদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা গেলে বাজার পরিস্থিতি দ্রম্নত স্বাভাবিক হবে। একই সঙ্গে কারসাজির মাধ্যমে বাজার অস্থিতিশীল করার সব ষড়যন্ত্র ভেস্তে যাবে। এতে বাজারে স্বস্তি ফিরে আসবে।

এদিকে বাজারে খাদ্যসহ সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের যোগান ও সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার ব্যাপারে সরকার আশ্বস্ত করলেও সে আস্থা ভেঙে জনগণকে প্যানিক বায়িংয়ের দিকে ঝোঁকাতে একাধিক চক্র তৎপরতা চালাচ্ছে বলেও গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, রোজা যত বাড়বে, জিনিসপত্রের দামও তত বাড়বে এমন গুজব ছড়িয়ে এ চক্র বাজার অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। এ চক্রের বেশিরভাগ সদস্যই বিভিন্ন পণ্যের মূল নিয়ন্ত্রক। তারা মূলত সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের নজরদারির মধ্যেই প্যানিক সৃষ্টি করে ব্যবসায়িক ফয়দা লুটতে চাইছে।

অন্যদিকে অপর দেশে পর্যাপ্ত যোগান রয়েছে এ ধরনের বেশকিছু পণ্য অবৈধভাবে মজুত করেও একটি চক্র বাজার অস্থিতিশীলতার চক্রান্ত করছে। গোয়েন্দারা এ চক্রের অন্তত দুই ডজন হোতাকে চিহ্নিত করে তাদেরকে কঠোর নজরে রেখেছে। তাদের গতিবিধি নিয়মিত মনিটর করা হচ্ছে। এ চক্রের হোতাদের কোথায় কোন গোডাউন রয়েছে, সেখানে কী পরিমাণ মাল মজুত আছে, নতুন করে সেখানে আরও কতটা মজুত বাড়ানো হচ্ছে, তারা কী পরিমাণ মাল নিয়মিত বাজারে সরবরাহ করছে গোয়েন্দারা তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। নির্ধারিত গোডাউনের বাইরে এ চক্র অন্য কোথাও মাল মজুত করছে কি না সে ব্যাপারেও কঠোর মনিটরিং চলছে। অবৈধভাবে পণ্যের মজুতকারীদের বিরুদ্ধে যাতে যে কোনো সময় দ্রম্নত ব্যবস্থা নেওয়া যায় তারও প্রস্তুতি রাখা হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, রমজান ঘিরে বাজার পর্যবেক্ষণ বা মনিটরিংয়ের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে সরকারের ১০টি সংস্থা মাঠে নেমেছে। এছাড়া যত পর্যায়ে পণ্য হাতবদল হয় তার কোনো পর্যায়েই যাতে পণ্য মজুত না হয় তা নজরদারি করা হচ্ছে। পাশাপাশি যে বাজারে অনিয়ম পাওয়া যাবে সেই বাজারের কমিটি বাতিলসহ নানা রকম শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। রমজানপূর্ব বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে সরকার জিরো টলারেন্স নীতিতে এগোচ্ছে।

ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন স্তরে চালের যৌক্তিক মূল্য ঠিক করতেও কাজ করছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের একটি যৌথ কমিটি। এসব কমিটিকে বাজারে পণ্যের দাম যাচাই করে নিয়মিত প্রতিবেদন জমা দিচ্ছে। সে প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ আকারে পাঠানো হচ্ছে। পরবর্তীতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে করণীয় নির্ধারণ করে অ্যাকশনে যাচ্ছে।

বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণে বেশ আগেই ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই) সব পক্ষ নিয়ে বৈঠক করে। এলসি খোলা নিয়ে যে জটিলতা ছিল সরকার তা সহজ করেছে। রমজান মাস শুরুর আগেই রোজায় বাজারে চাহিদা বাড়ে এমন পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ রাখার ব্যবস্থা নিয়েছে। বিশেষ করে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, বিভিন্ন ধরনের ডাল ও খেজুরের সরবরাহ যাতে ঠিক থাকে তার ওপর নজরদারি শুরু করে। তবে একাধিক সিন্ডিকেট সরকারি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোর তদারকিতে ফাঁকি দিয়ে নানা কারসাজির মাধ্যমে বাজার অস্থিতিশীল করে তুলেছে।

সরকার এ বছর রোজার আগেই ভোজ্যতেল, চিনি, লবণ, পেঁয়াজ, রসুন, মসুর ডাল, ছোলা, শুকনো মরিচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, ধনে, জিরা, আদা ও তেজপাতাসহ প্রায় এক ডজন পণ্যের দাম নির্ধারণ করার উদ্যোগ নিলেও বাজারে তার সুফল মেলেনি। বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, দোকান ও বাজারের সাইন বোর্ডে যে মূল্য তালিকা থাকছে, শুধুমাত্র ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনেই সে দাম রাখা হচ্ছে। তারা বাজার থেকে চলে গেলেই দোকানিরা ইচ্ছামতো জিনিসপত্রের দাম হাঁকাচ্ছেন। ক্রয় রশিদ অনুযায়ী সামান্য কিছু লাভ রেখে জিনিসপত্র বিক্রির নির্দেশনা থাকলেও বেশিরভাগ দোকানিই তা মানছেন না। এমনকি ক্রয় রশিদ দেখাতেও তারা অপারগতা প্রকাশ করছেন। যদিও ভ্রাম্যমাণ আদালতকে ক্রয় রশিদ দেখাতে না পারলে মোটা অঙ্কের জরিমানা করা হচ্ছে। তবে কালেভদ্রে অভিযান পরিচালনা হওয়ায় ব্যবসায়ীরা তা থোড়াই কেয়ার করছেন। বিশেষ করে কাঁচা বাজারে কেনা দামের চেয়ে কয়েকগুণ বেশিতে বিক্রির ঘটনা বেশি ঘটছে।

এ বাস্তবতায় একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ঢাকার বাইরে থেকে আনা পণ্য কেন দ্বিগুণ বা তিনগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে, তার কারণ অনুসন্ধান করা হয়েছে। তাদের দেওয়া প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই এখন চালানো হচ্ছে ফৌজদারি কার্যক্রম। অন্যদিকে পুলিশের বিশেষ শাখার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা ও নজরদারি করা না হলে পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে সরকারের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এই সিন্ডিকেট সরকারকে বেকায়দায় ফেলে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে পারে। কয়েকটি বিরোধী দল এ নিয়ে গুজব রটানো ও অপপ্রচারে মাঠে নামতে পারে। এমন আশঙ্কায় গোয়েন্দা প্রতিবেদনে কয়েকটি সুপারিশও করা হয়েছে। যেমন ঢাকার বাইরে থেকে পণ্য আসার ক্ষেত্রে পথের সব ভোগান্তি, বিশেষ করে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। এছাড়া বিদেশ থেকে যারা পণ্য আমদানি করে, তাদের পণ্য খালাসে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে সেবা দিয়ে দ্রম্নত পণ্য খালাস করে বাজারে নেওয়ার কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকির মাধ্যমে আরও বেশি পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করতে পারলে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, তারা ইতোমধ্যে নজরদারির মাধ্যমে যেসব ব্যবসায়ীর বিষয়ে সিন্ডিকেট তৈরি করে দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর বিষয়ে তথ্য পেয়েছেন, তাদের প্রতিষ্ঠানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। যে কোনো সময় ঝটিকা অভিযানের মাধ্যমে অসাধু সিন্ডিকেটের সদস্যদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি তার গুদামে থাকা অবৈধভাবে মজুত পণ্য প্রয়োজনে জব্দের পর নিলামে বিক্রি করা হবে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার এ প্রসঙ্গে বলেন, শুধু বাজার কারসাজিকারীই নয়, ভেজাল পণ্য প্রস্তুত ও বিপণনকারীদের সম্পর্কেও খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। বাজারের অসাধু ব্যবসায়ীদের কর্মকান্ড মনিটরিংয়ের কাজ চলছে। গোয়েন্দা পুলিশের সব ইউনিটকে এ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যাতে অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট তৈরি করে কোনো পণ্যের দাম বাড়াতে না পারেন।

র্

যাব পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, বাজার ঠিক রাখতে সব ধরনের নজরদারি চলছে। পাশাপাশি রয়েছের্ যাবের নিজস্ব ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কিংবা বিশেষ কোনো কারসাজিতে কেউ যাতে ফায়দা লুটতে না পারে সে ব্যাপারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে।র্ যাবের প্রধান কাজ হচ্ছে প্রতিটি আড়ত ও দোকানে পণ্যের তালিকা ও দাম ঠিকমতো মানা হচ্ছে কি না সেটা নিশ্চিত করা। কারণ দেশে কোনো পণ্যের সংকট নেই। তাই পণ্য সংকটের অজুহাতে দাম বাড়ানোর কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে