শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

সতর্ক হচ্ছেন পোশাক শ্রমিকরাও

সাখাওয়াত হোসেন
  ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০
সতর্ক হচ্ছেন পোশাক শ্রমিকরাও

নতুন মার্কিন শ্রমনীতি নিয়ে কোনো চাপ অনুভব করছেন না সরকার-মন্ত্রী, আমলা ও বিজিএমইএ'র অনেক নেতা এমন দাবি করলেও এতে আস্থা রাখতে পারছেন না গার্মেন্টস মালিকরা। তাদের আশঙ্কা, বিশ্বব্যাপী শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মার্কিন শ্রমনীতি ঘোষণা করা হলেও রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ তার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। এছাড়া শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে এই নীতি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রের ওপর আরোপের সুযোগ রয়েছে। তাই এ সংক্রান্ত জটিলতা এড়াতে সরকারের পাশাপাশি শিল্প মালিকদেরও সতর্ক থাকা জরুরি বলে মনে করছেন তারা।

এদিকে চলমান পরিস্থিতি শেষ মুহূর্তে কোন দিকে মোড় নেয়, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকরাও। তাদের আশঙ্কা, মার্কিন শ্রমনীতির বেড়াজালে দেশের গার্মেন্টস শিল্পে মন্দা দেখা দিলে তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়বেন। আন্তর্জাতিক চাপে গার্মেন্টস মালিকরা উচ্চ মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করতে বাধ্য হলেও তাদের প্রকৃত আয় কমে যাবে। এতে তাদের জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে যাওয়ারও ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। তাই নিজেদের স্বার্থে তারা কেউ যেন কারও উসকানির ফাঁদে পা দিয়ে ছোটখাটো ইসু্যতে আন্দোলনের নামে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি না করে সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাজপথে বিশৃঙ্খলার পরিবর্তে কৌশলী মালিকপক্ষকে চাপে রেখে ন্যায্য মজুরি ও ওভারটাইম আদায়ের পথ খুঁজছে।

শ্রমিক নেতাদের অনেকেই মনে করেন, রাজনৈতিকভাবে চাপে রাখতে বাংলাদেশের গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপর মার্কিন শ্রমনীতির খড়গ নামতে পারে। তাই নিজেদের স্বার্থেই তাদের সতর্ক থাকতে হবে। কারণ এ শিল্পের নেতিবাচক ধাক্কা শুধু প্রত্যক্ষভাবে তাদের ওপর পড়বে তা-ই নয়, পরোক্ষভাবেও গোটা দেশের মানুষকে ভোগাবে। কারণ গার্মেন্টস শিল্পে ধস নামলে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়বে। এ শিল্পে কর্মরত ৪০ লক্ষাধিক শ্রমিকের অন্য কোনো খাতে কর্মসংস্থান অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক সংহতির সভাপতি তাসলিমা আক্তার বলেন, 'আমরা চাই না শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হোক। তারপরও যদি বাইরে থেকে কোনো চাপ তৈরি হয়, তাহলে মালিকপক্ষকেই এর দায়িত্ব নিতে হবে। তবে মার্কিন শ্রম অধিকার সুরক্ষার সাম্প্রতিক নীতি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, এটা সারা বিশ্বের জন্য। বাংলাদেশের বড় সুবিধা হচ্ছে সস্তা শ্রম। এতে ক্রেতারা লাভবান হচ্ছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমনীতির কারণে বাংলাদেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ হবে না। তবে সরকারের এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। যাতে শ্রমিকদের

অধিকার ক্ষুণ্ন না হয়। বঞ্চিত না হয় ন্যায্য অধিকার থেকে। এ ব্যাপারে নিজেদের দায়িত্ববোধ থেকে আমরাও সতর্ক রয়েছি।'

পোশাক খাতের নূ্যনতম মজুরি নির্ধারণ নিয়ে অস্থিরতায় চার শ্রমিকের মৃতু্য হয়েছে উলেস্নখ করে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, শ্রমিক নেতারা সাধারণত সংগঠনের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা ও চলাচলের স্বাধীনতা নিয়ে অসুবিধায় পড়েন। তার মতে, শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার ও কারখানা মালিকদের সক্রিয় হতে হবে। শ্রমিকদের বিরুদ্ধে পুলিশের সব মামলা প্রত্যাহার, হযরানি ও ভয়ভীতি দেখানো থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি তিনি বিদেশে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ভাবমূর্তি উন্নয়নে সম্প্রতি ঘোষিত মজুরি কাঠামো পুনর্মূল্যায়নের পরামর্শ দেন।

ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের সভাপতি আমিরুল হক আমিনও দেশে শ্রম অধিকার নিশ্চিত করতে সরকার ও কারখানা মালিকদের আরও মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ৪৩টি পুলিশি মামলা প্রত্যাহার এবং আটক ১১৫ শ্রমিক ও সাত শ্রমিক নেতার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেন। চার শ্রমিকের মৃতু্যর ঘটনার তদন্ত অবিলম্বে শুরুরও দাবি জানান তিনি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতির প্রতি মনোযোগ দেওয়া ও এসব উদ্বেগের সমাধান করা। কেননা, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের একক বৃহত্তম রপ্তানি বাজার ও তুলার প্রধান উৎস। তাই বাংলাদেশের উচিত শ্রম অধিকার বিষয় ও ট্রেড ইউনিয়নের উদ্বেগের সমাধান করা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে ঢাকা-ওয়াশিংটনের টানাপোড়েনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমনীতি ঘোষণা কোনো কাকতালীয় বিষয় নয়। এর নেপথ্যে সুস্পষ্ট যোগসূত্র রয়েছে। তাই শ্রম অধিকার নিয়ে সূক্ষ্ণ ফাঁক পেলেও যুক্তরাষ্ট্র সে সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। তাই গার্মেন্টস মালিকদেরও যেমন শ্রম অধিকার ও তাদের কর্ম পরিবেশ নিশ্চিত করতে সচেষ্ট হতে হবে, তেমনি সরকারকেও রাজনৈতিক চাপ সামাল দিয়ে ঘোলাটে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে হবে। এখানে শ্রমিকদের সতর্ক থাকার বিষয়টিও জরুরি বলে মনে করেন তারা।

এদিকে ঢাকা, সাভার, আশুলিয়া ও নারায়ণগঞ্জের একাধিক গার্মেন্টস কারখানার ডজন দু'য়েক শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেছে। শ্রমনীতি নিয়ে বিজিএমইএ নেতারা কোনো দুশ্চিন্তা নেই বলে জানালেও তা তাদের মনের কথা নয় বলে অনেকেই দাবি করেছেন।

আশুলিয়ার একটি গার্মেন্টস কারখানার লাইন সুপারভাইজার শহিদুল আলম জানান, গার্মেন্টস মালিকরা কারখানার প্রোডাকশন ম্যানেজারসহ বিভিন্ন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে শ্রমিকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। তাদের বিশৃঙ্খলায় কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান নিষেধাজ্ঞার ফাঁদে পড়লে শ্রমিকদের মহাবিপদে পড়তে হবে- এ বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন।

গার্মেন্টস শ্রমিক আলেয়া খাতুন এ প্রতিবেদককে বলেন, দেশের রাজনীতিই আমরা বুঝি না, সেখানে আন্তর্জাতিক রাজনীতি তো আমাদের মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। তবে গার্মেন্টস শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমাদের পথে বসতে হবে, এটি পরিষ্কার। তাই গার্মেন্টস মালিকদের ছোট বড় অনিয়ম অনেক সময় চোখ বুঁজে সয়ে যাই। কষ্ট হলেও দু'মুঠো অন্নের সংস্থান হচ্ছে। রাজনীতির ফাঁদে পড়ে এতে টান পড়লে আমাদের বসতে হবে।

আলেয়া খাতুন জানান, দেশেও অনেকে তাদের দিয়ে রাজনীতির খেলা খেলতে চান। অনেক সময় না বুঝে তারাও সে ফাঁদে পা দেন। কিন্তু দেশের এ দুঃসময়ে তাদের সতর্ক থাকতে হবে। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে শ্রমিকদের উসকে দিয়ে কোনো চক্র যাতে ফায়দা লুটতে না পারে এ ব্যাপারেও গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠনের নেতারা সতর্ক করেছেন বলে জানান তিনি।

জানা গেছে, বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে বর্তমানে স্প্রিং-সামার মৌসুমের পণ্য উৎপাদন চলছে। আগামী মার্চ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় এ মৌসুমের পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি চলবে বায়ারদের কাছে পণ্য পাঠানো। কিন্তু জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে 'ফল' মৌসুমের অর্ডার নিয়ে। নভেম্বর মাস থেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম এ মৌসুমের অর্ডার আসার কথা থাকলেও বিদেশি বায়ারদের কাছ থেকে তেমন সাড়া মিলেনি।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, নভেম্বর মাসে যে অর্ডারগুলো আসার কথা ছিল, সেগুলো আশানুরূপ হারে পাওয়া যায়নি। আন্দোলনের প্রভাব আগামী কতদিন পর্যন্ত চলবে তা নিয়ে বায়াররা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। সে জন্য যে পণ্যগুলো মার্চ থেকে মে মাসে ডেলিভারি হওয়ার কথা, সেগুলোর অর্ডার তারা আমাদের এখনো দিচ্ছেন না, রেখে দিয়েছেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৭টি দেশের পাশাপাশি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডা হলো বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের মূল বাজার। আর এসব দেশেই বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প নিয়ে অপপ্রচারের মাত্রা তুলনামূলক বেশি। তাই বায়ারদের আস্থা ফেরাতে দেশগুলোর বাংলাদেশ দূতাবাসকে এখনই ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা।

হা-মীম গ্রম্নপের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী এ কে আজাদ বলেন, 'আমাদের ৯০ শতাংশের বেশি চালান যায় যুক্তরাষ্ট্রে। আমাদের কারখানার পোশাক রপ্তানির বিষয়ে আমি উদ্বিগ্ন।' তিনি সরকারকে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলার পরামর্শ দেন।

বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসানও এ ব্যাপারে একমত পোষণ করে বলেন, 'বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানির পরিণতি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশে ধাপে ধাপে শ্রম অধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে পরামর্শ করে শ্রম অধিকার ও এর চর্চা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিচ্ছে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে