জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সাহায্য করার জন্য ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিল বিশ্বের ধনী দেশগুলো। তিন বছরেও সে অর্থ দেয়নি শিল্পোন্নত দেশগুলো। বরং এই অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রম্নতি বরখেলাপ করে ২০২৫ সাল থেকে অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রম্নতি দিচ্ছে। প্রতিশ্রম্নতির বেড়াজালে আবদ্ধ হচ্ছে জলবায়ু তহবিল। এদিকে ২০২৫ সালে যে অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছে শিল্পোন্নত দেশগুলো; তাও ভন্ডুল করে দিয়েছে আমেরিকা। তাদের আপত্তিতে সেই তহবিলও বন্ধ হয়ে গেছে।
সকল প্রতিশ্রম্নতি ভেস্তে যাওয়ার পর নতুন করে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি বছর দেড় লাখ কোটি ডলার প্রদানের নতুন প্রতিশ্রম্নতি দেয় বিশ্ব নেতারা। এখন সেই অর্থ নিজেরা না দিয়ে বহুজাতিক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রদানের প্রতিশ্রম্নতি দিচ্ছে। যা জলবায়ুর জন্য ক্ষতিপূরণ নয়, বরং ছয় শতাংশ ঋণে অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রম্নতি দিচ্ছে। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে ঢাকঢোল পিটিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে তা বরখেলাপ করছে শিল্পোন্নত দেশগুলো। সবুজ জলবায়ু তহবিলে অর্থ না দেওয়ার প্রশমন তহবিল শূন্য হয়ে আছে দীর্ঘদিন। অর্থায়নের কথা দিয়েও শিল্পোন্নত দেশগুলো কথা রাখছে না। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী দেশগুলোর প্রতিশ্রম্নতি বরখেলাপ, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর কাছে যেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার মতোই বাজে- কেউ কথা রাখেনি।
এদিকে ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য একটি রোডম্যাপ করার প্রতিশ্রম্নতি দিলেও তা করেনি ধনী দেশগুলো। এমনকি ২০২০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন দেড় ডিগ্রির মধ্যে আটকানোর যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, তাও বাস্তবায়ন করেনি উন্নত বিশ্বের দেশগুলো। গত পাঁচ বছর ধরে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো আবার নতুন করে প্রতিশ্রম্নতি পাচ্ছে। কিন্তু তার বাস্তবায়ন পাচ্ছে না। প্রতিশ্রম্নতির ফানুসে উড়ছে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো।
বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ঠেকাতে সুনির্দিষ্ট রূপরেখার বদলে কথার ফুলঝুরি নিয়ে হাজির হন বিশ্বনেতারা। বিশেষ করে বাংলাদেশসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার তহবিল প্রদানের বিষয়টি উন্নত দেশগুলোর কথার মারপঁ্যাচে এড়িয়ে যায়। গত বছর ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জন্য অভিযোজন তহবিলের বরাদ্দ বাড়ানো এবং আগের দেওয়া প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ জলবায়ু তহবিল অর্থ প্রদান ত্বরান্বিত করতে বাংলাদেশসহ ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) প্রতিনিধিরা কঠোর অবস্থানে গিয়েও দাবি আদায়ে ব্যর্থ হয়।
লস অ্যান্ড ড্যামেজ, সবুজ জলবায়ু তহবিল এবং প্রশমন-অভিযোজন খাতে ৫০ শতাংশ করে অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রম্নতিও রাখেনি শিল্পোন্নত দেশগুলো। এ তহবিলেও যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি রয়েছে। 'লস অ্যান্ড ড্যামেজ' স্বল্প ব্যয় বা কারিগরি সহায়তা বাবদ ৬ শতাংশ সুদে ঋণ খায়ানোর চেষ্টা করেছে। যদিও তারা এ ঋণকে জলবায়ু মোকাবিলায় বিনিয়োগ হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
উপকূলের যেসব জনগোষ্ঠী লবণাক্ততার সঙ্গে লড়াই করছে, যেসব জনগোষ্ঠী বন্যা ও ঝড়ের সঙ্গে মোকাবিলা করে মানবেতর জীবনযাপনের মুখোমুখি হচ্ছে- সেসব জনগোষ্ঠী জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা না রাখলেও এর ভয়াবহতার শিকার হচ্ছেন। অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী শিল্পোন্নত দেশগুলো। ধনী দেশগুলো ব্যাপক কার্বন নিঃসরণ করে থাকে। এ কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঝুঁকির শীর্ষে। অথচ প্রতিশ্রম্নতি দেওয়ার নাম করে তারা ভুলিয়ে রাখছেন ক্ষতিগ্রস্তদের।
জলবায়ু গবেষক জিয়াউল হক মুক্তা বলেন, প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী জলবায়ু ক্ষতি মোকাবিলায় যে ক্ষতিপূরণ বাংলাদেশের পাওয়া উচিত, তা পাচ্ছে না। প্যারিস চুক্তিতে এ বিষয়ে লিগ্যাল অ্যাগ্রিমেন্ট না থাকায় যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থা (ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এডিবি, আইএমএফ) অর্থ ছাড়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। প্রতিশ্রম্নতির বরখেলাপ করে দাতারা জলবায়ু তহবিলের অর্থ দিতে গড়িমসি করছে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রম্নতি না রাখাটা একটা রীতিতে পরিণত হয়েছে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আমিনুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু তহবিলে অর্থ কোনো দান-খয়রাত নয়। শিল্পোন্নত দেশগুলো যুগ যুগ ধরে বেশি কার্বন পুড়িয়ে যে বায়ুদূষণ করেছে, এটা তারই ক্ষতিপূরণ; যাতে গরিব দেশগুলো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে। উষ্ণায়ন ঠেকানো ধনী-গরিব দেশসহ পৃথিবীর সকলকে প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অর্থায়ন করতে প্রতিবছর ১০০ বিলিয়ন ডলার করে ছাড় করার প্রতিশ্রম্নতি দেয় উন্নত বিশ্বের দেশগুলো। এখন পর্যন্ত ধনী দেশগুলো সাড়া দিচ্ছে না। শিল্পোন্নত দেশগুলো অর্থায়ন নিয়ে কৌশলী হয়ে উঠেছে। তারা বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বহুজাতিক অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জলবায়ু তহবিলের অর্থের নামে ঋণ দিতে চাইছে।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ডক্টর আতিকুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশ। শিল্পোন্নত দেশগুলো ক্ষতিপূরণ বাবদ যে অর্থ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিল, তা তারা দেয়নি। এ অর্থ আদায়ে বাংলাদেশকে অন্যান্য ক্ষতিগ্রস্ত দেশকে সঙ্গে নিয়ে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। লস অ্যান্ড ড্যামেজের ক্ষয়ক্ষতির অর্থ আনতে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরির জন্য এলডিসি দেশগুলোকে নিয়ে বিশ্ব নেতাদের চাপ দিতে হবে।
বাংলাদেশে কার্বন নিঃসরণের হার মাত্র দশমিক ৪৭ শতাংশের কম। আর উন্নত দেশগুলোতে গড় কার্বন নিঃসরণের হার ছয় টনের বেশি। কোনো রকম দূষণ না ঘটিয়েও বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের নিষ্পাপ শিকার। উন্নত বিশ্বের পরিবেশবিধ্বংসী উন্নয়ন-কার্বন নির্গমন এবং তাদের বিলাসবহুল জীবনযাপন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য মূলত দায়ী। বিশ্বে বাতাসে যত কার্বন ডাইঅক্সাইড মিশছে, তার অধিকাংশই আসছে মাত্র চারটি শিল্পোন্নত দেশ থেকে। এগুলো হচ্ছে- চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও রাশিয়া। সঙ্গে আছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। শিল্পোন্নত দেশগুলোর লাগামহীন আচরণে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ছে। বরফ গলে যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এ সবকিছু ঘটছে। পৃথিবী উষ্ণ হওয়ার কারণেই জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন জীবন ও অর্থনীতির অস্তিত্বের জন্য একটি হুমকি। জলবায়ুর এখন ঘরের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। চরম তাপমাত্রা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, বন্যা ও খরা, অধিকতর তীব্র গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঋতু পরিবর্তন, নদীভাঙন, সাগরে লবণাক্ততা বৃদ্ধি বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর মারাত্মক নৈতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক ঘটনায় বাস্তুচু্যত হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশে এরই মধ্যে জলবায়ু অভিবাসীদের সংখ্যা ৬০ লাখ ছাড়িয়েছে।জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে সবচেয়ে ক্ষতি হওয়া দেশগুলোর শীর্ষে বাংলাদেশ। সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই অগ্রপথিক। বিশ্বে বাংলাদেশই প্রথম দেশ, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাকশন পস্ন্যান প্রণয়ন করেছে। নিজস্ব বাজেট থেকে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় ঢাকঢোল পিটিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ পাওয়ার প্রতিশ্রম্নতিতে গঠিত 'বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট' (বিসিসিটি) চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ নেই। বিশ্ব জলবায়ু তহবিল থেকে অর্থ আসছে না। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের (বিসিসিটি) নেই নিজস্ব ভবন, ঢাকার মহাখালীতে বন ভবনের পুরানো অফিসে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের কার্যক্রম জোড়াতালি দিয়ে চলছে। জেলা বা বিভাগীয় পর্যায়ে অফিস নেই এই প্রতিষ্ঠানটির। নামমাত্র বরাদ্দ নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে বিসিসিটি।