বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার আবেদনে সাড়া দেয়নি সরকার। এ বিষয়ে রোববার আইন মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, বিদেশ যেতে হলে খালেদা জিয়াকে ফের জেলে গিয়ে পরে আদালতে আবেদন করতে হবে। আইন মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে 'হুঙ্কার' দিলেও নতুন করে কোনো কর্মসূচি দেয়নি বিএনপি।
এদিন সকালে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তার দপ্তরের সামনে সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়ার স্থায়ী মুক্তি ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর বিষয়ে তার ভাই যে আবেদনটি করেছিলেন সে বিষয়ে আইনি মতামত দিয়ে তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। আইনগতভাবে অনুমতি দেওয়ার কোনো সুযোগ সরকারের হাতে নেই। সেই মতামতই আইন মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়েছে।
তবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ফৌজদারি কার্যধারার ৪০১-এর একটি উপধারা অনুযায়ী দুটি শর্তে তাকে বাসায় থেকে চিকিৎসা নেওয়ার যে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল সে আদেশ তারা বাতিল করবেন না। ফলে সরকারের যে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়া শর্তসাপেক্ষে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন সেটি সেই আদেশ বাতিল না করলে তার আপাতত জেলেও ফেরত যাওয়ার সুযোগ নেই।
তিনি আরও বলেন, খালেদা জিয়ার পক্ষে প্রথম যে দরখাস্ত ছিল সেটি ২০২০ সালের মার্চে নিষ্পত্তি করা হয়েছিল তখন দুটি শর্তসাপেক্ষে তার দন্ডাদেশ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। শর্ত দুটি ছিল- প্রথমত, তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন এবং দ্বিতীয়ত, তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না।
আইনমন্ত্রী বলেন, এসব শর্ত মেনেই তিনি কারাগার থেকে বের হয়ে বাসায় যান। প্রতি ছয় মাসে সেটা বৃদ্ধি করে
\হএ পর্যন্ত আটবার বাড়ানো হয়েছে। আর ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী কোনো দরখাস্ত একবার নিষ্পত্তি হলে সেটি আর পরিবর্তনের সুযোগ থাকে না। ফলে বিদেশে যাওয়ার আবেদন করতে হলে খালেদা জিয়াকে কারাগারে ফেরত গিয়ে আবেদন করতে হবে। কিন্তু ৪০১ ধারা সরকার যখন প্রয়োগ করে সেটি আদালতে চ্যালেঞ্জ করার নজির উপমহাদেশে নেই। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগেই পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে বিদেশে যাওয়ার আবেদন করতে হলে খালেদা জিয়াকে কারাগারে ফেরত গিয়ে করতে হবে। আইনমন্ত্রীর বক্তব্যে তারই প্রতিফলন হলো বলে মনে করা হলো।
এদিকে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বলেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে করা আবেদন আইনগতভাবে বিবেচনা না করে, রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হয়েছে দেশে আইনের শাসন নেই। এর মাধ্যমে খালেদা জিয়ার প্রতি এক ভয়ংকর তামাশা করা হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, সরকার চাইলেই নির্বাহী আদেশে তাকে মুক্তি দিতে পারতেন এবং বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ করে দিতে পারতেন।
খালেদা জিয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে জাতির সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে অভিযোগ করে কায়সার কামাল বলেন, 'আইনমন্ত্রী পাবলিক স্টেটমেন্ট দিয়ে বলেছিলেন খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে যদি আবেদন করা হয়, সেটি সুবিবেচনা করা হবে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দার গত ২৫ সেপ্টেম্বর আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সেই আবেদনটি আইনগতভাবে বিবেচনা না করে রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করা হয়েছে এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফলাফল এই সিদ্ধান্তের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি।'
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি
এদিকে চিকিৎসা নিয়ে সরকার ও বিএনপি নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের পর খালেদা জিয়ার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। রোববার রাতে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট বৃদ্ধি পায়। মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকদের তাৎক্ষণিক তৎপরতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। এ সময় তার এক্সরে করানো হয়। একজন চিকিৎসক জানান, খালেদা জিয়াকে করোনারি কেয়ার ইউনিটে নেওয়ার জন্য সার্বক্ষণিক প্রস্তুতি রাখা হয়েছে। দুপুরে তার ইসিজি ও ইকো ডায়াগ্রাম করানো হয়। ফুসফুসের পানি অপসারণের জন্য তার ডান পাশে যে ক্যাথেটার লাগানো ছিল সেটা আপাতত খুলে ফেলেন চিকিৎসকরা।
ওই চিকিৎসক জানান, বিএনপি চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থা দুর্বলতার পাশাপাশি লিভার সিরোসিসের অবস্থা গুরুতর। এ বিষয়ে দেশে উন্নত চিকিৎসা নেই। তার লিভার প্রতিস্থাপন ছাড়া বিকল্প নেই। লিভারের পাশাপাশি তার কিডনি জটিলতা ও ডায়াবেটিসের মাত্রাও বাড়ছে। ফলে একটিকে কমাতে গেলে আরেকটিতে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এখন সহনশীল ওষুধ দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চলছে।
লিভার জটিলতা ছাড়াও ৭৮ বছর বয়সি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ফুসফুস, কিডনি, হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। গত ৯ আগস্ট গুলশানের বাসা ফিরোজায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্তে তাকে বসুন্ধরার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৫৩ দিন ধরে তিনি ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বর্তমানে করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) সেটঅ্যাপে কেবিনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দিচ্ছে।
নেতাকর্মীরা হতাশ
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার বিষয়ে গত কিছুদিন ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছিল। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে কথাবার্তা বলে তার পরিবার আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। তাদের ধারণা ছিল, শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এবার বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হতে পারে। সরকারের তরফ থেকেও ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছিল- খালেদা জিয়ার বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য করা পরিবারের আবেদন ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে রোববার বেগম জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার আবেদন আইন মন্ত্রণালয়ে বাতিল হওয়ার পর জীবনমৃতু্যর সন্ধিক্ষণে থাকা দলীয় প্রধানের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিতে শুধু ক্ষমতাসীনদের করুণার দিকে তাকিয়ে থাকাকে সাধারণ নেতাকর্মীরা মেনে নিতে পারছেন না। তার উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিতে দল ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়ার পর চুপসে যাওয়ায় অনেকেই হতাশ। এর আগে দুই বছর ধরে জেলে থাকার পরও মুক্তির ব্যাপারে সরকারকে চাপে ফেলার মতো কোনো আন্দোলন গড়তে যেমন পারেনি এবারও চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর আন্দোলনও জমাতে পারেনি দলটি। বহিঃবিশ্বের চাপে কিছুটা বেকায়দায় থাকা সরকারকে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠাতে গত রোববার ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয় বিএনপি। এই আলটিমেটামের পর এক সপ্তাহের বেশি সময় শেষ হয়েছে। এবার বিদেশ পাঠানোর আবেদন নাকচ হওয়ার পরও দলটি কার্যত নীরব ভূমিকা পালন করছে।
দলের সিনিয়র এক নেতা বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি এখন সরকারের বিদায়ের ওপর নির্ভর করছে। আন্দোলনে এই সরকারকে বিদায় করতে না পারলে খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং বিদেশে উন্নত চিকিৎসার দরজা খুলবে না। তাই এখন আন্দোলনের মাধ্যমেই এই ইসু্যর সুরাহা করবে দলটি।
জানা গেছে, চলমান এক দফার আন্দোলনে দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি এখন জোরালোভাবে সম্পৃক্ত করবে বিএনপি। এই ইসু্যতে ধারাবাহিক কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে জোটগত ছাড়াও দলীয়ভাবেও কর্মসূচি আসতে পারে। আজ সোমবার অনুষ্ঠেয় দলের স্থায়ী কমিটিতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার আবেদন বাতিল হওয়ায় বিএনপির করণীয় সম্পর্কে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, 'আমরা তো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে সরকার পতনের আন্দোলনে আছি। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার ব্যাপারে সরকার নতুন করে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে তাতে দেখা যায়, আন্দোলনের মাধ্যমেই সুরাহার পথ বের করতে হবে।
এদিকে, খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে সরকারের সঙ্গে পর্দার অন্তরালে পরিবারের আলোচনার খবরকে ভিত্তিহীন বলছে বিএনপি। দলটির দুজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে সরকারের সঙ্গে পর্দার আড়ালে কখনো কোনো আলোচনা হয়নি। বেগম জিয়া গুরুতর অসুস্থ। এজন্য বারবার তার মুক্তির দাবি জানানো হয়েছে। একইভাবে পরিবারও আবেদন করেছে তার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু সরকার যে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তাকে আটক রাখছে সেটা তাদের জানা ছিল।
রিজভীর সংবাদ সম্মেলন
সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী গণমাধ্যমকে ব্রিফ করার কিছুক্ষণ পরই নয়া পল্টনে বিএনপি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, 'আইন মন্ত্রণালয়ের এই নেতিবাচক সিদ্ধান্ত মানবতাবিরোধী ও বর্বর। ইচ্ছে পূরণের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। জনগণ এটা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। এটি পূর্বপরিকল্পিত ও গভীর নীলনকশার অংশ। এ অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনগণ হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। এই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনগণ পথে পথে অবরোধ করবে।' তিনি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন জনগণ এটা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে।
রিজভী আরও দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার 'আক্রোশ ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই' এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়।
প্রসঙ্গত, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রম্নয়ারি থেকে খালেদা জিয়ার কারাভোগ শুরু হয়। টানা দুই বছর কারাভোগের পর অসুস্থতার কারণে সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়ে ২০২০ সালের মার্চে বাসায় ফিরে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। এরপর থেকে এ পর্যন্ত আটবার তার মুক্তির সময়সীমা বাড়িয়েছে সরকার। তাকে বিদেশে চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য অনুমতি চেয়ে তার পরিবারের পক্ষে তার ভাই শামিম ইস্কান্দার সর্বশেষ যে আবেদন করেছিলেন সেটিই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইনি যাচাইবাছাইয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। আবেদন করার পর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে 'খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি সরকার ইতিবাচকভাবে দেখতে' পারে এমন গুঞ্জন ছিল।