শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১

ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা :বিধিমালা বাস্তবায়নে জোর দাবি

বীরেন মুখার্জী
  ২১ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০
ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা :বিধিমালা বাস্তবায়নে জোর দাবি

প্রযুক্তির অগ্রগতিতে ই-বর্জ্য এক অনিবার্য বাস্তবতা। বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও সরকার তথ্যপ্রযুক্তির ওপর জোর দেওয়ায় দেশে ইলেকট্রিক্যাল এবং ইলেকট্রনিকস পণ্য ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রযুক্তিকে যেমন উপেক্ষা করার সুযোগ নেই, তেমনি ই-বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনায় উদাসীন থাকাও বিপজ্জনক। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা থাকা সত্ত্বেও বাস্তবায়ন না হওয়ায় উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে ই-বর্জ্য। এ জন্য ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী আইনি কাঠামোতে আনা জরুরি।

সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশে ই-বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা কাঠামো নেই। ফলে মানুষের মধ্যেও এ বিষয়ে সচেতনতা কম। অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে, নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে যে যার মতো ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করছেন। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ই-বর্জ্যের সিসা, সিলিকন, টিন, ক্যাডমিয়াম, পারদ, দস্তা, ক্রোমিয়াম, নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি রাসায়নিক পানি দূষিত করছে। মাটির গুণগত মান নষ্ট করছে। নানাভাবে এসব রাসায়নিক মানুষের শরীরে প্রবেশ করে নানা রোগের ঝুঁকি তৈরি করছে। বিশেষ করে গর্ভবতী মা ও শিশুরা ই-বর্জ্যের বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন।

পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে সাড়ে ১৩ কোটির বেশি মোবাইল ফোন ও প্রায় ১০ লাখ ল্যান্ডফোন ব্যবহারকারী রয়েছেন। প্রতি বছর প্রায় সাড়ে সাত লাখ মোবাইল ফোন সেট আমদানি করা হয়। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি তথা মোবাইল সেট, টেলিভিশন, ফ্রিজ ইত্যাদির ব্যবহার বেড়েছে, একই সঙ্গে ই-বর্জ্যের পরিমাণও বাড়ছে।

তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের

১০ জুন 'ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১'-এর গেজেট জারি করে সরকার। কিন্তু এটিও বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেই।

বিধিমালা অনুযায়ী, এর কোনো শর্ত লঙ্ঘনে 'বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত, ২০১০)'-এর ১৫ (১) ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রয়েছে। দ্বিতীয়বার একই অপরাধের ক্ষেত্রে ২ থেকে ১০ বছরের কারাদন্ড বা ২ থেকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড পেতে হবে বলে উলেস্নখ করা হয়েছে।

বিধিমালা অনুযায়ী প্রত্যেক ই-বর্জ্য প্রস্তুতকারক, ব্যবসায়ী বা দোকানদার, মজুতকারী, পরিবহণকারী, মেরামতকারী, সংগ্রহকেন্দ্র, চূর্ণকারী, পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকারী, নিলাম বিক্রেতা ও রপ্তানিকারককে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন নিতে হবে।

দেশে ই-বর্জ্য পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকলে রপ্তানিকারক পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে তা বিদেশে রপ্তানি করতে পারবেন বলেও বিধিমালায় উলেস্নখ করা হয়েছে। ই-বর্জ্য কেউ ১৮০ দিনের বেশি মজুত রাখতে পারবেন না। তবে কিছু ক্ষেত্রে আবেদনকারীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অধিদপ্তর আরও ৯০ দিন পর্যন্ত বাড়াতে পারবে বলে বিধিমালায় উলেস্নখ রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভয়েসের এক পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ টন ই-বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে। যার মাত্র ৩ শতাংশ সঠিক পুনর্ব্যবহার বা রিসাইকেল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে। বাকি ই-বর্জ্য ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে বা পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে অথবা অদক্ষভাবে এই বর্জ্য থেকে পুনরায় ব্যবহার্য ধাতু নিঃসরণ করা হয়েছে।

ভয়েসের নির্বাহী পরিচালক আহমেদ স্বপন মাহমুদ বলেন, 'প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল, কম্পিউটারসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রাদির ব্যবহার বেড়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত রিসাইকেল ব্যবস্থাপনা না থাকায় দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে ই-বর্জ্য যত্রতত্র নিক্ষেপ করা হচ্ছে, যা আমাদের নতুন ধরনের পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন করছে। এ সমস্যা নিরসনে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ, সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং যন্ত্র উৎপাদনকারী ও ব্যবহারকারীদের দায়িত্বপূর্ণ আচরণ জরুরি।'

ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সরকারের উদাসীনতার পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগও নগণ্য। পর্যবেক্ষরা ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পুনঃপ্রক্রিয়াকরণে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেছেন। পরিকল্পিতভাবে ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান ধাতু সংগ্রহ করে রপ্তানির যে সম্ভাবনা রয়েছে, তা কাজে লাগাতে পারলে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সহজ হওয়ার পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথও সুগম হবে বলে মনে করছেন তারা।

দেশে বেসরকারিভাবে একমাত্র আজিজু রিসাইক্লিং অ্যান্ড ই-ওয়েস্ট কোম্পানি লিমিটেড ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করছে। আজিজু রিসাইক্লিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইদুর রহমান শাহীন সম্প্রতি বলেন, 'বিধিমালা বাস্তবায়ন করা হলে ই-বর্জ্যের মাধ্যমে যে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে তা রোধ করা সম্ভব। আমরা সিঙ্গাপুরের একটি ই-ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির অংশীদার হিসেবে কাজ করছি। সার্কিটবোর্ডগুলো আমরা সিঙ্গাপুরে পাঠিয়ে দিই। নারায়ণগঞ্জ কারখানায়ও ই-বর্জ্যের কিছু অংশের পুনঃচক্রায়ন আমরা করি। সার্কিটবোর্ড পুনঃচক্রায়ন করতে আমরা দেশেই পস্ন্যান্ট স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। দেশের মধ্যে প্রচুর ই-বর্জ্য থাকলেও কোনো নিয়ম-কানুন না থাকায় পর্যাপ্ত বর্জ্য পাচ্ছি না।'

ভয়েসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৩০ শতাংশ হারে ই-বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে। ই-বর্জ্যের সরাসরি প্রভাব ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা গেছে।

অন্য একটি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ই-বর্জ্য শুধু বাংলাদেশেই নয়, গোটা বিশ্বেই বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। যে হারে ই-বর্জ্য বাড়ছে তাতে ২০২৫ সাল নাগাদ বিশ্বে ই-বর্জ্যের পরিমাণ দাঁড়াবে ছয় কোটি ৫৩ লাখ টন এবং ২০৩৫ পর্যন্ত হবে সাত কোটি ৪৭ লাখ টন।

বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ আতিকুল ইসলাম বলেন, 'ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সরকার 'বাংলাদেশ এনভায়রমেন্টাল সাসটেইনেবিলিটি অ্যান্ড ট্রান্সফরমেশন প্রজেক্ট' এবং কালিয়াকৈর এ বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটিতে 'ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পস্ন্যান্ট'- এর পরিকল্পনা গ্রহণ করে পূর্ণ গতিতে কাজ শুরু করেছে, ২০২৭ সালের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করা হবে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বিশ্বে ১ কোটি ২৯ লাখ নারী অপ্রাতিষ্ঠানিক বর্জ্য খাতে নিয়োজিত। পাশাপাশি অন্তত ১ কোটি ৮০ লাখ শিশু-কিশোরের একটা বড় অংশের বয়স পাঁচ বছরের নিচে, যারা সক্রিয়ভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতের সঙ্গে যুক্ত আছে। সংস্থাটি আরও বলছে, অভিভাবকেরা প্রায়ই শিশুদের ই-বর্জ্য খেলতে দেন ও পুনর্ব্যবহার কাজে লাগান। ঘরের মধ্যে শিশুরা এগুলো খেলনা হিসেবে ব্যবহার করে। ই-বর্জ্যের বিষাক্ত রাসায়নিক, বিশেষ করে মার্কারি এবং সিসা উচ্চমাত্রায় থাকে। এসব ক্ষতিকর পদার্থ শিশুকে সহজে আক্রান্ত করছে এবং তাদের বুদ্ধি বিকাশের ক্ষমতাকে হ্রাস করছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে