শনিবার, ১০ মে ২০২৫, ২৬ বৈশাখ ১৪৩২

রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ নেতাদের পুকুরের দায়িত্বে বিএনপি নেতারা!

রাজশাহী অফিস
  ০৯ মে ২০২৫, ১০:২০
রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ নেতাদের পুকুরের দায়িত্বে বিএনপি নেতারা!
ছবি: যায়যায়দিন

রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার উজালখলসি আড়োইল বিলে প্রায় ৩০০ বিঘা তিন ফসলি আবাদি জমিতে অবৈধভাবে পুকুর খননের কাজ শুরু হয় বিগত সরকারের শেষের দিকে। তাহেরপুর পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা কার্তিক সাহা এবং যুবলীগ নেতা সোহেল রানা, স্থানীয় এমপি ও প্রতিমন্ত্রীর ছত্রছায়ায় কৃষকদের ভয়ভীতি দেখিয়ে এই জমি দখল করেন।

শুরুর দিকে ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে খনন কাজ চালালেও গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তা স্থগিত হয়ে যায়। তবে স¤প্রতি ঈদের ছুটিকে কাজে লাগিয়ে আবারও শুরু হয়েছে পুকুর খননের কাজ। এবার তাদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন স্থানীয় বিএনপি নেতারা।

উজালখলসি আড়োইল বিলে পুকুর খননের কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব নিয়েছেন তাহেরপুর পৌরসভা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বাগাতি। তিনি জেলা প্রশাসকের কাছে পুকুর খননের আবেদন দাখিল করেন এবং কার্তিক সাহা ও সোহেল রানার পক্ষে সাক্ষাৎও করেন। এই আবেদন বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে, যা তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে।

স্থানীয় সূত্র বলছে, সাইফুল ইসলাম ও তার সহযোগীরা ইউএনও সাবরিনা শারমিনকে চাপ দিচ্ছেন তদন্ত প্রতিবেদন তাদের পক্ষে নিতে। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ বিএনপির একাংশের নেতাকর্মী এবং সাধারণ কৃষকরা।

সাইফুল ইসলাম বাগাতি অবশ্য চাপ দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘‘পুকুর খনন সম্পন্ন না হওয়ায় দুই পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত। কৃষকরা টাকাও পাচ্ছে না, আবার ফসলও করতে পারছে না। তাদের কথা বিবেচনায় নিয়েই সহযোগিতা করছি।’’

এদিকে, পুঠিয়া উপজেলার শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের রাতুয়াল বিলে প্রকাশ্যে খনন চলছে দুটি বিশাল পুকুরের। স্থানীয় বিএনপি নেতা আব্দুর রাজ্জাক এসব খননের দেখভাল করছেন। তিনি পুঠিয়ার সাবেক মেয়র ও বিএনপি নেতা আল মামুন খানের অনুসারী। অভিযোগ রয়েছে, রাজ্জাক তার ক্যাডার বাহিনী মোতায়েন করে আওয়ামী লীগ নেতা কামাল হোসেন ওরফে কামাল মিস্ত্রীকে পুকুর খননে সহযোগিতা করছেন।

আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘‘কামাল ও রিজভী জমি লিজ নিয়ে পুকুর খনন করছে। আমি শুধু খনন কাজ তদারকি করছি। এতে আমার কোনো অংশ নেই।’’

স্থানীয়ভাবে আলোচিত তিন ব্যক্তি- কার্তিক সাহা, সোহেল রানা ও কামাল হোসেন ওরফে কামাল মিস্ত্রীকে রাজশাহীর দুর্গাপুর, পুঠিয়া ও বাগমারা উপজেলায় পুকুর খনন সিন্ডিকেটের মূল হোতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এমপির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এই তিনজন অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে কৃষকদের জমি দখলের অভিযোগে অভিযুক্ত। তারা তিন উপজেলায় শতাধিক পুকুর খনন করেছেন।

কামাল হোসেন নিজেও স্বীকার করেছেন, ‘‘আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২২টি পুকুর খনন করেছি। তবে আমি একা না, কয়েকজনে শেয়ারে করেছি। বর্তমানে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে আবারও পুকুর খনন করছি।’’

স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, দিনের আলোতেই পুকুর খননের কাজ চললেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে তিন ফসলি জমির ভবিষ্যত নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছেন কৃষকরা।

দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাবরিনা শারমিন বলেন, ‘‘আমি একাই অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়ছি; জানি না কত দিন টিকতে পারবো। যতদিন দায়িত্বে আছি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পিছপা হব না।’’

তিনি আরও জানান, ‘‘পুকুর খননের অনুমতি এখন জেলা প্রশাসক দেন। কেউ অনুমতি ছাড়া খনন করলে অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

স্থানীয় সূত্র জানায়, কার্তিক সাহা, সোহেল রানা ও কামাল হোসেন শুধু পুকুর খনন সিন্ডিকেটের সদস্যই নন, তারা স্থানীয় এমপির ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং ক্যাডার বাহিনীর অংশ হিসেবেও পরিচিত। কার্তিক ছিলেন ‘হেলমেট বাহিনী’র প্রধান, যিনি গত বছরের ৫ আগস্ট তাহেরপুরে প্রায় দেড় শতাধিক হেলমেট সরবরাহ করেন আন্দোলনকারীদের দমাতে। সোহেলের দায়িত্বে ছিল অস্ত্রের দেখভাল, আর কামাল হোসেন ছিলেন এমপির ‘বিশেষ গোয়েন্দা বাহিনী’র দায়িত্বে।

মূলত কামাল পেশায় রাজমিস্ত্রী ছিলেন। তিনি স্থানীয় এমপির বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণে কাজ করার সুবাদে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন। পরে রাজমিস্ত্রির কাজ ছেড়ে রাজনীতিতে যুক্ত হন এবং পুকুর খননের তদারকির দায়িত্ব নেন। ধীরে ধীরে তিনি নিজেই ২২টির বেশি পুকুর খনন করেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে